ফিরে দেখা পোল্যান্ডের তাতারদের ৬০০ বছরের ইতিহাস

ইসলামের আলোকিত সংস্করণ হিসাবে

১৩৯৫ সাল। সামনে কি অপেক্ষা করছে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা না থাকা সত্ত্বেও তাতার মুসলিম সৈন্যবাহিনী তোখতামিসের নেতৃত্বে তৎকালীন ইউক্রেনের উত্তর প্রান্তরে আক্রমণ চালায়।

তাদের অভিযানটি অনেক দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য ছিল, কিন্ত তা সত্তে¦ও যোদ্ধারা ছিল একেবারেই নিয়মতান্ত্রিক এবং তাদের ছিল ঘোড়া দৌড়ানোর মত দক্ষতা আর ছিল কষ্ট সহ্য করার মত ক্ষমতা।

তিমুরিদ সম্রাটের সাথে তেরেক নদীর তীরে দুপক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে অপমানকর পরাজয়ের পর তোখতামিসের সৈন্যবাহিনী একটি নিরাপদ অঞ্চল খুঁজছিল।

একটি সোনালী যাযাবর জাতি হিসাবে এই পরজায়ের মাধ্যমে তোখতামিসের জাতির পরাজিত হওয়া শুরু হয়েছিল মাত্র।

তোখতামিসের সৈন্যরা লিথুনিয়ার দিকে চলতে থাকে, যেটি ছিল মহান ভাইটাউটাসের শাসনাঞ্চল এবং সেই সময়ে তারা তাদের রাজ্যের বিশাল ব্যাপ্তি ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল। আর তোখতামিস রাজ্যটির পশ্চিম অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য মনোনিবেশ করেন।

তামেরলেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভাইটাউটাসকে সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিয়ে তোখতামিস তার নিকট পুরো কেইভান এবং মস্কোকে শাসন করার অধিকার চান।

ওই একই সময়ে তোখতামিসের সৈন্য বাহিনী এবং তাদের উত্তসূরীরা লিথুনিয়াতে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এবং পরবর্তী শতাব্দী ধরে তারা এই অঞ্চলের সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

১৩৮৫ সালে লিথুনিয়ার প্রধান জমিদার এবং পোল্যান্ডের রাজা তাদের দুই অঞ্চলকে একত্রিত করে পোলিশ-লিথুনিয়ান কমনওয়েলথ গঠন করেন। এবং এই অঞ্চলটি ১৬ এবং ১৭ শতাব্দীতে ইউরোপের সবচাইতে বেশি লোকজন বসবাস করা অঞ্চলে পরিণত হয়।

১৭ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে জন সোবিস্কি, পোল্যান্ডের রাজা এবং লিথুনিয়ার প্রধান জমিদার তাতারদেরকে পোলিশ-লিথুনিয়ার সীমান্ত এলাকায় আমন্ত্রণ জানান।

পোলিশ-লিথুনিয়ার সৈন্যদের সাথে মিলে যুদ্ধ করার বিনিময়ে তারা তাতারদেরকে বিয়ালাইস্টক শহরের প্রায় ১৫০ কিলেমিটার অঞ্চলে শাসনাধিকার দেয়।

এই সময়ে তাতারগণ উচ্চ আসনে আসীন হন, বিভিন্ন রাজকীয় উপাধি ধারণ করেন এবং সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন উচ্চ পদ লাভ করেন।

তাতারদেরকে স্থানীয় মহিলাদের বিবাহ করার অনুমতি দেয়ার পরপরেই তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে কিন্তু তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ধরে রাখে।

‘১৭ এবং ১৮ শতাব্দীতে তাতারগণ খ্রিস্টান ইউরোপে একটি অনন্য জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ছিল এমন একটি সংখ্যালঘিষ্ট মুসলিম জাতি যারা মানিয়ে নিতে শিখেছিল।’- ওয়ারসো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডাম বালচের আল-জাজিরাকে এমনটি জানান। তিনি আরো জানান, ‘সেই সময়ে স্পেনের মুসলিমদেরকে হয় খ্র্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছিল বা বহিষ্কার করা হচ্ছিল।’

কিন্তু পোল্যান্ডে তাতারদেরকে শুধুমাত্র তাদের ধর্ম চর্চার অনুমতিই দেয়া হয়নি বরং তারা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধন রূপে কর্মরত ছিল।’

নিকোলাস কপের্নিকাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনানা কামিনেস্কা এবং চেজেসল’ লাপিকজ কর্তৃক পরিচালিত সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৬ শতাব্দীর শুরুতেই পোলিশ তাতারগণ পবিত্র কুরআন শরীফ পোলিশ ভাষায় অনূদিত করেন।

