স্বাগত ২০১৬

New Yearসাদেকুর রহমান: বৃহস্পতিবার অস্তগামী সূর্যের সঙ্গেই বিদায় নিয়েছে ২০১৫ সাল। তারপর ছিল পশ্চিমা ধাঁচের থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের বেলেল্লাপনা। কুয়াশার চাদর সরিয়ে আজ শুক্রবার যখন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঁকি দিয়েছে ততক্ষণে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার নতুন বর্ষ এসে হাজির। হতাশা-গ্লানি আর হানাহানির সদ্য অতীত পিছে ফেলে নতুন সূর্য আলোকিত করবে সব মানবের জীবন- এ প্রত্যাশায় যাত্রা শুরু আরো এক পহেলা জানুয়ারির। স্বাগত ২০১৬, শুভ নববর্ষ। ঈসায়ী তথা ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন আজ। সুখী-সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও শান্তির বিশ্বের জন্য প্রার্থনার দিন আজ।
বিদায়ী বছরটি বেশ ঘটনাবহুল ছিল, ছিল প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ঘনঘটা। রাজনৈতিক অস্থিরতার বছরটিতে চরম অস্বস্তিতে ছিল বিশ্বের সকল শ্রেণীর মানুষ। সন্ত্রাসের দানব এতটাই বেপরোয়া ছিল যে মাতৃগর্ভেও নিরাপদ ছিল না অনাগত শিশু। প্রতিহিংসার আগুনে পুড়েছে বহু প্রাণ, সাথে স্বপ্ন-সংসার। তবুও আশায় বুক বাঁধে মানুষ। নববর্ষকে ঘিরে তাই অনেক প্রত্যাশা, অনেক স্বপ্ন, অনেক কল্পনা। যদিও সময়ের বিচারে খুব দীর্ঘ নয় একটি বছর, মাত্র তিনশো পঁয়ষট্টিটি দিন। তবু মানুষকে প্রতিটি দিনই ইঙ্গিতে-ইশারায় ডাকে। অজানা আগামীর পথে ডেকে নিয়ে যায়। দিন থেমে থাকে না, রাতও নয়। আলো ও আঁধারের অবিচ্ছিন্ন আবর্তনের ভেতর দিয়ে এবার এগিয়ে যাবে নতুন বছর। পুরনো বছরের ধূসর দিনগুলোর কথাও পাশাপাশি আমাদের মনে পড়বে কী পেয়েছি, কী হারিয়েছি।
সেই একই সূর্য, একইভাবে পূবাকাশ রাঙিয়ে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো জেগে উঠেছে। তবু তার উদয় ভিন্নতর। আজকের দিনটি আলাদা, কারণ একটি নতুন বর্ষপরিক্রমা শুরু হলো আজ থেকে। নতুনের প্রতি সব সময়ই মানুষের থাকে বিশেষ আগ্রহ ও উদ্দীপনা। নতুনের মধ্যে নিহিত থাকে অমিত সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণ করার সুযোগ করে দিতে এলো নতুন বছর।
ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, খৃস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেন। ১লা জানুয়ারি পালনের ইতিহাস ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে রোমান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী কর্তৃক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে। ইরানে নববর্ষ বা নওরোজ শুরু হয় পুরনো বছরের শেষ বুধবার এবং উৎসব চলতে থাকে নতুন বছরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত।
সাধারণভাবে প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জমশীদ খৃস্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নওরোজের প্রবর্তন করেছিলেন এবং এ ধারাবাহিকতা এখনো পারস্য তথা ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব পালিত হয়। মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ বা আকিতু শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষুবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বর। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রীকদের নববর্ষ শুরু হতো খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খৃস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১ জানুয়ারিতে। ইহুদীদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথম দিন গোঁড়া ইহুদীদের মতে সেই মাসের দ্বিতীয় দিন। মোটামুটিভাবে তিসরি মাস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ, তারা ধারণা করতো, এদিন দেবদূত গ্যােিব্রয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশু খৃস্টের জন্মবার্তা জ্ঞাপন করে। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর।
বাদশাহ আকবরের ফরমান অনুযায়ী আমীর ফতেহ উল্লাহ্ শিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল চালু হয় ১০ মার্চ ১৫৬৩ সালে। ইংরেজ আমলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হলেও রাজস্ব আদায়ে ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা সাল তথা ফসলি সন বেশি ব্যবহার করা হতো।
বিশ্ববাসী এক সুতায় গাঁথা: ১ জানুয়ারি ‘ইংরেজি নববর্ষ’ যদিও এটি ইংরেজি ভাষাভাষীর নিজস্ব উৎসব, তবুও সারাবিশ্বেই দিনটি মহাধুমধামে উদযাপিত হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববাসী মেতে ওঠে নানা আয়োজনে। প্রিয়জনকে নিয়ে আনন্দ করতে একটুও কার্পণ্য করে না বিশ্ববাসী এই দিনে। বছরের এই উৎসবটি লুফে নিতে বাংলাদেশের মানুষও পিছিয়ে নেই। শহর-নগর-গ্রাম-বন্দরসহ সারা দেশে যেন বয়ে চলে এক খুশির বন্যা। আকাশ সংস্কৃতির এই জোয়ারে অনেক কিছুই ভেসে গেছে। বাঙালির রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, রয়েছে বর্ষবরণ উৎসব পহেলা বৈশাখ। তবুও ১ জানুয়ারি উদযাপনে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মাঝে দেখা যায় খুব বেশি উচ্ছ্বাস। প্রতিবছর এভাবেই স্বাজাত্য ভুলে ভিন্ন সংস্কৃতি পালিত হচ্ছে। নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিশেষ বাণী দিয়েছেন। এছাড়া জাতীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ বাণী প্রদানের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে এসএমএস ও কার্ড বিনিময়ের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুনকে বরণ করার উৎসবে সারা বিশ্বের একাত্মতা বিশ্ববাসীকে একটু হলেও এক সুতায় গেঁথে রাখে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে নতুনকে নিয়ে এগিয়ে চলাই হোক জীবন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button