লিবিয়ার কারাগারে ২৮০ জন

ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকালে প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশীরা

দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে জিম্মি জীবন যাপন করছেন

ফয়সল মাহমুদ, স্পেন থেকে ফিরে: ভাগ্য বদলানোর আশায় অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে প্রান হারাচ্ছে বাংলাদেশীরা। আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে নৌ পথে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর কিংবা আর্টলানন্টিক মহা সাগর স্পিড বোড কিংবা ট্রলার দিয়ে পাড়ি জমানোর সময় সলিল সমাধি হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। আবার আফ্রিকার দেশ মরোতানিয়া রটে সাহারা মরূভূমি হয়ে পর্তুগাল ঢোকার চেষ্টাকালে সাহারা মরুভূমির দূর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনাহারে অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরমধ্যে অনেকে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্ধিজীবন কাটাচ্ছেন। আবার দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে জিম্মি জীবন যাপন করছেন। মুক্তির জন্য দেশ থেকে ভিটে মাটি বিক্রি করে টাকা পয়সা দিয়েও মিলছেনা তাদের মুক্তি। বর্তমানে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় লিবিয়ার কারাগারে ২৮০জন বাংলাদেশী নাগরিক বন্ধি রয়েছেন। লিবিয়াস্থ বাংলাদেশের রাষ্টদূত শেখ সেকান্দর আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন।

ইউরোপের অন্যতম প্রবেশদ্বার স্পেন সফর করে করে বিভিন্ন দালালদের মাধ্যমে স্পেনে যারা এসেছেন তাদের সাথে আলাপকালে জানাযায়, বর্তমানে মানব পাচারকারী দালাল চক্ররা এখন ইউরোপের ঢোকার জন্য যুদ্ধ বিধস্ত লিবিয়াকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দালালদের মাধ্যমে আসা বেশির ভাগ বাংলাদেশীরা চেষ্টা করেন লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিস কিংবা ইতালিতে অনুপ্রবেশের। লিবিয়া থেকে দালাল মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে প্রান হারাচ্ছেন। লিবিয়া থেকে দালালরা স্পিড বোডে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে মানব পাচারের চেষ্টা করে থাকে।

লিবিয়া হয়ে গ্রিসে আসা আফজাল জানান, রাতের আধারে দালালরা একটি স্পিড বোডে ২০ জন যাত্রী দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসে তাদের অনুপ্রবেশ করায়। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ভূমধ্যসাগরে মধ্যে স্পিড বোডটি গ্রিসের দিকে ছুটতে থাকে। গভীর রাত সাগরের উত্তাল গর্জন আর বর্ডার গার্ডদের চোঁঙ রাঙানি সব মিলিয়ে ৩ ঘন্টার নৌ পথটি আমার কাছে একটি বিভিষিকাময় রাত ছিল। স্পিড বোডটি যখন মধ্য সাগরে অবস্থান করছিল তখন ঝড়ের কবলে পড়ে। প্রচন্ড ঝড়ে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিড বোডটি বারবার সাগরের পানির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আবার কখনোও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট উপরে। আমরা সবাই কালেমা পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। এরকিছুক্ষন পর ঝড় থামলে আমাদের স্পিড বোডটি ঝড়ে গন্তব্য হারিয়ে বর্ডার গার্ডের হাতে ধরা পড়ে। আমিসহ সবাই আমরা লিবিয়ার কারাগারে বন্ধি জীবন যাপন করি ৫ মাস।

ইউরোপে ঢোকার আরেক পথ হলো আলজেরিয়া থেকে মরোতানিয়া হয়ে সাহারা মরুভুমি পর মরক্কো হয়ে পর্তুগাল। এই রুটের সবচেয়ে ভয়ানক পান্তর হলো সাহারা মরভূমি। এই সাহারা মরুভুমি পায়ে হেটে পাড়ি দিতে হয়। সাহারা মরুভুমি পায়ে হেটে পাড়ি দিতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যায়।

