দোহায় ইসরায়েলি হামলা: মার্কিন জোট ও উপসাগরীয় সার্বভৌমত্বে মোড় পরিবর্তন
চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলাকে কেবল একটি সামরিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাবে না। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কাতারের সার্বভৌমত্বে সরাসরি আঘাত এবং মধ্যপ্রাচ্যের নাজুক কূটনৈতিক স্থাপত্যে প্রতীকী ভাঙন। কয়েক দশক ধরে দোহা একটি বৈপরীত্যপূর্ণ পরিচয় গড়ে তুলেছিল: একদিকে হামাসের কার্যালয়, ইরান, তালেবান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আলোচনার মঞ্চ হিসেবে ভূমিকা পালন। অন্যদিকে আল-উদেইদ ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক স্থাপনা স্বাগত জানানো। ইসরায়েলের এই হামলা প্রমাণ করলো, ওয়াশিংটনের মিত্র উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো একইসাথে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারবে—এই ধারণা আর টেকসই নয়।
এই হামলার প্রভাব কাতারের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। দোহায় আঘাত হেনে ইসরায়েল শুধু কাতারের ভূমিকা নয়, আরব বিশ্বে কূটনৈতিক “সেফ হ্যাভেন”-এর ধারণাকেও নষ্ট করেছে। ওমান কিংবা তুরস্কের মতো ছোট দেশগুলোর জন্য এটি এক শীতল বার্তা—যারা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকার মাধ্যমে স্বাধীনতা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। এই হামলা স্পষ্ট করেছে, আজকের আঞ্চলিক সংঘাতে নিরপেক্ষতা আসলে এক ভ্রান্ত ধারণা।
মার্কিন কূটনীতির দিক থেকে এই ঘটনা এক গভীর দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। যদি ওয়াশিংটন এ হামলাকে অনুমোদন করে থাকে বা নীরবে সমর্থন করে, তবে এর মানে হলো যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই এক ঘনিষ্ঠ মিত্রের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তা এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আর যদি বাইডেন প্রশাসন অজ্ঞাতেই থেকে থাকে, তবে সেটি আরও ভয়াবহ—তাহলে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আর ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই এবং তার আঞ্চলিক কর্তৃত্ব স্পষ্টভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। উভয় অবস্থাতেই উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
হামলার সময়কালও তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েক মাস আগেই কাতারের রাজপরিবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার উপহার দিয়েছিল—যা ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা দেখায়। সেই কাতারের সার্বভৌমত্বকেই এবার ইসরায়েল লঙ্ঘন করলো, যা প্রমাণ করে আমেরিকার উপসাগরীয় জোট নেটওয়ার্ক কতটা ভঙ্গুর। আরব বিশ্বের কাছে এর প্রতীকী বার্তা স্পষ্ট: যদি কাতার—যার সম্পদ, কৌশলগত গুরুত্ব এবং ওয়াশিংটনের সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে—নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, তবে অন্যদের অবস্থা কেমন হবে?
আঞ্চলিক দিক থেকে, এই হামলা ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নতুন এক সমন্বয় গড়ে তোলার ঝুঁকি তৈরি করেছে। হামাসকে বিচ্ছিন্ন করার পরিবর্তে হামলা উল্টো ইরান, কাতার ও তুরস্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে—যারা এখন নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অভিন্ন স্বার্থে যুক্ত। প্রতিরোধ দুর্বল হওয়ার বদলে উল্টো আরও বিস্তৃত হচ্ছে, আর মধ্যপ্রাচ্যে বহুমেরুকরণের স্রোত আরও গভীর হচ্ছে।
বৈশ্বিক দিক থেকে, এই ঘটনা আবারও তথাকথিত “উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার” ক্ষয়িষ্ণুতা প্রকাশ করে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে নিয়ম, সার্বভৌমত্ব ও পূর্বানুমানযোগ্যতার রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এক মিত্র রাষ্ট্র কাতারকে যদি আরেক মিত্র ইসরায়েল আক্রমণ করে, তবে সেই নিয়ম নিজেই ভেঙে যায়। এই শাসনব্যবস্থা আবারও প্রমাণিত হলো—নির্বাচনী, স্বার্থনির্ভর এবং নিজের নেটওয়ার্কের ভেতরের লোকদেরও রক্ষা করতে অক্ষম। গ্লোবাল সাউথ-এর কাছে শিক্ষা স্পষ্ট: মার্কিন সুরক্ষার ওপর নির্ভরতা দিন দিন অবিশ্বস্ত হয়ে উঠছে।
অবশেষে, দোহায় ইসরায়েলি হামলা সেই যুগের অবসান ঘোষণা করলো, যখন উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো মার্কিন সুরক্ষার সাথে আঞ্চলিক মধ্যস্থতা একসাথে চালিয়ে যেতে পারত। এখন আর কোনো “কূটনৈতিক সেফ হ্যাভেন” নেই। তার জায়গায় এসেছে এক কঠিন বহুমেরুকৃত বাস্তবতা, যেখানে সার্বভৌমত্ব ভঙ্গুর, জোট শর্তসাপেক্ষ, আর যুদ্ধ পৌঁছে যেতে পারে সবচেয়ে সুরক্ষিত রাজধানীগুলোতেও। এই ভাঙন সহজে মিলিয়ে যাবে না; এটি উপসাগরীয় দেশগুলোর কৌশলগত হিসাব বদলে দেবে, বিকল্প কাঠামোর সন্ধানকে ত্বরান্বিত করবে এবং পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রতি সন্দেহ আরও গভীর করবে। –পেইমান সালেহি, একজন ইরানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক। তিনি রাজনৈতিক দর্শন ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর সংযোগস্থলে কাজ করছেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



