জমে উঠেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

USসৈয়দ মাসুদ মোস্তফা: মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী  আগামী ১৮ থেকে ২১ জুলাই রিপাবলিকান কনভেনশন। এ কনভেনশনে চূড়ান্ত প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়া হবে। আর ২৫ থেকে ২৮ জুলাই ডেমোক্রেট কনভেনশন। সব প্রক্রিয়া শেষে আগামী ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। জাতীয় এ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র তার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। পূর্ববর্তী জরিপগুলো বলছে, সুপার টুইসডে’র লড়াইয়েও এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। ১১টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ১০টিতেই তার জয় পেয়েছেন তিনি। এদিকে, এ পর্যন্ত ট্রাম্পের পক্ষে রায় দিয়েছেন ৮২ জন ডেলিগেট। ক্রুজের পক্ষে মত দিয়েছেন ১৭ জন। আর রুবিওকে পছন্দ করেছেন ১৬ জন। রিপাবলিকান দলের পক্ষে মনোনয়ন পেতে হলে একজন প্রার্থীকে অন্তত ১ হাজার ২৩৭ জন ডেলিগেটের সমর্থন প্রয়োজন। অন্যদিকে, ডেমোক্রেট দলে যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে আছেন হিলারি ক্লিনটন। তার পক্ষে ৫০৫ জন ডেলিগেট রায় দিয়েছেন। আর বার্নি স্যান্ডার্সকে পছন্দ করেছেন ৭১ জন। সুপার টুইসডে’তে ১ হাজার ৪ জন ডেলিগেটকে নিজের পক্ষে টানতে তারা লড়াইয়ে নামবেন।
জানা গেছে, ইতিমধ্যে তিনটি অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়নের প্রাথমিক ভোটাভুটি হয়েছে। তারমধ্যে আইওয়া এবং নেভাদায় হিলারী জয়ী হয়েছেন। আইওয়া রাজ্যে ভোটের ব্যবধান ছিলো সামান্যই, ০.৩%। নেভাদায় ৫.৫%। অন্যদিকে নিউ হ্যাম্পশায়ারে বার্নি স্যান্ডার্স ২২.৪% ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি সাউথ ক্যারোলিনায় ডেমোক্রেট দলের ভোটাভুটি হতে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত যে ক’টি জনমত জরিপ হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, হিলারী এ রাজ্যে বরাবরই বড় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। সর্বশেষ জরিপে স্যান্ডার্সের  চেয়ে হিলারী শতকরা ২৮ % ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় সাউথ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যে বড় ধরনের জয় পেয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো বলছে, মূলত আফ্রিকান আমেরিকানদের সমর্থনেই প্রত্যাশিত জয় পেয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। জানা গেছে, ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন হিলারি। তিনি পেয়েছেন- ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। মনোনয়ন দৌড়ে তার প্রতিপক্ষ বার্নি স্যান্ডারস ভোট পেয়েছেন ২৬ শতাংশ। বার্নি স্যান্ডারস ভোটের ফল গ্রহণ করে হিলারি ক্লিনটনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যদিও তিনি একই সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
পহেলা মার্চ সুপার টুইসডেতে এগারটি অঙ্গরাজ্যে প্রাইমারীর আগে সাউথ ক্যারোলিনাতেই সর্বশেষ প্রাইমারী অনুষ্ঠিত হলো। সাউথ ক্যারোলিনায় জয়ের মাধ্যমে হিলারি ক্লিনটন এ পর্যন্ত তাঁর তৃতীয় বিজয় অর্জন করলেন। এর আগে তিনি আইওয়া ও নেভাডায় জয় পেয়েছিলেন। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডারস জয় পেয়েছন নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টির সমর্থন আদায় করে চমক সৃষ্টি করেছেন। মাত্র দু’সপ্তাহ আগেও দলীয় মনোনয়ন লড়াইয়ে  তারা দুজন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। পরে দলীয় মনোনয়নে লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মিস্টার ক্রিস্টি সমর্থনের যুক্তি হিসেবে বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেট পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে নবেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারাতে পারবেন। এদিকে ১ মার্চ সুপার টুইসডেতেও হিলারী এবং তার প্রতিপক্ষ ট্রাম্প প্রাইমারীতে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্যগুলোর অধিকাংশতেই হিলারী এগিয়ে রয়েছেন বলে জনমত জরিপগুলোতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ জরিপে হিলারী যেসব রাজ্যে এগিয়ে রয়েছেন তারমধ্যে- মিনেসোটায় ৩৪% ব্যবধানে, জর্জিয়ায় ৩৮% ব্যবধানে, টেক্সাসে ৩২% ব্যবধানে, ভার্জিনিয়ায় ২৭% ব্যবধানে, মিশিগানে ৩৪% ব্যবধানে, ফ্লোরিডায় ৩৬% ব্যবধানে, অহিও ১৫% ব্যবধানে, পেনসিলভানিয়ায় ২২% ব্যবধানে, নিউজার্সি ২৩% ব্যবধানে, নর্থ ক্যারোলিনায় ১৫% ব্যবধানে, মেরিল্যান্ডে ৩০% ব্যবধানে, ইলিনয়েজ ১৯% ব্যবধানে, উটাহ-এ ৭% ব্যবধানে, আলাবামা ২৮% ব্যবধানে, আরকানসাস ২৫% ব্যবধানে, টেনেসি-তে ২৬% ব্যবধানে, লুসিয়ানায় ৩১% ব্যবধানে, মিসিসিপি-তে ৩৪% ব্যবধানে, ওকলাহোমায় ২% ব্যবধানে, নিউইয়র্কে ২১% ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন হিলারী ক্লিন্টন।
অন্যদিকে বার্নি স্যান্ডার্স মাত্র ৪টি রাজ্যে এগিয়ে রয়েছেন। এরমধ্যে দু’টি রাজ্যে অবস্থান বলা যায় প্রায় সমানে সমানে- ম্যাসাচুসেটস এবং উইসকনসিন। বাকি দু’টি রাজ্যে তিনি পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে আছেন- ভারমন্ট এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। ম্যাসাচুসেটসের ব্যাপারে ইতিপূর্বে এক জরিপে স্যান্ডার্সকে ৭% ব্যবধানে এগিয়ে দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু, সর্বশেষ জরিপে উভয়ের মধ্যে ‘টাই’ অর্থাৎ সমান পয়েন্ট পেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উইসকনসিনে মাত্র ১ পয়েন্ট ব্যবধানে স্যান্ডার্স এগিয়ে রয়েছেন বলে জরিপে দেখানো হয়। স্যান্ডার্স তার নিজ রাজ্য ভারমন্টে উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। এখানে ব্যবধান ৭৪%। এছাড়া ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় তিনি ২৮% ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি স্যান্ডার্স যে অঙ্গরাজ্যটিতে জয়ী হয়েছেন ভারমন্টেরই প্রতিবেশী সেই নিউ হ্যাম্পশায়ার। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় সাদা মানুষের হার ৯৩.৯%, ভারমন্টে ৯৬% এবং নিউ হ্যাম্পশায়ারে ৯৩.৯%। নির্বাচন প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনসহ কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো জরিপ হয়নি। কারণ, এ রাজ্যগুলোতে মনোনয়নের ভোটাভুটি হবে শেষের দিকে।
সার্বিক বিবেচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারীটা বেশ জমে উঠেছে বলেই মনে হচ্ছে। ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকানরা আপাতত নিজেদের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রচার-প্রচারণা বেশ তুঙ্গে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান দলের প্রার্থীদের প্রাথমিক নির্বাচনে জেব বুশের পক্ষে এবার প্রচারণায় নেমেছেন বড় ভাই জর্জ ডব্লিউ বুশ। সম্প্রতি সাউথ ক্যারোলিনায় একটি র‌্যালিেেত ছোট ভাইয়ের সঙ্গী হয়েছিলেন বুশ জুনিয়র। এর আগে আইওয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে অনুষ্ঠিত প্রাথমিকে ফ্লোরিডার সাবেক গভর্নর জেব বুশ আশানুরূপ ফল পাননি। আইওয়াতে টেক্সাসের গভর্নর টেড ক্রুজ এবং নিউ হ্যাম্পশায়ারে আলোচিত ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন। জেব বুশ নির্বাচনী ফলে তৃতীয় স্থানটিও পাননি। তা সত্ত্বেও এখনো তিনি হাল ছাড়ছেন না বলেই মনে হচ্ছে।
