ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ১৫টি পয়েন্ট
জাতিসংঘের মানবাধিকার ও আইনি বিশেষজ্ঞরা শুক্রবার সতর্ক করেছেন যে, গাজা নিয়ে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত শান্তি পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি আরও গভীর করতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার একটি ২০ দফা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে গাজাকে একটি অসামরিক অঞ্চল হিসেবে গঠন করা হবে।
সেখানে একটি অস্থায়ী প্রযুক্তিনির্ভর ফিলিস্তিনি কমিটি শাসন করবে—যার ওপর আন্তর্জাতিক তদারকি থাকবে, এবং সেই কমিটির সভাপতিত্ব করবেন ট্রাম্প নিজে, যতদিন না পর্যন্ত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ(পিএ) শাসনের জন্য প্রস্তুত হয়।
এই পরিকল্পনাটি এখনো হামাস গ্রহণ করেনি এবং এটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে, কারণ অনেক ফিলিস্তিনি একে ইসরায়েলি বর্ণবৈষম্য ও গণহত্যা অব্যাহত রাখার “প্রাক-কথন” হিসেবে দেখছেন।
পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়, নিরস্ত্র হলে হামাস সদস্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমা, নিরাপদ পথ, আন্তর্জাতিক সহায়তা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন অঞ্চল, এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিবর্তে একটি মার্কিন-সমর্থিত আন্তর্জাতিক শান্তি বাহিনী মোতায়েনের কথা বলা হয়েছে।
পরিকল্পনায় ইসরায়েলকে গাজা সংযুক্ত না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এবং “ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে” এক দূরবর্তী সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
যদিও জাতিসংঘের ৩৬ জন বিশেষজ্ঞ স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা, অবৈধভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি, এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বা সংযুক্তিকরণের বিরোধিতার মতো কিছু দিককে স্বাগত জানিয়েছেন, তারা বলেছেন, এসব বিষয় ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা, কোনো শান্তি পরিকল্পনার উপর নির্ভর করা উচিত নয়।
তারা সতর্ক করেছেন: “আইন ও ন্যায়বিচারকে উপেক্ষা করে যেকোনো মূল্যে শান্তি চাপিয়ে দেওয়া ভবিষ্যৎ সহিংসতা ও অবিচারের রেসিপি মাত্র।”
বিশেষজ্ঞরা পরিকল্পনাটির আন্তর্জাতিক আইন ও ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যেখানে বলা হয়েছিল ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে উপস্থিতি অবৈধ এবং তা অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে শেষ করতে হবে।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের মতে ট্রাম্প পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যানের ১৫টি কারণ:
১. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার শর্তাধীন করা:
পরিকল্পনাটি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার নিশ্চিত করে না। বরং গাজার পুনর্গঠন, পিএ’র সংস্কার ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংলাপের মতো শর্তের ওপর নির্ভরশীল করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ কোনো বাইরের পক্ষের অনুমতির ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না।
২. প্রতিনিধিত্বহীন প্রশাসন:
পরিকল্পনায় “অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার”-এর প্রস্তাব রয়েছে, যা পিএ-কে বাদ দেয় এবং কোনো গণতান্ত্রিক বৈধতা রাখে না।
কোনো সময়সীমা বা মানদণ্ডও নির্ধারিত নয়।
৩. জাতিসংঘের বাইরে নজরদারি:
পর্যবেক্ষণ করবে “বোর্ড অব পিস”, যার নেতৃত্বে থাকবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি স্বচ্ছতার অভাবযুক্ত ও জাতিসংঘকে পাশ কাটানোর একতরফা প্রক্রিয়া, যা ঔপনিবেশিক শাসনের ধাঁচে তৈরি।
৪. দখলদারিত্বের পরিবর্তে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ:
গাজায় মার্কিন-সমর্থিত “আন্তর্জাতিক শান্তি বাহিনী” পাঠানোর প্রস্তাব মূলত একটি নতুন বিদেশি দখলদারিত্ব সৃষ্টি করবে, যা ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