দালালদের মাধ্যমে স্পেনে আসা সিলেটের ইমরান জানান, তিনি যে স্পিড বোড দিয়ে লিবিয়া থেকে তুরস্ক এসেছিলেন সেই স্পিড বোডের ১৯ জন যাত্রীর মধ্যে ২জন স্পিড বোডে মারা যান । তাদের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও কানাইঘাটে। তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া থেকে যখন স্পিড বোডটি যাত্রা শুরু করে তখন রাতের আধারে তুরস্ক পৌছানোর চেষ্টা থাকে। তাই প্রচন্ড স্পিডে, স্পিড বোডটি চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের স্পিড বোডটি তুরস্কের কাছাকাছি আসতে আইনশৃংখলা বাহিনীকে দেখে আচমকা গতি থামায়। ফলে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় ধরে প্রচন্ড গতিতে চলতে থাকা স্পিড বোডটির যাত্রীদের মধ্যে বমি শুরু হয়। বমি করতে করতে এরমধ্যে দুজনের অবস্থা বেগতিক হলে তাদের স্পিড বোডে মৃত্যু হয়। সবচেয়ে কষ্টদায়ক ছিল বাংলাদেশী মৃত দুজনের লাশ দালালরা ভূমধ্যসাগরে নিক্ষেপের দৃশ্য দেখে। আমরা এর প্রতিবাদ করলে দালালরা জানায় বেশি চেচামেচি করলে সবাই গ্রেফতার হয়ে জেল কাটতে হবে। তাই আর কেউ প্রতিবাদ করেনি।

ইউরোপে ঢোকার আরেক পথ হলো আলজেরিয়া থেকে মরোতানিয়া হয়ে সাহারা মরুভুমি পর মরক্কো হয়ে পর্তুগাল। এই রুটের সবচেয়ে ভয়ানক পান্তর হলো সাহারা মরভূমি। এই সাহারা মরুভুমি পায়ে হেটে পাড়ি দিতে হয়। সাহারা মরুভুমি পায়ে হেটে পাড়ি দিতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যায়। এক সপ্তাহের পায়ে হাটার পথে পানাহারের জন্য দু‘বোতল তরল পানি ছাড়া আর কিছু বহন করতে দালাল চক্র নিরাপদ মনে করেনা। দালালরা যাত্রীদের তাড়াতাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সাহারা মরুভুমিতে যখন যাত্রীরা পথ পাড়ি দিতে রওয়ানা হন তখন তাদের অনুসরন করতে থাকে অন্য দালাল সদস্যরা। আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকে দূর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়াস। অনেক সময় এই পথ এক সপ্তাতে শেষ হয় আবার পথে ঝামেলা হলে বিলম্ব হয়। যাত্রাপথে পানি শেষ হলে শুরু হয় যাত্রীদের আর্তনাদ। প্রচন্ড গরম আর তৃষ্ণার্ত প্রাণ খাদ্যের জন্য হাহাকার করতে করতে শেষ নি:শাস ত্যাগ করে। আর যারা সাহারা মরুভ’মি পাড়ি দিতে পারেন তারা মরক্কোতে পৌছান। সেখানে শুরু হয় দিন গুনা কবে ঢুকতে পারবেন পর্তুগাল কিংবা স্পেনে।

এদিগে দালালদের মাধ্যমে যারা ইউরোপে ঢুকতে পেরেছেন তাদের মাথা গোজার জন্য জীবন যুদ্ধে নামতে হয়। প্রথমে তাদের বাসস্থানের জন্য পরিচিত জনদের কাছে ধরনা দিতে হয়। বাসস্থানের পর কাজের জন্য মিথ্যে চেষ্টা করতে হচ্ছে। ইউরোপের যে কোন দেশে যেমন স্পেন, ফ্রান্স ইতালী কিংবা পর্তুগালে কাজের পারমিট ছাড়া কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। যারা অ্যাসাইলাম কিংবা হিউম্যান রাইটসে থাকার জন্য আবেদন করেন তাদের আবেদন বিবেচনা কিংবা আমলে নিতে প্রায় ৮ মাস সময় লেগে যায় । কোন কোন দেশে কোন ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় লাগে। আবেদন গ্রহনের আগ পর্যন্ত প্রত্যেকে মানবেতর জীবন যাপন করে থাকেন। আবেদন গ্রহন হলে কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন। যা দিয়ে তাদের হাত খরচ নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু কাজের পারমিট পাওয়ায় আগ পর্যন্ত তাদের অনেকে রাস্তায় ফুল, ঘড়ি বিক্রি কিংবা লিফলেট বিতরন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আবার যারা ইউরোপের যেকোন এক দেশের কাগজ যদি পেয়ে যান তাদের জন্য সমস্ত ইউরোপ উন্মুক্ত (ইংল্যান্ড ছাড়া)।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া ইউরোপ পর্যন্ত দালালদের একটি শক্তিশালী নেটওর্য়াক রয়েছে। তারা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে বেশি সক্রিয়। তারা প্রতারনার মাধ্যমে মানব পাচারের সাথে জড়িত। তাদের প্রতারনা শিকার হয়ে অনেকে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে নি:স্ব হয়েছেন। অনেকে প্রান হারিয়েছেন। আবার কেই কেউ আইনশৃখংলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কারাগারে বন্ধি জীবন যাপন করছেন।

দালালদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে দীর্ঘ পাচ মাসে স্পেনে আসা সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সুমন জানান, দাললারা আমার সাথে চুক্তি করে ১ মাসের মধ্যে ৮ লাখ টাকায় স্পেনে পৌছানোর। তারা আমাকে বলে লিবিয়া হয়ে খাল পাড়ি দিয়ে তুরস্কে হয়ে তারা আমাকে স্পেনে পৌছে দিবে। সেই জন্য মধ্যস্থকারীর কাছে অগ্রিম ৮ লাখ টাকা রাখা হয়। লিবিয়া আসার পর দালালরা সেই ৮ লাখ টাকা মধ্যস্থকারীর কাছ থেকে তুলে নেয়। পরে আমাকে জিম্মি করে তারা আমার পরিবারের কাছে আরো ৪ লাখ টাকা দাবী করে। পরিবার বাধ্য হয়ে দালালদের হাতে আরো ৪ লাখ টাকা তুলে দেয়। এর পরেও দালালরা আমাকে লিবিয়ায় প্রায় ৪ মাস অনাহারে অধাহারে রাখে। আমি দালালদের কাছে আমাকে স্পেন পৌছানোর তাগিদ দিলে তারা আমার সাথে নানা টালবাহানা শুরু করে। পরে তারা আমাকে চার দফা চেষ্টার পর স্পিড বোডে ভূমধ্যসাগর নৌ পথে পাড়ি দিয়ে আমাকে তুরস্কে পৌছায়। অথচ তারা আমাকে বলেছিল লিবিয়া থেকে একটি খাল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক ঢোকে সেখান থেকে তারা আমাকে স্পেনে পৌছে দিবে। তিনি জানান সাগর যাদের কাছে খাল মনে হয় সেই সকল দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেকে সেই খাল নামক সাগরে প্রান হারাচ্ছেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া ইউরোপ পর্যন্ত দালালদের একটি শক্তিশালী নেটওর্য়াক রয়েছে। তারা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে বেশি সক্রিয়। তারা প্রতারনার মাধ্যমে মানব পাচারের সাথে জড়িত।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে লিবিয়ায়। কিন্তু বর্তমানে লিবিয়া হয়ে ইউরোপের চেষ্টাকালে ২৮০ জন বাংলাদেশী নাগরিক লিবিয়ার কারাগারে বন্ধি রয়েছেন। তারা চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সুদান,মিশর, আলজেরিয়া, মরোতানিয়া, মরক্কো থেকে লিবিয়ায় সাগর পথ পাড়ি দেওয়ার সময় আইনশৃংকলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃত কারো কাছে লিবিয়ার ভিসা ছিলোনা। লিবিয়াস্থ বাংলাদেশের রাষ্টদূত শেখ সেকান্দর আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে স্পেনে অবৈধ অভিবাসিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন এসোসিয়েশন বালিয়েন তো বাংলার সভাপতি ফজলে এলাহি বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে ঢোকার জন্য দালালরা স্পেনকে বেচে নেয়। ফলে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে অনেকে গ্রেফতার হয়ে বন্ধি জীবন কাটাচ্ছেন। আমি বলবো দালালদের মিথ্যে আশ্বাসে অবৈধ পথে না এসে সেনজিন ভিসা নিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। আশার কথা আগামীতে স্পেনে এগ্রিকালচার ভিসা চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাগর পথে আসতে গিয়ে আপনারা আপনার মায়ের বুক খালি করবেন না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button