তুরস্কের লিরা ও ইউরোপের সমস্যা

মার্কিন জাজকের ব্যাপারে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আসলে কতটা ধর্মীয় কারণে তা প্রশ্নাতীত

আহমেদ শরীফ: তুরস্কের লিরার জন্ম ১৯২৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফতের ধ্বংসের পর মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে নতুন রাষ্ট্র তুরস্কের মুদ্রা হিসেবে লিরাকে নেয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত তুরস্কের মুদ্রা স্বর্ণভিত্তিক হলেও নতুন মুদ্রাকে পশ্চিমা মুদ্রার সঙ্গে ব্যালান্স করে এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ১৯৩৩ সাল থেকে লিরার দরপতন শুরু হয়। তখন এক ডলারে দুই লিরা পাওয়া যেত। দরপতনের পর থেকে আর থামেনি। ২০০১ সাল নাগাদ এক ডলারের সমমূল্য দাঁড়ায় সাড়ে ১৬ লাখ লিরা! আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ‘আইএমএফ’-এর চাপে দরপতন গতি পায়। ২০০২ সালে বুলেন্ট এচেভিত সরকারের পতন হয় এবং এরদোগানের আবির্ভাব হয়। এরদোগানের সরকার লিরা-ডলারের মূল্যের মাঝ থেকে ছয়টা শূন্য বাদ দেয়ার ঘোষণা দেন। অর্থাৎ রাতারাতি লিরার বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় এক ডলারে ১ দশমিক ৭৯ লিরা! এই নতুন মূল্য বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি। এরপরেও লিরার দরপতন রোধ করা যায়নি। ২০১৩ সাল থেকে আবারও দরপতন শুরু হয়। ২০১৪ সালে একবারে ৩০ শতাংশ মূল্য হারায় লিরা। ২০১৮-এর শুরুতে লিরার যা মূল্য ছিল, ছয় মাসের মধ্যে তার ২১ শতাংশ মূল্য হারিয়ে যায়। এরপর নতুন সমস্যা এসে হাজির হয় যখন এ বছরের ২৬ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তুরস্কে আটক মার্কিন জাজক এন্ড্রু ব্রানসনের মুক্তির দাবি মানলে তাদের ওপর অবরোধ দেয়ার হুমকি প্রদান করেন। ফলে মুদ্রাবাজারে লিরার দরপতন ত্বরান্বিত হয় এবং জুলাইয়ের শেষে লিরার বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় এক ডলারে ৪ দশমিক ৯১ লিরা।

মার্কিন সরকারকে অবরোধ আরোপ করা থেকে বিরত রাখতে তুর্কি উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ৭ আগস্ট ওয়াশিংটন ছুটে যান। জাজকের ব্যাপারে সমঝোতা না হওয়ায় তিন দিন পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্ক থেকে আমদানিকৃত স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যথাক্রমে ৫০ ও ২০ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা দেন। ঘোষণার সাথে সাথে ডলারপ্রতি লিরার মূল্য দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২৪। বছরের শুরুর মূল্য থেকে এই মূল্য ৪০ শতাংশ কম। এখানে পরিষ্কার ব্যাপারটি হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের কারণেই তুর্কি লিরার পতন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মার্কিন জাজকের ব্যাপারে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আসলে কতটা ধর্মীয় কারণে তা প্রশ্নাতীত। কারণ এই জাজককে তুর্কিরা গ্রেফতার করে ২০১৬ সালের অক্টোবরে। তাহলে দুই বছর পর কেন ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কের ওপর অতটা কঠোর হলো?

