ঈদ সংখ্যা ও ঈদ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে

সেহরি, ইফতার, তারাবি সব মিলিয়ে একটা ধর্মীয় আবহের মধ্যে কেটে গেছে পুরো রমযান মাস। এরপর আকাশে উদিত হলো কাক্সিক্ষত শাওয়ালের চাঁদ। টিভি পর্দায় বেজে উঠলো ঈদের গান :  ও মন রমযানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ …। আমাদের ঈদ তো অবশ্যই খুশির ঈদ, তবে খুশির বাইরেও ঈদের রয়েছে বহুমাত্রিক বার্তা। ঈদের খুশির সাথে জড়িয়ে আছে ত্যাগ, সংযম এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণের আকাক্সক্ষা। আমাদের এই জনপদের মানুষের জীবনে ঈদের মর্মবাণীর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়, বিপরীত চিত্রও দৃষ্টিগোচর হয়। মানব সমাজে স্ববিরোধী আচরণ নতুন কিছু নয়, ভুলত্রুটিও কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এ কারণেই একটি প্রাণবন্ত সমাজে লক্ষ্য করা যায় সংস্কার ও সংশোধনের কাজ। এমন কাজে প্রয়োজন হয় শ্রম, ধৈর্য ও যথার্থ জ্ঞানের। আমাদের সমাজে রমযান এবং ঈদের  মর্মবাণী ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে আলেম-ওলামা, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পবিত্র রমযান মাসে আমরা তেমন ভূমিকা কিছুটা লক্ষ্য করে থাকি। কিন্তু ঈদের চাঁদ ওঠার পর আমাদের মিডিয়ার যেন কিছু একটা হয়ে যায়।
ঈদকে কেন্দ্র করে যে ঈদ সংখ্যাগুলো বের করা হয়, কিংবা ঈদকে কেন্দ্র করে টিভি চ্যানেলগুলোতে ছয়-সাতদিনব্যাপী যে ঈদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাতে না থাকে ঈদের বার্তা, না থাকে রমযানের শিক্ষাদীক্ষা। দু’একটি  ব্যতিক্রম ছাড়া ঈদ-সংখ্যা ও ঈদ অনুষ্ঠানে রমযান ও ঈদকে সতর্কভাবে পরিহার করার বিষয়টিকে বেশ পরিকল্পিত বলেই মনে হয়। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বাংলাদেশে ইসলামী জীবনবোধ ও মুসলিম সংস্কৃতি বিরোধী যে ষড়যন্ত্র চলছে, ঈদ সংখ্যা ও ঈদ-অনুষ্ঠান যেন তারই উৎকট উদাহরণ। এখানে বিনোদনের নামে দৃষ্টিকটু অনেক কিছু লক্ষ্য করা গেলেও রমযান ও ঈদের পবিত্রতা ও সৌরভ লক্ষ্য করা যায় না। বরং কোনো কোনো অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়, রমযানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের মনে যে সংযম, নৈতিকতা ও পাপ-পুণ্যবোধের সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করে বল্গাহীন প্রবৃত্তির অনুসারী করে তোলাই যেন ঐসব অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসব তৎপরতা দেখে কিছুদিন আগে একজন লেখক লিখেছিলেন, রমযানে মানুষের মনে যে খোদাভীতি ও নৈতিকতাবোধের সৃষ্টি হয়, ঈদ অনুষ্ঠানের বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে তা দূরীভূত করার প্রয়াসই যেন এখন আমরা লক্ষ্য করছি। তাই ঈদ অনুষ্ঠানের নামে এমন অপতৎপরতা কোনো মুসলিম প্রধান দেশে চলতে পারে না।
বাংলাদেশে ঈদকে কেন্দ্র করে যেসব ঈদ সংখ্যা প্রকাশ কিংবা ঈদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে তা ঈদের মর্মবাণীর সাথে বেমানানÑ এমন সমালোচনা আমরা সহজেই করতে পারি। কিন্তু শুধু সমালোচনার গুণে ঈদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কাক্সিক্ষত ঈদ-সংখ্যা বা ঈদ-অনুষ্ঠান পাওয়া যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন উদাহরণ সৃষ্টি। কিন্তু উদাহরণ সৃষ্টি কারা করবেন? কথায় বলে, যার কাজ তারেই সাজে। কামারের কাজ কুমার পারে না, শিল্পীর কাজ আলেম পারে না। ঈদ-সংখ্যার কাজ তো ঈদের বেশ আগেই সম্পাদকের পরিকল্পনায় সহযোগী সাংবাদিকরা শুরু করে থাকেন। আর টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রধানের পরিকল্পনায় ঈদের বেশ আগে থেকেই  বিভিন্ন প্রযোজক ঈদ-অনুষ্ঠান নির্মাণের কাজে  লেগে যান। কিন্তু প্রশ্ন হলো পত্রিকার কোনো সংখ্যা প্রকাশ কিংবা টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠান নির্মাণের আগে তো থিম নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়ে থাকে, কিন্তু পত্রিকার ঈদ-সংখ্যা ও টেলিভিশনের ঈদ-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঈদ বা রমযানের থিম লক্ষ্য করা যায় না কেন? ঢাউস ঈদ-সংখ্যা কিংবা সপ্তাহব্যাপী ঈদ-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কাক্সিক্ষত থিমের অনুপস্থিতিকে সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। মহান আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী রোজাকে ফরয করেছেন  এবং উপহার হিসেবে ঈদ দিয়েছেন সে উদ্দেশ্যকেই যদি এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে ভ্রষ্ট ভাবনার ঈদ-সংখ্যা ও ঈদ অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন আছে কি আমাদের? বিষয়টি নিয়ে আমাদের সম্পাদকবৃন্দ এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠান-প্রধানদের শুধু ভেবে দেখা নয়, আত্মসমালোচনা করাও এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কারণ ভ্রষ্টাচারে যেমন প্রগতি নেই, বিনোদন নেই, তেমনি মহান ¯্রষ্টার আলোকিত পথের বাইরে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় স্বার্থেই এসব বিষয়ে আমাদের সঙ্গত ভাবনায় সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button