মৃদু চোখ মেলে বললেন,‘ শরীর ভাল না’

কেমন কাটছে কবি আল মাহমুদের দিনকাল

নিজ কাব্যে উল্লেখ করা মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে’র মত কবির জীবন আচরণ সম্পূর্ণ বদলে নিস্তরঙ্গ সরোবরে রূপ নিয়েছে

তিনি ঘুমিয়ে আছেন। কোন অস্থিরতা – হাঁক ডাক নেই। গল্প,কাব্য, উপন্যাস তৈরির তাড়াও আর নেই। দিনরাত ঘুমের ঘোরেই কেটে যায়। কখন রাত আসে দিন হয় এনিয়ে তেমন কোন ভাবনা নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম-সাময়িক বিষয়াদি নিয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়াম আলোচনা সভায় ঝাঁঝালো বক্তৃতা রাখা কিংবা কাব্যাঙ্গনে ঝড় তোলা পংক্তি নিয়ে তিনি আর হাজির হতে পারেন না। পারিবারিক পরিমন্ডলেই দিবস যামিনী যাপন করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ। বার্ধক্য তাকে বাকরুদ্ধ ও স্থবির করে দিয়েছে। নিজ কাব্যে উল্লেখ করা “মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে’র মত কবির জীবন আচরণ সম্পূর্ণ বদলে নিস্তরঙ্গ সরোবরে রূপ নিয়েছে ।

১১ জুলাই কবি আল মাহমুদ ৮৪ বছরে পা দেন। তারপর থেকে গত দেড় মাসে কবির শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এখন শয্যাশায়ী অবস্থায়ই তার সময় কাটে। বেশ ক’বছর আগেই তিনি বিপত্নীক হয়েছেন। মঙ্গলবার বড় মগবাজার ওয়ারলেস মোড়ের ‘গোমতী-আয়েশা’ ভিলায় কবির বাসায় গেলে বার্ধক্য পীড়িত কবিকে অত্যন্ত অসহায় মনে হচ্ছিল। তিনি বাকরুদ্ধ প্রায়। চোখের জ্যোতি কমেছে আরো আগেই।

তার প্রখর স্মৃতি শক্তি এখন শুধুই স্মৃতি। কবির বড় ছেলে শরীফ মাহমুদ বললেন, ‘আব্বার অবস্থা ভাল নয়। এখন প্রায় সময় শুয়েই কাটে তার।’ শরীফ মাহমুদ বলছিলেন,কিছুদিন হলো খাওয়া দাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। সামান্য আহার গ্রহণেও অনীহা। এমনকি আজকাল তরল খাবার গিলতেও অসুবিধা হচ্ছে। কবির জ্যেষ্ঠপুত্রবধু যোগ করলেন, অল্প একটু তরল জাতীয় খাবারও তিনি নিজ থেকে গ্রহণ করতে পারেন না। এতে করে দিনকে দিন তার শারিরীক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এ প্রতিবেদক কিছুক্ষণ শয্যাপাশে গেলে তিনি ঈষৎ চোখ মেলে তাকান। কবির বড় ছেলে তাকে ধরে বসিয়ে দেন। আধশোয়া কবির কানের কাছে কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন,‘শরীর ভাল না।’ আমায় চিনতে পেরেছেন? কিঞ্চিৎ মাথা নেড়ে আর কোন শব্দ করেননি তিনি।

কবি আল মাহমুদের নিয়মিত পারিবারিক চিকিৎসক ইবনে সিনা হাসপাতালের নিউরো মেডিসিনের প্রফেসর আবদুল হাইকে উদ্ধৃত করে শরীফ মাহমুদ জানান, গত মাসে আব্বাকে চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়েছিলো। তিনি বলেছেন, বার্ধক্য ছাড়া তার শারিরীক তেমন কোন সমস্যা নেই। খাওয়া দাওয়া আর শুশ্রুষার উপদেশ ছাড়া তেমন কোন ওষুধ দেননি তিনি। নিয়মিত যেসব ওষুধ সেবন করতেন সেগুলোই চালিয়ে যেতে বলেছেন। কবির পারিবারিক সূত্র জানিয়েছেন, এখন তাঁর যে অবস্থা তাতে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। তারাও সেটা ভাবছেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে এ ব্যাপারে সাহসী হচ্ছেন না।

কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল। সারাজীবন তিনি লিখেছেন। তাঁর কাব্য প্রতিভা তাকে খ্যাতির শীর্ষে বসিয়েছে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ’৭১ এর রণাঙ্গনের কাহিনী যেমন লিখেছেন তেমনি দেশ বিভাগের করুণ অধ্যায় তুলে ধরেছেন নিজের উপন্যাসে।

তার শিশুতোষ সাহিত্যও দুই বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়। বাংলাদেশের লোকজ প্রকৃতি,প্রেম-বিরহ যেমন তাঁর গল্প-কাব্য সাহিত্যে স্থান পেয়েছে ঠিক তেমনি বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও কখনো আপোস করেননি। কবি ও সাংবাদিক হিসাবে সমধিক পরিচিত হলেও আধুনিক কথা-সাহিত্যে তিনি অনন্য এক উচ্চ আসন লাভ করেছেন। কবি লিখেছেন “সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলির কূলটায়-দুধভরা ওই চাঁদের বাটি ফেরেশতারা উল্টায়।” তিনি সব সময় বলেছেন, কবিরা স্বপ্ন দেখায়-বেঁচে থাকার সাহস জোগানো একজন কবির বড় কাজ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button