কাব্যলোকে অনন্য কবি আফজাল চৌধুরী

afzal-chyআবু মালিহা: ষাট দশকের পরবর্তী সময়গুলোতে যে কয়জন খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি আফজাল চৌধুরী। সাহিত্যিক মান এবং গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী একজন কবি। অনেক কবিদের মধ্যে আমরা সৌজন্যতা এবং গাম্ভীর্যবোধ দেখিনা, সে দিক থেকে কবি আফজাল চৌধুরী ছিলেন অনন্য। কন্ঠের যাদুকরী উচ্চারণ তাকে আরো সম্মোহিত করতে এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনন্য ভঙ্গিমার এক মহানায়কের ভূমিকায় নিজেকে তুলে ধরতে সব সময়ই সচেতন ছিলেন। কাল থেকে কালান্তরের ভাবনাগুলোকে যুথবদ্ধ পুষ্পপুঞ্জের ন্যায় সবার সামনে উদ্ভাসিত করার এক নবরূপ কৌশলীর মতো শিল্প ছন্দের প্রকাশ ঘটাতে পারতেন অবলীলায় যা হতো মনোমুগ্ধকর এবং উল্লাসমুখর।
বাংলা সাহিত্যে ‘কল্যাণব্রতের’ কবি হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁর কাব্য সাধনা ছিল জনহিতে, দেশজ সংস্কৃতি তার হাতে আরো পুষ্পিত হয়েছে। বিশেষ করে যারা সাহিত্যকে নোংরা এবং খিস্তি খেউর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় তাদের বিরুদ্ধে তিনি দুর্বার লেখনী সংগ্রামের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ঘটিয়েছেন। যা কিনা তার সমসাময়িক অনেক কবি সাহিত্যিকের দ্বারা সম্ভবপর হয়নি অর্র্থাৎ সে ধরনের হিম্মত অনেকের মধ্যেই ছিল অনুপস্থিত। জাগ্রত চেতনার কবি হিসেবে তিনি ছিলেন অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কারবাদী। আমরা যারা ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রকে পর্যবেক্ষণ করি তখন দেখি অনেক শক্তিমান কবি সাহিত্যিকের মধ্যে নিজেকে উপস্থাপন করা চাট্টিখানা কথা নয়। সে সমস্ত ব্যুহভেদ করে কবি আফজাল চৌধুরী সত্যিকার ভাবেই নিজের আসনটিকে পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন। সাহিত্যের কৌলিন্য বলে যে অবস্থান সেটিকে আরো উন্নত করতে তিনি যথেষ্ট প্রভাব রেখেছেন। তার ভূয়সী প্রশংসা করতেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, সাহিত্য সমালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ সহ আরো অনেকে।
কবি আফজাল চৌধুরীর ভাব, ভাষা এবং সাহিত্যের উপকরণ ছিল মৌলিক ও নৈতিক চিন্তাধারা প্রসূত। তিনি সাহিত্যকে মূল্যায়ন করতেন বস্তু জগতের সমস্ত কল্যাণমূলক ধ্যান ধারণাকে আশ্রয় করে। অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিতেন না।  মানবীয় চেতনার উৎসমূলে তিনি জাগ্রত করতেন আপন সত্তাকে চিনে নিতে এবং কর্মধারাকে সাহিত্যের স্পর্শানুভূতিতে সজীব করে বহমান নদীর মতই ঢেউ জাগাতেন।
সাহিত্যের এই উজ্জ্বল ব্যক্তিটি জন্মে ছিলেন ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ হবিগঞ্জে এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০৪ সালের ৯ জানুয়ারি। তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে রাজশাহী সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। পরবর্তীতে সিলেট সরকারি কলেজ, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ এবং সিলেট এমসি কলেজে অধ্যাপনা করে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত হবিগঞ্জস্থ বৃন্দাবন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সুনামের সাথে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