অবশ্য তিনি প্রচারণা বাবদ ব্যাপক অর্থ ব্যয় করলেও রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে আশানুরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেননি। তাই এর আগে নির্বাচনী প্রচারণায় মা বারবারা বুশকে নামিয়েছিলেন জেব বুশ। এবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বড় ভাই বুশ জুনিয়রের ইমেজকে কাজে লাগাতে চাইছেন তিনি। সাউথ ক্যারোলিনাতে বরাবরই বুশ পরিবার অনেক বেশি সমর্থন পেয়েছে। এর আগে জেব বুশের বাবা ও ভাই এখানে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। বাবা ও ভাইয়ের সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে  নির্বাচনী প্রচার র‌্যালিতে বুশ জুনিয়রকে নিয়ে আসেন জেব বুশ। এ সময় সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশকেও দেখা গেছে।
এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত প্রার্থী হচ্ছেন রিপাবলিকান দলের পক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাশী আলোচিত ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যেও নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। বিশেষ করে মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের কারণে তিনি এবারের নির্বাচনে সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তি। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের পরিণতি কী হবে তা নিয়ে সচেতন মহল বেশ উদ্বিগ্ন। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, রিপাবলিকান দলের পক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাশী আলোচিত ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়াতে আসিয়ান দেশগুলোর সম্মেলনের ফাঁকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবামা এ কথা বলেন। তার মতে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। আর এটি ট্রাম্পের কাজ  নয়।
প্রশ্ন উঠেছে হিলারী ক্লিনটনের প্রার্থীকে নিয়ে। মার্কিনীরা একজন নারী প্রেসিডেন্টকে গ্রহণ করবেন কী-না এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বোদ্ধামহলে। তবে একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে মার্কিনীরা প্রস্তুত কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নন হিলারি ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দল থেকে মনোনয়ন পেতে লড়ছেন সাবেক এ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি। এই সময়ে এক ম্যাগাজিনকে দেয়া  সাক্ষাৎকারে ভোটারদের মনোভাব সম্পর্কে এমন সন্দেহ প্রকাশ করলেন হিলারি।
তবে এ সংশয় সত্ত্বেও ডেমোক্রেট ডেলিগেটরা হিলারিকেই সমর্থন করছেন বেশি। এ পর্যন্ত হিলারিকে সমর্থন জানিয়েছেন ৮৭ জন ডেলিগেট। বিপরীতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্সেরও পক্ষ নিয়েছেন মাত্র ১১ জন। নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই হিলারি বলে আসছেন, তিনি দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়তে চান। অথচ দলীয় প্রাথমিক বাছাইপর্ব চলাকালে ভোগ ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে মার্কিন ভোটারদের মনোভাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে হিলারি বলেন, ‘আমি সত্যিই জানি না। আমি মনে করি পরিস্থিতির এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। তারপরও গভীর উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে যে, মানুষজন হয়তো এ বিষয়ে সচেতন নয় বা তারা এ বিষয়ে কিছু বলছে না।’ তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়টি খুব একটা প্রকাশ্য নয়। ভোটাররা সঠিক ব্যক্তিকেই ভোট দিতে আগ্রহী। আপনি হয়তো কিছুটা আভাসও পেয়ে থাকবেন যে, মার্কিনীরা দেশের শীর্ষ নির্বাহী পদে একজন নারীকে অধিষ্ঠিত দেখতে ততটা স্বস্তি বোধ করেন না।’
এদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্র্যাম্প মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধ করতে মেক্সিকো সীমান্তে তোলার ঘোষণা দেয়ার পর ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ট্র্যাম্প আসলে খ্রিস্টানই নন। রিপাবলিকান সমর্থকেরা ধর্মপরায়ণ পোপ ফ্রান্সিসের কথার কী প্রতিক্রিয়া জানান, আগামী ককাস বা প্রাইমারিতে তা বোঝা যাবে। গোড়া ক্যাথলিকরা সাধারণত রিপাবলিকানদের ভোট দেয়। কারণ, তারা গর্ভপাত আর সমকাম বিরোধী। ট্র্যাম্প বলেছেন, ইসলামিক টেরোরিস্টদের লক্ষ্য হচ্ছে ভ্যাটিকান। ভ্যাটিকান আক্রান্ত হলে তখন পোপ ফ্রান্সিস প্রার্থনায় বসবেন যেন ট্যাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
রিপাবলিকাদের আরেক প্রার্থী ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুবিও ট্র্যাম্পের সঙ্গে বেশ জো লো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন। তাকে বেশ শক্তভাবেই সমর্থন করছেন জনপ্রিয় রিপাবলিকান গভর্নর নিকি হ্যালি। তবে উভয় প্রার্থীকে রিপাবলিকান দল সমর্থন করে না, দল সমর্থন করে জেব বুশকে। জেব বুশ এখনও অনেক পিছিয়েই রয়েছেন। তবে এখনও জাতীয় জরিপে রিপাবলিকান প্রার্থী টেড ক্রুজ সামান্য ব্যবধানে ট্র্যাম্পের চেয়ে এগিয়ে।
ডেমোক্রেটিক পার্টিও মনোনয়নের লড়াইটা বেশ জমে উঠেছে সাবেক ফার্ষ্টলেডি হিলারি ক্লিনটন আর ভারমন্টের সিনেটর স্যান্ডার্সের মধ্যে। তরুণ ভোটারেরা স্যান্ডার্সেও নির্বাচনী প্রচারণা মাতিয়ে তুলেছেন। অর্থনৈতিক বৈষম্যে যাঁতাকলে নিষ্পেষিত আমেরিকান সমাজের  সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন স্যান্ডার্স। তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন বলে মনে করছেন সে দেশের সমাজবাদীরা। বিদায়ী শতকের পাঁচ দশকে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের কথা উচ্চারণ করা ছিল আমেরিকান সমাজে মহাঅপরাধ। ডালাস কন্ট্রিন-এর মূল কথাই ছিল তাই। সমাজবাদীরা বলেছেন, যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে স্যান্ডার্স এখন সমাজতন্ত্রের কথাই বলছেন। ১৯৭০ সালেই উদারনৈতিক অর্থনীতিবিদ কেনিথ গলর্বেইথ ডেমোক্রেটদের পরামর্শ দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের কথা বলার জন্য যদিও বা তখন ডেমোক্রেটরা গলর্বেইথ এর কথা শোনেননি। এখন কিন্তু সিনেটর স্যান্ডার্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারিতে প্রচার প্রচারণায় সমাজতন্ত্রের কথাই সরাসরি বলছেন এবং তরুণরা তার প্রতি ইতিবাচক মনোভাবও দেখাচ্ছেন। ফলে এবারের নির্বাচনী খেলাটা বেশ জমে উঠেছে বলেই মনে হচ্ছে।
এক সময় আমেরিকানরা যা নিষিদ্ধ মনে করতো তা এখন আর তা নেই। অবশ্য তার একটা সঙ্গত কারণও আছে আছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। মূলত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে  মার্কিন সমাজের একটা শ্রেণী পিষ্ঠ হচ্ছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সাথে তাদেরকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে আমেরিকার সমাজ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এখন আমেরিকানরা রাষ্ট্রের কাছে কোনও কিছু প্রত্যাশা না করে নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের। অবশ্য এটাকে ইতিবাচকই মনে করছেন বোদ্ধামহল।
আমেরিকার কর্পোরেট হাউসগুলোর তীব্র বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে ৪৫০টি এলাকায় পৌর মালিকানাধীন ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ১৭টি রাজ্যের রাজ্য পরিষদের রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিল উত্থাপিত হয়েছে। করপোরেট হাউস, বৃহত্তর ব্যাংক- পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাঝে মানুষের কোনও উপকারে আসছে না তাই সরকারি বা জনমালিকানা ব্যবস্থা নীরবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। রাজ্য সরকার স্থানীয় পৌর করপোরেশনগুলো পরীক্ষার ক্ষেত্রে হিসেবে কাজ করছে। এখন যে দিকে মানুষ ধাবিত হচ্ছে, যে প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক, মানুষের গতিরোধ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বিষয়টি আগামী দিনের মার্কিন প্রশাসনের জন্য বড় ধরনের  চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করা হচ্ছে।