গবেষকদের মতে, ইতালিয়ান এবং ল্যাতিন অনূবাদের পরেই কোেনা ইউরোপীয় ভাষায় পবিত্র কুরআনের এটিই তৃতীয় অনূবাদ।

পবিত্র কুরআনের সেই সকল অনূবাদকের নাম এখনো অজানা তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে- তারা ছিল তখনকার উচ্চ শ্রেণীর তাতার যার পূর্বে মুসলিম এবং সেলভিক ভাষাভাষির লোকজনের সাথে তাদের সম্পর্ক ধরে রেখেছিল।

১৯১৯ সালে ওই অঞ্চলের প্রধানের অনুরোধে তাতারদের নিয়ে সৈন্যবাহিনী গঠিত হয় এবং তাদেরকে সম্মানজনক প্রতীক তারকা ও ক্রস দেয়া হয়।

বর্তমানে পোল্যান্ডে ৩৫,০০০ হাজারের মত মুসলিমের বসবাস যাদের মধ্যে অন্তত দুই হাজার জন হচ্ছেন তাতার বংশধর।

সেখানকার দুইটি পুরোনো মসজিদ যেগুলো নির্মাণ শৈলী ক্যাথোলিক এবং অরথোডক্স চার্চের সাথে মিলে যায়।

পোল্যান্ডের বোহোনিকি অঞ্চলের মুসলিম সমাজের প্রধান মাচিজ সেজনোউচিজ বলেন, ‘আমরা হচ্ছি সেই সকল মুসলিম যারা খ্রিস্টান সমাজের মধ্যেই বড় হয়েছি।’ ‘ক্যাথলিক এবং অরথোডক্স খ্রিস্টানদের সাথে মিলে আমরা বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা করি। এখানকার ধর্ম যাজকরা আমাদের মসজিদে প্রার্থনা করতে আসেন।’

যদিও তাতারগণ ৬০০ বছর ধরে তারে নিজস্ব পরিচয় ধরে রেখেছে, তবুও ক্রমান্বয়ে তারা তাদের সংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে রয়েছে।

‘আমি পোলিশ তাতারদেরকে পশ্চিমের ক্যাথলিক চার্চের সাথে তুলনা করি যারা হচ্ছে ইসলামের একটি আলোকিত দল।’ পোল্যান্ডের মুফতি এবং দেশটির মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতা টমাস মিস্কিউইচিজ আল-জাজিরাকে এমনটি জানান।

আন্ত-ধর্মীয় বিবাহ এখানকার যুবকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

দেশটিতে ক্রমান্বয়ে ইসলামভীতি বাড়ছেই, যদিও কিছু তাতার বলেন তারা তাদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় তেমন একটা বৈষম্যের শিকার হন না।

‘দেশটির অন্যান্য মুসলিমদের চাইতে তাতাররা কম ইসলামভীতির শিকার হন। এটা হয় এ জন্য যে, তারা এই অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবেই উপস্থিত এবং তাদের অবয়বে মুসলিম সুলভ আকৃতি প্রকাশিত হয় না।’-চারকাউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র কোনার্ড আল-জাজিরাকে এমনটি বলেন।

তবে কয়েক বছর ধরে এখানকার কিছু কিছু মসজিদ ভাঙচুর করা হয়েছিল এবং সেখানে খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রতীক ক্রস, শুকরের বাচ্চা রেখে দেয়া হয়েছিল।

‘যেসব লোকজন এসব করে তাদের সাধারণ সচেতনতাটুকু নেই। ৬০০ বছরের পোলিশ ইতিহাসে দেখা যায় তাতাররা সবসমইয় পোল্যান্ডের জন্য যুদ্ধ করেছিল।’-ক্রেজিজটোফ মুচারস্কি নামের একজন পোলিশ-তাতার আল-জাজিরাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন।

পোলিশ তাতাররা শুধুমাত্র তাদের মুসলিম ঐতিহ্য নিয়েই গর্ববোধ করে না, তার সাথে সাথে তাদের পোলিশ শেকড়েরও গর্ব করে।

‘আমরা হচ্ছি একটি খরগোশের মত যে কিনা জাদুকরের টুপির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে পুরো বিশ্বকে বিস্মিত করে যে এখানে আমাদের সমর্থকরা উপস্থিত আছে, যারা এখানে অঙ্গীভূতে এবং অনুগত নাগরিক হয়ে রয়েছে।’- ক্রেজিজটোফ মুচারস্কি বলেন, ‘আমরাই হচ্ছি খুঁটি।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button