ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁ ঈদের ছুটি কাটালে কেমন হয়

রুহুল আমিন: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা সোনারগাঁ। এখানে সুলতানী আমল ও মোগল আমলের বেশ কিছু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে। এ অঞ্চলের চারু ও কারুশিল্প এবং বস্ত্র বয়ন শিল্প সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। সোনারগাঁ অঞ্চলের সুতি কাপড় মিসরীয় ও রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। ঈদের ছুটি কাটাতে, বনভোজন বা দেশের ইতিহাস জানার জন্য সোনারগাঁয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী জায়গা আর দ্বিতীয়টি নেই। পর্যটকদে জন্য রয়েছে উন্নতমানের হেটেল সোনারগাঁ রয়েল রির্সোট। যেন মন চায় চলোনা ঘুরে আসি সোনারগাঁয়ে।
সোনারগাঁয়ের ইতিহাস: সোনারগাঁর প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম। ১৩শ’ শতকে রাজা দানুযমদেব দশরথদেব তাঁর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে সোনারগাঁয়ে নিয়ে আসেন। ১৪শ’ শতকের মাঝামাঝি সময় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সোনারগাঁ অঞ্চল অধিকার করেন। সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতান, সোনারগাঁ ছিল তাঁর রাজধানী। বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ।
সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প যাদুঘর: বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁয়ে এখন রয়েছে লোকশিল্প যাদুঘর। এই জাদুঘরে দর্শনার্থীরা দেখতে পাবেন বাংলার প্রাচীন সুলতানদের ব্যবহৃত অস্ত্র-শস্ত্র, তৈজসপত্র, পোশাক, বর্ম, অলংকার ইত্যাদি। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের লোকশিল্পের অনেক নিদর্শন রয়েছে এখানে। রয়েছে বাংলার প্রাচীন মুদ্রা।
কারুপল্লী ও লোকশিল্প মেলা: সোনারগাঁয়ে বড় সর্দার বাড়ি নামে পরিচিত একটি প্রাচীন জমিদার প্রাসাদে এই জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। লোকশিল্প জাদুঘর গড়ে উঠেছে বিশাল এলাকা নিয়ে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর এলাকায় রয়েছে একটি কারুপল্লী।
কারুশিল্প গ্রামে বৈচিত্র্যময় লোকজ স্থাপত্য গঠনে বিভিন্ন ঘরে কারুশিল্প উৎপাদন, প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। দোচালা, চৌচালা ও উপজাতীয় আদলে তৈরি এ ঘরগুলোয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা, অচেনা, আর্থিকভাবে অবহেলিত অথচ দক্ষ কারুশিল্পীর তৈরি বাঁশ-বেত, কাঠ খোদাই, মাটি, জামদানি, নকশিকাঁথা, একতারা, পাট, শঙ্খ, মৃৎশিল্প ও ঝিনুকের সামগ্রী ইত্যাদি কারুপণ্য বিক্রির জন্য এখানে স্থায়ীভাবে প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও প্রতি বৈশাখ মাসে এখানে চলে লোকশিল্পমেলা। এ মেলায় লোকসংগীত, যাত্রাপালা, কবিগান ইত্যাদির লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। মেলায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন লোকজ শিল্পী ও কারুশিশিল্পীরা। মাটি, শোলা, বাঁশ, বেত, কাপড়সহ বিভিন্ন হস্তশিল্পজাত সামগ্রী বিক্রি হয় এ মেলায়। বাংলাদেশের লোকশিল্পের সংরক্ষণ বিকাশ ও সর্ব সাধারণের মধ্যে লোকশিল্পের গৌরবময় দিক তুলে ধরার জন্য ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার বিশাল এলাকা নিয়ে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে রয়েছে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, কারুপল্লী ও একটি বিশাল লেক। লেকে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও আছে ক্যান্টিন।
পিকনিক স্পট: ফাউন্ডেশনের প্রবেশ পথের সামনেই আগত পর্যটকদের বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়াসে আম, লিচু, পাম, নারিকেল, মেহগনি ও গুবাকতরুর সারির শ্যামল, স্নিগ্ধ হৃদয় জুড়ানো নিরিবিলি পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে ঐতিহ্য নামের বিনোদন স্পট। এ স্পট স্বস্তিকর ও আনন্দদায়ক বিনোদনে দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষকে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করবে। স্পট ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট ফি রয়েছে।
জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য: ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সবুজ চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য। শিল্পী শ্যামল চৌধুরী ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।
সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী: আঠারশ ও ঊনবিংশ শতকে এখানে বস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিলাস বহুল বাসস্থান গড়ে তোলেন। পানাম নগরী এলাকায় এমন অনেকগুলো প্রাসাদোপম বাড়ি রয়েছে। এই বাড়িগুলো পরিত্যাক্ত। প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে পুরো পানাম নগরী সংরক্ষিত রয়েছে। দর্শকরা এখানে দেখতে পাবেন কারুকার্য করা বিশাল সব প্রাসাদ, ভিতরে সিরামিকের কারুকার্যশোভিত দেয়াল, নাচঘর, ঝুল বারান্দা। দর্শকদের মনে হবে তারা যেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে গেছেন কোনো মন্ত্রবলে। সোনারগাঁর সদর ও পানামনগরী তিনটি সেতু দিয়ে সংযুক্ত। এই সেতু তিনটি মোগল আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল। পানাম সেতু, দালালপুর সেতু এবং পানাম নগর সেতু নামে পরিচিত এ তিনটি সেতু মোগল স্থাপত্য রীতির নিদর্শন। এ সেতুগুলো এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রয়েছে মোগল আমলে নির্মিত সোনাকান্দা দুর্গ। এসব মিলিয়ে পানাম নগরী তার আভিজাত্য নিয়ে খুব বিখ্যাত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button