এখনো সাড়েনি সিডরের ক্ষত

“সেদিন আমি আমার নিজ বাড়িতে ছিলাম। আমার দুই মেয়ে ও আমি, ঘুমাইনি ওরা। আমার স্বামী ছিল দোকানে। হঠাৎ করে পানি আসছে।” বলছিলেন বাগেরহাটের সাউথখালির গাবতলা গ্রামের লাইলি বেগম। যিনি ‘সিডরে’ স্বামী ও এক মেয়েকে হারিয়েছেন।
আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে, ১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে আঘাত হেনেছিল এক ভয়াবহ সাইক্লোন ‘সিডর’।
সেই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, আরো হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারান এই ঝড়ে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, ও ঝালকাঠি- এ চারটি জেলায়।
সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছিল বাগেরহাটের সাউথখালি ও শরণখোলায়।
সাউথখালি গাবতলা গ্রামের লাইলি বেগম সেদিনের স্মৃতিচারণ করেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে।
লাইলি বেগমের স্বামী আশরাফুল আলম খান, রেডক্রস কর্মী ছিলেন। তিনি সেসময় তাঁর গ্রামের বাসিন্দাদের সতর্ক করে দিয়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের তালা খুলে দিলেও ছোট মেয়ে ও নিজেকে আর প্রাণে বাঁচাতে পারেননি।
“পানি আসার পর আমার বড় মেয়েকে আমি হাতে ধরছি। পানি এসে ভাসায়ে নিয়ে গেল বাড়ি। সে পানির নীচে পড়ে গেছিল। সেদিনের পরিস্থিতি ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। মনে হলেই ভয় লাগে”।
“আমি আর আমার বড় মেয়ে নারিকেল গাছ ধরে বাঁচছি। সাইক্লোনে আমার ছোট মেয়ে, স্বামী ও জা-আমার পরিবারের এই তিনজনকে নিয়ে গেছে।”-কান্নাজড়ানো কন্ঠে সেদিনের কথা বলছিলেন লাইলি।
ঘূর্ণিঝড়ে সব ভেঙে যাবার পর আবার নতুন করে বাড়ি বানানোর চেষ্টা করছে এক পরিবার।
রেডক্রস কর্মী হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি?
লাইলি বেগম বলছিলেন সে সময়টা তাঁরা পাননি।
“গ্রামে মাইকিং করে সে ঘরে আইসা নামাজ পড়ছে। নদীর কাছে পানি কতদূর দেখে আসলো। এরপর সাইক্লোনে আশ্রয়কেন্দ্রের তালা খুলে দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে আসছে। আমার ভাসুর আইসা বলছে -চল সাইক্লোন কেন্দ্রে যাই। সে তখন বলছে হক ভাই কেন্দ্রে যাওয়া লাগবে না, দেখি কতদূর কী হয়। এটা বলার চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে পানি আইসা ভাসায়ে দিলো। আমরা যে কোথাও যাবো সে পরিস্থিতি ছিল না।”
“আমার ছোট মেয়ে পানি দেইখা তার কোলে উঠে গলায় ধরে বলছে -আব্বু তুমি আমারে ছাইড়া দিবা না। মেয়েকেও সে ধরছে। ওই যে পানির নীচে সে পড়ছে। শুক্রবার পাইনি।”
“শনিবার যখন তার লাশ পাইছি তখন সে একইভাবে মেয়েরে গলায় জড়ায়ে ধরেই ছিল। ওই জীবনের কথা ভুলার মতো না।”
“মেয়ের লাশ, স্বামীর লাশ যেভাবে দেখছি-ওই সময় দাফন করা-ওইটা ভুলার মতো না।” বরছিলেন লাইলি বেগম।
এরপর বাবার বাড়িতে বড় মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন লাইলি বেগম। মেয়েকে পড়াশুনা করাচ্ছেন।
সাউথখালির সমস্ত ঘরবাড়ি ভেসে যায় সিডরের আঘাতে। পুরো এলাকাটাই পানিতে ভেসে গিয়েছিল।
লাইলি বেগমের ভাষায় ওই এলাকা ছিল পুরোটাই ‘সমুদ্রের মতোন’।
এলাকার বাসিন্দারা এখন আস্তে আস্তে স্বাবলম্বী হয়েছে। থাকার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে কজনের। আর কিছু মানুষ এখনও নদীর পারে থাকছে কষ্ট করেই। -বিবিসি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button