শরতের স্নিগ্ধ মায়াবী প্রকৃতি যেন কাশফুলের নরম ছোঁয়া

মুহাম্মদ নূরে আলম: ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। দুই মাস পর পরই আমাদের দেশে ঋতুর পরিবর্তন হয়। এই ঋতু পরিবর্তনে এখন বইছে শরৎকাল। আর প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় শরতের আগমনী বার্তা। শরতের বিকালে নীল আকাশের নিচে দোলা খায় শুভ্র কাশফুল। প্রকৃতির পালা বদলের খেলা এখন চলছে শরতের মাঝামাঝি সময়। কিন্তু বিদেশের মাটিতে থাকা প্রত্যেক বাঙালিই শরতকে খুব মিস করে। এখন বাংলাদেশের চারদেয়ালের বাইরে প্রকৃতিতে চোখ রাখলে ধরা পড়ে শরৎ-প্রকৃতির মোহনীয় রূপ। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি, নদীর ধারে কিংবা গ্রামের কোনো প্রান্তে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া শুভ্র কাশফুলের স্নিগ্ধতা, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় অঝোরধারায় শ্রাবণ ঢলের পর আসে শরতের রৌদ্রছায়ার খেলা- এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ। আরও থাকে বিল ও ঝিলের পানিতে শাপলা শালুক ফুলের সুন্দর মায়াবী দৃশ্যের সমারোহ। গত সোমবার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, বাসাবোর আমনি মুহাম্মদ ইউজিং প্রকল্প মাঠ, উত্তরার দিয়াবাড়ি, পূর্বাচল এলাকায় শরতের এমনই শুভ্র কাশফুলের দেখা মিলে খোদ রাজধানী ঢাকাতে।

শরতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার রাত্রি ভালোলাগা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। শরতকালেই সকাল বেলায় কুয়াশা পড়া শুরু হয়। শরতের সকাল বেলার কুয়াশা মাড়িয়ে খালি পায়ে চলতে কার না মন চাই। সে এক আনন্দময় সুখকর স্মৃতি। সেই সাথে কুয়াশার উপরে যখন সকালের সোনালী রবির আলো এসে পড়ে তখন শিশির বিন্দু মুক্তার দানার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সেই দৃশ্য আরও চমৎকার। দখিনের সমীরণ খুলে শরতের নির্মল স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের আলো সবার কন্ঠকেই সুরময় করে তুলে। এই তো সময় মন আমার হারিয়ে যাওয়ার।

এছাড়াও মাঠে মাঠে বর্ষার সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানির মুগ্ধতা। আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও খুশি। শরতের শান্ত বিলের পানিতে যেন আকাশের মেঘ বালিকা নেমে এসেছে। বিলের পানিতে আকাশের মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানোর প্রতিচ্ছবি দেখে কার না মন আনন্দে নেচে উঠে। সেই সাথে যদি বাতাসে ভেসে আসে শাপলা শালুক ফুল ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের মৌ মৌ সুবাসিত গন্ধ মন ভালো না হয়ে পারে কি। এমনই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে আপনার মন ফিরে আসতে মানা করবেই। শত কাদাময় মনে কে মুহূর্তের মধ্যেই পবিত্র কোমল নির্মল স্বচ্ছ মন তৈরী করতে পারে শরৎ এমনটাই মনে করেন বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি সাহিত্যিক। আর তাঁরা প্রাণভরে লিখেছেন শরত নিয়ে বাংলা কবিতা। কবির পড়ক্তিমালা হয়েছে শরৎ সিক্ত মহাকবি কালিদাস শরৎ বর্ণনায় লিখেছেন,
“প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, / নব বধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত”
বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাসের কবিতায় শরৎকে তুলে ধরেছেন এভাবে
“ভাদর মাসে অহোনিশি অন্ধকারে। / শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে
তাওনা দেখিবো যবে কাঞ্চির মুখ / চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফুটি জায়ির বুক”।
চট্টগ্রামের কবি আলাওল তাঁর পদ্মাবর্তী কাব্যের ষট ঋতু বর্ণন খন্ডে দেখি শরৎনিশি যাপনের এক মিলন মধুর দৃশ্য, “আইল শরৎ ঋতু নির্মল আকাশ।/ দোলায় চামর কাশ কুসুম বিকাশ।

এবার ঈদুল আযহার ছুটি শরৎকে যেন বিশেষ মহিমা দিয়েছে। কয়েকদিনের এক ঘেয়ে বৃষ্টির পর রোদের বাড়াবাড়িমুক্ত দিন। রাতে জোছনা ভরা চাঁদ। ছুটির আমন্ত্রণে, উৎসবের নেশায় আমাদের ছুটে চলা!। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! শিউলি ফুল, স্বচ্ছ আকাশ, মায়াবী জ্যোৎস্নার কারণেই এমন নাম হয়েছে। তবে এর মধ্যে অন্যতম কাশফুল। প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের মাঠে-ঘাটে কাশফুলের দেখা মেলে। এমনকি প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এদেশে কাশফুল ছিল। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। কাশফুলের জাত ভাইয়ের নাম কুশ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘পুরাণ’-এ কুশের স্থান খুব উঁচুতে। সেখানে ব্রাহ্মণ বড় নাকি কুশ বড় এই নিয়ে বিবাদও লক্ষ্য করা যায়। শেষ পর্যন্ত কুশকে ব্রাহ্মণের প্রতিভূ হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। আর এর পেছনের কারণ হল ঔষধি গুণ। সাহিত্যে কাশফুলের কথা নানাভাবে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনী অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। “আজি কি তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে!। হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে। …..শরতকালের প্রভাতে… ”