৫. ইসরায়েলি উপস্থিতি অব্যাহত রাখা:
পরিকল্পনায় ইসরায়েলকে গাজার ভেতরে “নিরাপত্তা পরিধি” বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে—যা আন্তর্জাতিক আইনে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
৬. একতরফা নিরস্ত্রীকরণ:
গাজাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিরস্ত্র থাকতে বলা হয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলের ওপর কোনো সামরিক সীমাবদ্ধতা নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি গাজাকে অরক্ষিত ও দুর্বল করে তুলবে।
৭. অসম “চরমপন্থা বিরোধী” ব্যবস্থা:
গাজাকে “ডির্যাডিকালাইজেশন” করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলে প্রচলিত আরব ও ফিলিস্তিনি-বিরোধী ঘৃণামূলক বক্তব্যের কোনো সমালোচনা করা হয়নি।
৮. ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক বিভাজন:
পরিকল্পনায় গাজাকে আলাদা করে দেখা হয়েছে—পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের সঙ্গে একীভূত নয়। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৯. অর্থনৈতিক শোষণের ঝুঁকি:
“অর্থনৈতিক উন্নয়ন অঞ্চল” ও “বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল” তৈরির প্রস্তাব গাজার সম্পদে বিদেশি শোষণ ডেকে আনতে পারে। এটি সার্বভৌমত্ব নয়, বরং নির্ভরতা বাড়াবে।
১০. ক্ষতিপূরণের অনুপস্থিতি:
ইসরায়েল বা তার মিত্রদের ফিলিস্তিনে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি—যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আবশ্যক।
১১. বন্দিদের বৈষম্যমূলক মুক্তি:
পরিকল্পনায় সব ইসরায়েলি বন্দির মুক্তি দেওয়া হলেও, কেবল কিছু ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির কথা বলা হয়েছে—এটি আন্তর্জাতিক আইনে অসম আচরণ।
১২. দায়মুক্তি দিয়ে সাধারণ ক্ষমা:
হামাস সদস্যদের নির্বিচারে সাধারণ ক্ষমা দেওয়া হবে, তারা অপরাধ করুক বা না করুক—যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
১৩. ইসরায়েলি অপরাধের কোনো জবাবদিহি নেই:
ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘন বা যুদ্ধাপরাধের জন্য কোনো জবাবদিহি কাঠামো রাখা হয়নি। সত্য উদঘাটন, পুনর্মিলন বা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থাও অনুপস্থিত।
১৪. মূল ইস্যুগুলোর অবহেলা:
পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক আইন ও পূর্ববর্তী শান্তি প্রক্রিয়ার মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষা করেছে, যেমন—পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি অপসারণ, স্বীকৃত সীমান্ত নির্ধারণ, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার, ইসরায়েলের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বাধ্যবাধকতা।
১৫. জাতিসংঘের ভূমিকা সীমিত করা:
পরিকল্পনাটি জাতিসংঘ, সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ ও ইউএনআরডব্লিউএ-এর মতো সংস্থাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইসিজে স্পষ্টভাবে বলেছে যে দখলদারিত্বের অবসান তদারকি করার যথাযথ কর্তৃপক্ষ হলো জাতিসংঘ, ইসরায়েল ও তার মিত্ররা নয়।
বিশেষজ্ঞরা শেষে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: “ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর কোনো শর্ত আরোপ করা যায় না, এবং দখলদারিত্ব অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে শেষ করতে হবে।”
তারা বলেছেন, “যেকোনো শান্তি পরিকল্পনাকে আন্তর্জাতিক আইনের মূল নীতিগুলো মেনে চলতে হবে। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি জনগণের হাতেই থাকা উচিত, বিদেশি চাপ বা জোরপূর্বক আরোপিত নয়।” – সোনদোস আসেম, লন্ডনে অবস্থিত মিডল ইস্ট আই-এর সাংবাদিক ও নিউজ এডিটর। তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং জননীতির বিশেষজ্ঞ। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে এমএসসি এবং ২০১৫ সালে পাবলিক পলিসিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সাংবাদিকতা, প্রকাশনা, মানবাধিকার ও অনুবাদ ক্ষেত্রে তার ২০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



