রাসূল (সা.)-এর আদর্শে ইহকাল ও পরকাল বিচ্ছিন্ন নয়

যে বস্তুটি জগতে সবচেয়ে বেশি গােমরাহীর পথ পরিষ্কার করেছে, তা হচ্ছে ইহ-পরকালের পৃথকীকরণ। দীনের কাজকে পৃথক করে নেয়া হয়েছে এবং দুনিয়ার কাজকেও পৃথক করেছে। আল্লাহর নির্দেশে ধন-সম্পদ লাভের পথ পৃথক করা হয়েছে এবং দীন অর্জনের পথ পৃথক। প্রিয় যুবকরা! জগতে যে সমস্ত বিভ্রান্তি বিস্তার লাভ করেছিল এর মধ্যে এটিই ছিল বৃহত্তম। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পয়গামের উজ্জ্বল কিরণ এ বিভ্রান্তি-জাল ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এ পয়গামই একথা বলেছে যে, আন্তরিকতা এবং সদুদ্দেশ্য সহকারে জগতের কার্যাবলি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সম্পাদন করাও দীন। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী দুনিয়াদারির নামই দীনদারী। লোকেরা মনে করে, যিকির-ফিকির করা, গৃহত্যাগ করে বৈরাগির জীবন-যাপন করা এবং পাহাড়ের গুহায় বসে আল্লাহকে স্মরণ করার নাম দীনদারি নয়। আর বন্ধু-বান্ধব, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা, দেশ-জাতি এবং নিজেকে সাহায্য ও প্রতিপালন করা এবং জীবিকার সন্ধান ও সন্তান পালন করা দুনিয়াদারি । ইসলাম এসব ভ্রান্ত ধারণারও বিলোপ সাধন করেছে এবং বলেছে যে, আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক এ অধিকারগুলো অর্জন করা এবং কর্তব্য পালন করা দীনদারিরই অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে দু’টি বিষয়ের ওপর নাজাত নির্ভর করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ঈমান এবং অন্যটি সৎকাজ। পাঁচটি বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার নাম হচ্ছে ঈমান ও আল্লাহর ওপর, সৎপথের সন্ধানদাতা নবিগণের ওপর, নবিগণের কাছে আল্লাহর পয়গাম আনয়নকারী ফেরেশতাগণের ওপর, আল্লাহর এ পয়গাম যে সমস্ত কিতাবে আছে সে কিতাবসমূহের ওপর, এ পয়গাম অনুযায়ী কাজ করা ও না করার পুরস্কার ও শাস্তির ওপর। এ পাঁচটি বিষয়ে বিশ্বাস রাখার নামই হচ্ছে ঈমান। এ ঈমানের ওপরই সৎকাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। কেননা এ ঈমানও বিশ্বাস ব্যতীত সঙ্কল্প এবং আন্তরিকতাসহ কোন কাজ সম্পাদন করা অসম্ভব। দ্বিতীয় বস্তুটি হচ্ছে সৎকাজ। অর্থাৎ আমাদের কাজ সৎ এবং উত্তম হওয়া উচিত।

ইতোপূর্বে আমার সপ্তম বক্তৃতায় উল্লেখ করেছি যে, কাজের তিনটি অংশ ও একটি হচ্ছে ইবাদত, অর্থাৎ যার দ্বারা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব এবং বান্দার বন্দেগী প্রকাশ পায়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যবহারিক জীবন, অর্থাৎ মানুষের পারস্পরিক লেন-দেন, কাজ-কারবার, দেশ পরিচালনা সম্পর্কিত আইন-কানুন ও সংবিধান, যার সাহায্যে মানব সমাজ ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তিলাভ করে এবং যুলুমের বিলোপ সাধন হয় ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৃতীয়টি হচ্ছে নৈতিক চরিত্র, অর্থাৎ এমন সব অধিকার যা পরস্পরের ওপর আইনগত দিক দিয়ে ফরয না হলেও আত্মার পূর্ণতা এবং সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। এ চারটি বস্তু অর্থাৎ ঈমান, ইবাদত, ব্যবহারিক জীবন এবং নৈতিক চরিত্রের সংশোধন ও যথার্থতাই আমাদের নাজাতের একমাত্র উসিলা স্বরূপ।

প্রিয় যুবকগণ! আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, নিসঙ্গতা, নির্জনতা, স্থবিরতা এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একক জীবন ইসলামে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম হচ্ছে সংগ্রাম, সাধনা, প্রচেষ্টা এবং কর্মতৎপরতার নাম। ইসলাম মৃত্যু নয়, জীবন। তাই কুরআনে বলা হয়েছে।

“প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ।” (সূরা আল মুদ্দাসসির : ৩৮)