তুর্কি ট্রেজারি বিভাগ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দেয়, দেশটির আন্তর্জাতিক ঋণের স্থিতি দাড়িয়েছে ৪৩৮ বিলিয়ন ডলারে। এবছরের মার্চে তুর্কি ট্রেজারি উপদেষ্টা বলেন, তুরস্কের ঋণের স্থিতি ৪৬৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। তুর্কি সরকার ২০১৮ সালে ১১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা করছে। মজার ব্যাপার হলো, তুরস্কের এ বিশাল অঙ্কের ঋণ সরকারের নেয়া ঋণ নয়। গত এক দশকে এরদোগান সরকার বড় বড় প্রকল্পের অর্থায়নের ক্ষেত্রে নতুন নীতিতে যায়। এ নীতি অনুযায়ী বেসরকারি কোম্পানিগুলি প্রকল্পের অর্থায়নের ব্যবস্থা করে নেয়; সরকার এক্ষেত্রে দায় নেয়নি। কিন্তু ঋণ বেসরকারি হলেও তুরস্ক থেকেই সে ঋণ পরিশোধ করা হবে, তা অনেকেই ভাবেননি। সংবাদমাধ্যম ‘ফিন্যানশিয়াল টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্পেনের ব্যাংকগুলি তুরস্কে সর্বোচ্চ ৮২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এরপর রয়েছে ফরাসি ব্যাংক (৩৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন) ও ইতালীয় ব্যাংক (১৭ বিলিয়ন)। তুরস্কের অর্থনীতির সাথে সাথে ফ্রান্সের ‘বিএনপি পারিবা’, স্পেনের ‘বিপিএ’ এবং ইতালির ‘ইউনিক্রেডিট’ ব্যাংকের শেয়ারের দর ৩ শতাংশ পড়ে গেছে। তুরস্ককে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো ২২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এ ঋণ ফেরত দিতে অনেকেই এখন তুর্কি সরকারের সহায়তা চাইছেন।
উপরন্তু তুরস্কের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই। দেশটির শুল্ক মন্ত্রণালয়ের হিসেবে জানুয়ারির শুরুতে সেই ঘাটতি গিয়ে দাঁড়ায় ৭৭ বিলিয়ন ডলারে। এ ঘাটতি তুরস্ককে মেটাতে হবে নিজস্ব কফার থেকেই। একই সময়ে তুরস্কের স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস ঘোষণা দেয়, দেশটার মুদ্রাস্ফীতি ১৫ দশমিক ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে! অর্থনীতির এ ঋণাত্মক সংখ্যাগুলোর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবছরের ১৩ মার্চ ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ‘মুডিস’-এর রেটিং তুরস্ককে নিচে নামানোর মধ্য দিয়ে। ২ মে রেটিং এজেন্সি ‘স্ট্যাডার্ড অ্যান্ড পুরস’ও তুরস্কের রেটিং নামিয়ে দেয়। এতে তুরস্কে ব্যাপক বিনিয়োগ করা ঋণদাতারা তাদের ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তায় পড়েন। অ্যাসোসিয়েশন অব জার্মান চেম্বার্স অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্সের ঘোষণায় বলা হয়, তুরস্কের সঙ্গে ব্যবসারত ৬ হাজার ৫০০ কোম্পানি দেশটির অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বিপদে পড়েছে। এটা পরিষ্কার যে, তুরস্কের সমস্যা এখন সমগ্র ইউরোপের সমস্যা।

সংবাদ মাধ্যম ‘আল-ইউম আস-সাবি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হচ্ছে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যেখানে বছরে তারা ১৫৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের রফতানি তার মোটা রফতানির তুলনায় কিছুই নয়। তাহলে তুরস্কের ওপর ট্রাম্প সরকারের শুল্ক আরোপ এর গুরুত্ব কোথায়? লক্ষ করলে দেখা যাবে, ট্রাম্প ঠিক ওই সময়েই জাজকের ইস্যুটাকে সামনে এনেছেন, যখন তুরস্কের ঋণের স্থিতি, বাণিজ্য ঘাটতি এবং লিরার পতন একত্রে খারাপ দিকে ছুটছিল। আর আগুনে ঘি ঢালার মতো ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো তুরস্কের রেটিং নামিয়ে দিচ্ছিল। ট্রাম্পের চোখ মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে, যেখানে কট্টরপন্থী খ্রিস্টানদের ভোট তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে লিরার দরপতন এখন ইউরোপের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই এখন চোখ রাখবেন ডলার-ইউরোর বিনিময় হারের দিকে। তুরস্কের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের যুদ্ধের মূল ভুক্তভোগী হতে যাচ্ছে ইউরোপ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button