১৯৩০ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকা কতগুলো প্রোগ্রেসিভ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিল এবং এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল বৈষম্য কমিয়ে আনা। ইউরোপের দেশগুলোয় অনুরূপ কোনও কর্মসূচি কখনও ছিল না। আমেরিকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করেছিল ইউরোপের দেশগুলোর অনেক আগেই। আমেরিকায় ১৯৬০ সালে ঘণ্টায় সর্বনিম্ন মজুরি ছিল ১০ ডলার। ১৯৬৯ সালে ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১১ ডলার। এখনও পর্যন্ত সে মজুরি অব্যাহত রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে যার ভ্যালু দাঁড়িয়েছে ২০১৬ সালে এসে ৭ ডলার। এমনকি ডেমোক্রেট পার্টির দুজন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং বারাক ওবামার দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তারাও নিম্নতম মজুরি বাড়ানোর কোনও উদ্যোগ নেননি। ফলে মার্কিন সমাজে হতাশা বাড়ছে।
আগেই বলা হয়েছে, গত শতকের তিন দশক থেকে আমেরিকার কর ব্যবস্থা ছিল কল্যাণমূলক। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের পর রিপাবলিক দলের রিগ্যান যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন তিনি কর ব্যবস্থা বিন্যস্ত করা হয়,  যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল সর্বোচ্চ আয়ের ওপর ৮২% কর আরোপ করা হয়। সর্বোচ্চ আয়ের সীমানা ছিল বছরে এক মিলিয়ন ডলারে ওপর। অর্থাৎ কেউ যদি নেট মুনাফা এক মিলিয়ন ডলারের ওপর করেছে তবে তাকে ন্যূনতম ৮ লাখ ২০ হাজার ডলার কর দিতে হয়েছে। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৮০ এর দশকে করের হার ৯১% গিয়ে পৌঁছে ছিল। ১৯৮০ সালে অর্থাৎ যে বছর রিগ্যান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, সে বছরও ৭০% কর দিয়েছেন কর দাতারা। এ কারণে ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছর সম্পদ ওয়ার্ল্ড স্ট্রিটের করপোরেটদের হাতে গিয়ে পুঞ্জিভূত হতে পারেনি। সরকারের হাতে প্রচুর অর্থ ছিল দায়দেনাও হয়েছে কম।
ভিয়েতনাম যুদ্ধেও পর প্রশ্ন উঠে দেশের উন্নয়নে ভাটার টান পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানির আর জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আমেরিকার প্রায় কাছাকাছি। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট রিগ্যান কর ব্যবস্থার পুনঃবিন্যাস করলেন। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রিগ্যান কর স্থির করলেন ২৮%। আগে যে ব্যবস্থা ছিল, তা বিলুপ্তির পর করপোরেট হাউসগুলোর হাতে পুনরায় সম্পদ পুঞ্জিভূত হতে লাগল, যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এখন আমেরিকার সাধারণ মানুষের মাঝে অসন্তোষ প্রবল।
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান নেতা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা দিনে দিনই বাড়ছে। টানা তিন জয়ে তার সম্ভাবনা এখন যথেষ্ট উজ্জ্বল বলে মনে করছেন অনেকে। এরই মধ্যে তাকে আক্রমণ করে বসলেন প্রার্থীতার দৌড়ে থাকা অপর রিপাবলিকান নেতা মার্কো রুবিও। ট্রাম্পকে তিনি একজন ‘নিকৃষ্ট’ ব্যবসায়ী বলে মন্তব্য করেছেন। সুপার টুইসডে’র আগে রিপাবলিকান নেতাদের সর্বশেষ বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছিলেন টেড ক্রুজ, মার্কো রুবিও ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বিতর্কেই ট্রাম্পকে বেশ চুনকাম করেছেন প্রার্থীতার দৌড়ে থাকা বাকি দুই সম্ভাবনাময় নেতা। কম যাননি ট্রাম্পও। প্রার্থীদের অভিবাসন ও স্বাস্থ্য পরিকল্পনাই এবারের বিতর্কের মূখ্য বিষয় ছিল।