ইসলাম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক অবিরাম প্রচেষ্টা- সাধনারই নাম। কিন্তু সে প্রচেষ্টা নির্জনে ঘরে বসে নয় বরং কাজের ক্ষেত্রে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবন আপনাদের সামনে রয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবনও আপনাদের সামনে বর্তমান, সাধারণ সাহাবাগণের জীবনও আপনাদের নাজাতের পথ নিহিত রয়েছে। তাঁদের জীবনও আপনাদের কল্যাণের মাধ্যম এবং আপনাদের আদর্শ। তাঁদের জীবনেও রয়েছে আপনাদের কল্যাণের মাধ্যম এবং আপনাদের উন্নতি ও সৌভাগ্যের সোপান। মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পয়গাম গৌতম বুদ্ধের পয়গামের ন্যায় কামনা-বাসনা পরিহারের শিক্ষা দেয় না। বরং কামনা-বাসনার পরিশুদ্ধি এবং তাকে যথার্থ রূপ দানের শিক্ষা প্রদান করে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পয়গাম হযরত ঈসার পয়গামের ন্যায় ধন-সম্পদ ও শক্তির প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ও নিষেধাজ্ঞা প্রদানের নাম নয় বরং এগুলো অর্জন ও ব্যয়ের পদ্ধতিসমূহ সংশোধন ও তাদের যথার্থ ব্যবহার ও ব্যয়ের ক্ষেত্রকে নির্ধারণ এ পয়গামের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

বন্ধুগণ! ঈমান ও সে অনুযায়ী সৎকাজের নাম হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম হচ্ছে কর্ম, কর্ম পরিহার নয়। ইসলাম হচ্ছে কর্তব্য সম্পাদন, কর্তব্য পরিহার নয়। এ কর্ম ও কর্তব্যসমূহের ব্যাখ্যা আপনাদের নবী ও তাঁর সহচরগণের জীবনচরিতে পাওয়া যাবে। এর চিত্র এরূপ:

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল আর যারা তাঁর সহচর, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে অতিশয় কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি করুণাশীল। তুমি তাদেরকে দেখবে যে, তারা রুকু-সিজদায় রত, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি সন্ধান করছে।’ (সূরা আল ফাতহ : ২৯)।

তারা সত্য অস্বীকারকারীদের সাথে জিহাদ করছে, পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালবাসা বজায় রেখেছে, আল্লাহর সামনে রুকুতে ঝুঁকে আছে এবং সিজদায় নত আছে। আবার জগতে আল্লাহর অনুগ্রহ এবং সন্তুষ্টিরও সন্ধান করছে। কুরআনের পরিভাষায় আল্লাহর অনুগ্রহ (ফযল) বলা হয় রিযক এবং জীবিকাকে। এ রিযক এবং জীবিকার বেলায়ও দীনের দাবি রয়ে যাচ্ছে।

এরা এমন লোক যাদেরকে ব্যবসায় এবং বেচাকেনা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না।’ (সূরা আন নূর : ৩৭)।

ব্যবসায়, বেচাকেনা, কাজ-কারবার সব জারি আছে, আবার আল্লাহকে স্মরণ করাও হচ্ছে। তারা একটিকে ত্যাগ করে অন্যটির সন্ধান করে না, বরং উভয়ের সন্ধান একই সাথে করে।

মুসলমান এবং রোমীয়দের যুদ্ধ চলছে। মুসলিম বাহিনীর সেনারা হচ্ছেন সাহাবায়ে কিরাম! রোমান সেনাপতি মুসলিম সিপাহীদের অবস্থা জানার জন্য মুসলমানদের শিবিরে গুপ্তচর পাঠায়। তারা এসে মুসলমানদের দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে ফিরে যায়। রোমান সেনানায়কের কাছে তারা এ তথ্য প্রদান করে যে, মুসলমানরা অদ্ভুত সিপাহী- তারা রাতে সংসার ত্যাগী এবং দিনে ঘোড়-সওয়ার।’ ইসলামের প্রকৃত জীবন হচ্ছে এটাই।

বন্ধুগণ! আজ আমার বক্তৃতা সমাপ্তির শেষ দিন। মনে করেছি, আটটি বক্তৃতায় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবন চরিত এবং পয়গাম সম্পর্কে সবকিছুই উত্থাপন করে জানতে সক্ষম হব, কিন্তু আটটি বক্তৃতার পরও এখনো অনেক কিছুর আলােচনা রয়েই যাচ্ছে এবং যা কিছু করেছি তাও যৎসামান্যই বলা চলে। কিন্তু সে আশা আর পূরণ করা সম্ভব হলো না।
প্রবন্ধটি আল্লামা সুলায়মান নদভী (রহ:)’র পয়গামে মোহাম্মদী গ্রন্থের একটা খণ্ডাংশ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button