কবির উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে কল্যাণব্রত, শ্বেতপত্র, সামগীত দুঃসময়ের, সব মেহেরের ছুটি, নয়াপৃথিবীর জন্ম, বিশ্বাসের দিওয়ান, এই ঢাকা এই জাহাঙ্গীর নগর, হে পৃথিবী নিরাময় হও, সিলেট বিজয়, ঐতিহ্য চিন্তা ও রসুল প্রশস্তি, তাঁর কাব্যালোকে সৈয়দ আলী আহসান, সিলেটের সুফী সাধনা, বার্ণবাসের বাইবেল, জালাল উদ্দিন রুমির কবিতা। কবি আফজাল চৌধুরীর উল্লেখ্যযোগ্য বই ‘মক্কার পথঃ মুহাম্মদ আসাদের মহা জীবন’ গ্রন্থটি পাঠ করলে কবির চিন্তা চেতনার দর্শন এবং আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় ফুটে উঠে অনন্য এই বইটিতে। তাই এ গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে তাকে আরো বিশেষভাবে জানা যাবে।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো ছাড়াও কবির আরও অনেক গ্রন্থের পান্ডুলিপি আছে যেগুলো প্রকাশের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কবি আফজাল চৌধুরী ফাউন্ডেশন, সিলেট এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমরা জানি। ঢাকায় অবস্থানকালে কবি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করার সুবাদে সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ এবং গবেষণার যথেষ্ট প্রমাণ রেখেছেন। যারা তার একান্ত কাছে থেকে নিজের পথকে পরিষ্কার আলোতে দেখতে পেয়েছেন।
কবির কাব্য সাধনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো তিনি সমাজের ব্যথিত নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের কথা তার সাহিত্যে অকপটে তুলে ধরেছেন। দ্বিধান্বিত চিন্তা চেতনাকে অপসারিত করে দুর্বার চেতনায় সত্যকে দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরতেন। শংকা এবং সমালোচনা কখনো তাকে পিছু হটতে দেয় নাই। বাংলা সাহিত্যে এমন কবির সংখ্যা নিতান্তই কম। তার মাঝে দেখতে পাই কবি নজরুলের মতো দুৎসাহসিক অভিযাত্রীর উজ্জলতা। কবি ফররুখের মতো সমুদ্রের বিশাল ঢেউ ভেঙ্গে শক্ত হাতে কান্ডারীর ভূমিকায় দাঁড় টেনে বিশাল জলরাশি পাড়ি দিতে। রবীন্দ্র নাথের মতো কবিতার গভীরে প্রবেশ করে অন্তর দর্শনকে ফুটিয়ে তোলা। সৈয়দ আলী আহসানের ভাব রাজ্যে মুক্ত বলাকার মতো উড়ে বেড়ানো, এ সমস্ত হলো কবির গভীর চিন্তার ছায়াপাত। আমরা যারা আজকের দিনের সাহিত্যে এবং কাব্যালোকে পরিভ্রমণ করছি তাদের অনেকেই দিকভ্রান্ত হওয়ার মতো মানসিকতা পরিলক্ষণ করি। কিন্তু একমাত্র কবি আফজাল চৌধুরীই ছিলেন নিশাঘোরের দিকভ্রান্ত পথিকের জন্য সাহিত্যের ধ্রুব তারা। তার অনুগমনে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন এবং কৃতার্থ থেকেছেন সান্নিধ্যে। কবি আসাদ চৌধুরী তার সান্নিধ্যে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতেন। বাংলা সাহিত্যে এমন অনেকেই যারা তার একান্ত কাছে থেকে নিজের পথকে পরিষ্কার আলোতে চিনতে পেরেছেন।