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ বন্দনায় এভাবেই ধরা পড়েছে শরৎ-প্রকৃতির মোহনীয় রূপ। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি, নদীর ধারে কিংবা গ্রামের কোনো প্রান্তে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া শুভ্র কাশফুলের স্নিগ্ধতা, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় অঝোরধারায় শ্রাবণ ঢলের পর আসে শরতের আলোছায়ার খেলা- এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ। মায়াবী শরতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার ভালোলাগা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। এছাড়া মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানির মুগ্ধতা। আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও খুশি। শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়। মূল ব্যবহার হয় ঔষধি হিসেবে। কাশফুলের বেশ কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন- পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। শরীরের রঙ হলে উঠে দিনদিন শুভ্র। এছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যাবহৃত হয়।

কাশফুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক নাম হল Saccharum spontaneum. এরা ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। চিরল পাতার দু’ধারে খুবই ধার। পালকের মতো নরম এর সাদা ফুল। আর তাই তো শরতের শিউলী ফুল নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন : ‘শিউলী ফুলের মালা দোলে/ শারদ রাতের বুকে ঐ’। শরতের প্রথম প্রভাতে সেই শিউলিফুল ফুটবে, তার বিকশিত রূপ আর গন্ধ ছড়াবে বাতাসে। আমোদিত হবে প্রকৃতি আর সেই সাথে প্রফুল্ল এবং উৎফুল্লচিত্ত হয়ে উঠবে মানুষ এবং এই রসহীন নগরজীবনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তারাও সচকিত হবে শরতের সুরভিমাখা নিমন্ত্রণে। সেই কবে যারা পলি¬র স্নেহসান্নিধ্য ছেড়ে জীবিকার তাগিদে ইট-পাথরের বিরস কঠিন-কঠোর নগরযাপন শুরু করেছে, তারাও আজ উপলব্ধি করবে : সত্যিই তো শরৎ এসেছে, আকাশে-বাতাসে তারই সৌরভ, প্রীতিগন্ধময় আবেশ ছড়ানো দিন আজ।

শরতের মনভোলানো প্রকৃতিতে মন যে কী চায়, তা বোঝা বড়ই মুশকিল! রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলায় মনেও যেন জমে মেঘ, আবার কখনো হয়ে ওঠে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। কিন্তু ব্যস্ত এ নগরে, শত ব্যস্ততার মাঝে আমরা পারি না মনের আকাঙ্খায় শরতের রঙে সাজাতে। তবু যেন মনে হয় হারিয়ে যাই-শরতের কাশফুল, গোধূলি, শিউলি আর

জ্যোৎস্নার মাঝে। প্রিয়জনের হাত ধরে অনুভব করি স্নিগ্ধতা। শরতের স্তব্ধতা যেন দূর গ্রামের দিগন্তরেখার নিচে ঘনায়মান সন্ধ্যার মতোই শান্ত ও মধুর। এমন মধুর একটি ঋতু শুধু ভাবনায় নয়, বাস্তবেও নির্মাণ করা সম্ভব। যদিও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে শরতের অপরূপ সেই রূপ-মাধুর্য এখন আর আগের মতো নেই। তবুও ঋতুচক্রে শরৎ আসে। আর এই ঋতুচক্রের বর্ণিল দোলায় উদ্ভাসিত হোক স্নিগ্ধ শরতের শুভ্র কাশফুল। শরতে জেগে উঠেছে গোটা প্রকৃতি। এই প্রকৃতিকে বর্ণিল করে তুলতে ফুটেছে শরতের কাশ ফুল। শরতের অন্যতম আকর্ষণ কাশবন। কাশফুল। কাশ তৃণ বা ঘাস জাতীয় ফুলগাছ। কাশগাছ ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। শরত্কালে কাশগাছে সাদা ও রুপালি রঙের ফুল ফোটে। কাশফুল পালকের মতো নরম। কাশের আদি নিবাস ভারত। বাংলাদেশে নদীর তীর, বিল, অবারিত মাঠ, চরাঞ্চল, পাহাড়, উঁচু জমি এবং ভারতের গয়া অঞ্চল জুড়ে কাশফুল ফুটতে দেখা যায়। ঢাকার আশপাশে রয়েছে অনেক কাশবন। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে রয়েছে অনেক কাশবন। মিরপুরে সাগুফতা আবাসিক এলাকা পোস্তগোলা ব্রিজ পার হয়ে কেরানিগঞ্জ এলাকা এবং ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ও উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় দেখা মিলবে কাশবনের।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button