বিতর্কে প্রথম সূত্রপাত ঘটান মার্কো রুবিও। তিনি বলেন, উত্তরাধীকার সূত্রে  ট্রাম্প যদি ২০০ মিলিয়ন ডলার না পেতেন, তাহলে তিনি কোথায় থাকতেন, তা কেউ অনুমান করতে পারবে না। তিনি একজন ‘নিকৃষ্ট’ ব্যবসায়ী। এ সময় ট্রাম্পের বিফল অনলাইন শিক্ষা উদ্যোগ, ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুতে কড়া সমালোচনা করেন রুবিও। এছাড়া ট্রাম্পের নির্মাণ প্রকল্পে আমেরিকানদের রেখে বিদেশি কর্মী নিয়োগেরও সমালোচনা করেন তিনি। রুবিও বলেন, এই স্টেজে একমাত্র আপনিই আছেন, যিনি অবৈধভাবে কর্মী নিয়োগ করে জরিমানার মুখে পড়েছেন।
জবাবে উত্তপ্ত ট্রাম্প বলেন, আমি লাখ কর্মী নিয়োগ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। আপনি তো কারোরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেননি। আপনি একজন চতুর অভিনেতা মাত্র। নিজের ক্রেডিট কার্ড নিয়েই আপনাকে সমস্যা পোহাতে হয়। ট্রাম্প এ সময় টেড ক্রুজকে সরাসরি ‘মিথ্যাবাদী’ বলে আক্রমণ করেন। জবাবে ক্রুজ বলেন, কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ অপবাদ দেয়াও একটা মিথ্যা। আপনি এ ধরনের মিথ্যার আশ্রয় প্রতিদিনই নিয়ে থাকেন। ট্রাম্প ক্রুজকে বলেন, আপনার পাশে কেউই নেই। একজন রিপাবলিকান নেতাও আপনাকে সমর্থন করে না। একজনও না…নিজেকে নিয়ে লজ্জা হওয়া উচিত আপনার। আমি জানি, আপনি বিব্রত।
অপরদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন প্রার্থী হিলারী ক্লিন্টনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের মাইনোরিটি দলের নেতা হেরি রেইড সমর্থন ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে ডেমোক্রেট দলের সর্বোচ্চ সংখ্যক কংগ্রেস সদস্যের সমর্থন পেলেন হিলারী ক্লিন্টন। তিনি পেয়েছেন ১৯৩ জন কংগ্রেস সদস্যের সমর্থন, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট দলের তার প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্স পেয়েছেন মাত্র ৩ জনের সমর্থন। অন্য প্রার্থী ‘মার্টিন ও ম্যালি’ পেয়েছেন ১ জনের সমর্থন। যদিও তিনি ইতিমধ্যে প্রার্থীতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
সিনেটে মাইনোরিটি দলের নেতা হেরি রেইড গত ২৫ ফেব্রুয়ারি হিলারী ক্লিন্টনের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, মধ্যবিত্ত জনগণের কল্যাণে বার্নি স্যান্ডর্সের তুলনায় হিলারী ক্লিন্টন ভালো করবেন। তিনি ডেমোক্র্যাটদের প্রতি হিলারীর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
হিলারীর প্রশংসা করে হেরি রেইড বলেন, বিগত বছরগুলোতে তার সঙ্গে কাজ করার সময় আমি কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছি। তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কিছু কাজ শুরু করেছেন। তিনি এ বিষয়ে ভালো বোঝেনও। পদে থাকাকালে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, হেরি রেইড নেভাদা থেকে নির্বাচিত সিনেটর। গত ২০ ফেব্রুয়ারি নেভাদায় ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়নের ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু, তখন পর্যন্ত হেরি রেইড কাউকে সমর্থন করেননি। এর আগে ২০০৮ সালে ওবামা এবং হিলারীর মধ্যে মনোনয়ন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় হেরি রেইড ওবামাকে সমর্থন করেছিলেন।
সার্বিক দিক বিবেচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারীটা বেশ গতি পেয়েছে। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা অবশ্য এখনও হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তবে প্রাইমারীতে হাওয়া হিলারী আর ট্রাম্পের পালেই লাগছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে শেষটা দেখার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে বৈ-কি!

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button