এ কবি সত্তার মধ্যে নাট্যপ্রিয়তাও ছিল সমানভাবে। তাই তিনি একজন নাট্যকারও বটে। এ বিশেষত্ব তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। তার নিদর্শন হচ্ছে তার রচিত ‘হে পৃথিবী নিরাময় হও এবং সিলেট বিজয়’ নাট্যগ্রন্থে তার বিশেষত্ব ফুটে উঠে। বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আফজাল বীররসে পরিপূর্ণ ব্যক্তি সত্তা। তার স্বল্পায়ু জীবনে অধ্যাপনা, কাব্য রচনা এবং নাট্যসৃষ্টির ঘোরের মধ্যেই কাটিয়েছেন। তার ধর্ম, নিষ্ঠা ও ঐতিহ্য প্রীতি তাকে ষাটের সমস্ত সাহিত্য প্রবণতা থেকে সরিয়ে স্বাতন্ত্রের পথে টেনে নিয়ে গেছে। তিনি ষাট দশকের প্রথম দিকে যাদের সাথে চলাফেরা করতেন সব দিক দিয়ে তাদের চেয়ে প্রাণ শক্তিতে ভরপুর ছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থ ‘হে পৃথিবী নিরাময় হও’ একটি অল্পপঠিত স্বতন্ত্র সংগ্রামের কাব্য গ্রন্থে চিহ্নিত। তিনি অকুতোভয় কবি ছিলেন। ঠিক তাই, কবি স্বতন্ত্র এক কাব্য সত্তা নিয়ে জন্মেছিলেন। আদর্শিক চেতনা এবং দৃঢ়চিত্ততা গুণের বৈশিষ্ট্য অনেকের বেলাতেই অনুপস্থিত থাকে। সে দিক থেকে কবি অনেক সৌভাগ্যবান। এতেই তাকে এনে দিয়েছে আদর্শিক কাব্যলোকে নকীবের ভূমিকায়। তিনি সদা জাগ্রত ছিলেন এবং দেশ ও সমাজ সম্পর্কে তিনি মোটেই অসচেতন ছিলেন না। আগেই উল্লেখ করেছি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন কবি আফজাল চৌধুরীকে নিয়ে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি আসাদ চৌধুরী। তার কিছু উল্লেখ করতে চাই।
আফজাল চৌধুরীর শানিত দৃষ্টি এ ভাবেই নিপতিত হয়েছিল, ‘কলাকৈবল্যবাদী প্রধান, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের হৃদয়বৃন্তে আশ্রিত হলেও কারুকার্যময় লালিত বুলির সন্ধানে সাগরের ভিড়েও। রেস্তোরায় তাদের ক্ষয় হচ্ছে।’ (কল্যাণব্রত, পৃষ্ঠ-৮৯) এর আগেই তিনি নবীন লেখকদের সম্পর্কে লিখেছেন তৎকালে আমার ক্ষিপ্রখর হেতু চিন্ত আমাকে কতিপয়/ রাগী তরুণ কবিদের সঙ্গে বচসায় অবতীর্ণ করল।’ (ঐ পৃষ্ঠা-৭) তারও আগে মুহূর্তে আমি’ কবিতায় আফজাল চৌধুরীর অকপট স্বীকারোক্তি।
কেন যে নিজেকে আমি বার বার ফিরে হোমার/ পিন্ডার/ কিম্বা বাল্মীকির বংশধর ভাবি/ হায়রে মরন! (ঐ পৃষ্ঠা-৬) ‘নিরন্তর স্পর্শ করাবো,
কবিতার প্রারম্ভে তিনি স্পষ্ট করেই নিজের চিন্তার কথাটি খোলাখুলি বলে বসলেন- ‘ইতিমধ্যে মতবাদ সমূহের ঘায়ে আহত হয়ে ধার্মিক কিম্বা/ নাস্তিক কোন মিমাংসাই প্রচার করতে পারছিনা। (ঐ পৃৃষ্ঠা:১৫)
এতে তার স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিই কবি তার আলোচনায় উল্লেখ করেছেন বাংলা সাহিত্যের নন্দন শিল্পীকে নিয়ে। তাই আমরা কবি আফজাল চৌধুরীর কাব্য সংস্কার মানসিকতার আলোকচ্ছটাকে যদি উত্তরসূরী হিসেবে আজকেও ধারণ করতে পারি তবে ধারণা করা যায়, সাহিত্যের সমুজ্জল পথটিকে চেতনার স্রোতধারায় বহমান এবং আগামী নবীন লেখক এবং সাহিত্যের কাফেলায় জাগবে নব উদ্দীপনা। যা দেশকে নিয়ে যাবে সঠিক গন্তব্যের দিকে এবং সাহিত্যের বাগান ভরে উঠবে সুশোভিত গোলাপের সুঘ্রান যুক্ত অসংখ্য রঙিন প্রজাপতির ভিড়ে। সাহিত্যের নন্দন শিল্প এভাবেই গড়ে উঠুক আফজাল চৌধুরীর কাব্য সলিলে নিমগ্ন হয়ে। পরিশেষে কবি আল মাহমুদের মন্তব্যের আলোকেই বলতে চাই সত্যিকার অর্থেই কবি আফজাল চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে এবং কাব্যলোকে অনন্য নকীবের ভূমিকায় সরব ছিলেন। এ কথা দৃঢ়তার সাথেই কবি সাহিত্যিকগণ মনে করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button