মার্কিন প্রভাব কী চ্যালেঞ্জের মুখে ?

USA in Asiaসত্যরাজ দাস: সাম্প্রতিক বিশ্বে ক্রমেই দুর্বল ও ক্ষীণ হয়ে আসছে মার্কিন প্রভাব বলয়। শুধু মার্কিন নয় বরং বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে পুরো পশ্চিমী শক্তি রীতিমত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিনীদের একটি উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে। যদিও বিষয়টি কিছুটা হলেও বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় বিশ্ব পরিস্থিতির উপর মার্কিন প্রভাব ইতিবাচক হিসাবেই দেখতে হবে। বিশ্ব ইতিহাস সে কথারই সাক্ষ্য দেয়। যা অস্বীকার করা সত্যের অপলাপই হবে। হালে বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন ও পশ্চিমী প্রভাব অবনোমন হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ক্রমেই  মার্কিন প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু হয়ে দেখা দিয়েছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল বিশ্ব নিশ্চিত করেছে। ফলে বিশ্বে শান্তি ও কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধিও এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের অবস্থানে নেই। বিষয়টি শুধু ইরাকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। যদিও সেখানে  এই মার্কিন দুর্বলতা খুবই স্পষ্ট।
ইরাকে শুধু স্থিতিশীলতাই মার্কিন প্রভাবের বাইরে নয় বরং সেখানকার বাস্তবতা হচ্ছে পুরো বিষয়টি পরাশক্তির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবুও শুধু ইরাকই মার্কিন শক্তির অধোগতির সূচক নয় বরং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এর বিস্তৃতি রয়েছে। এই শক্তির ক্ষয়িষ্ণুতার পেছনে বেশ কিছু বিষয় সক্রিয়। এগুলো কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, চীনের অর্থনীতির অভূতপূর্ব উত্থান। তারপর রয়েছে পারমাণবিক শক্তির ক্রম বিস্তৃতি, মুক্ত বাণিজ্যে অধিকাংশ রাষ্ট্রের অনীহা, সামাজিক নিরাপত্তার ব্যয় বৃদ্ধি, ফলে সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাসের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র  ইউরোপ ও জাপানের শক্তি হ্রাস। যা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ।
সর্বসাম্প্রতিক বাস্তবতায় প্যাক্স এমেরিকানার উত্তরাধিকার উপেক্ষা করার মতো নয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের পর পৃথিবীতে আর এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল। এত ব্যাপকহারে পৃথিবীতে আর কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বলেই ধারণা করা হয়। যদিও সংঘাতময় বিশ্ব কখনোই শান্ত ছিল না। অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ, চীনের গৃহযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার সংঘর্ষ।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্ড কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী কঙ্গোতে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ভিয়েতনামে ২০ লাখের কাছাকাছি এবং কোরিয়া ও চীনে আরও কম। পৃথিবীতে সঙ্ঘাত বিরাজ করলেও তার ক্ষয়-ক্ষতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এর পেছনে পরোক্ষভাবে হলেও মার্কিন শক্তির অবদান অনস্বীকার্য। যদিও কেউ কেউ তা স্বীকার করতে চান না। আর স্বীকার না করলেও সত্য কখনো অসার হয়ে যায় না।
মার্কিন সামরিক শক্তির সমর্থনে বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ এবং জাপানে গণতন্ত্রের অভ্যুদয় হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে পৃথিবীতে ৮৯টি স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত দেশ ছিল এবং গণতান্ত্রিক দেশ ছিল মাত্র ৩৫টি। ২০০৫ সাল নাগাদ সে চিত্র পাল্টে যায়। সে সময়ে পৃথিবীতে মাত্র ২৯টি স্বৈরশাসিত দেশ অবশিষ্ট ছিল এবং গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল  ৮৮টি তে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে বিশ্ব যে সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন বলেন, ১৯৫০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ছয়গুণ। বিশ্ব বাণিজ্য ২০ গুণ বেড়েছিল। প্রবৃদ্ধির এই হার এর আগে মানবজাতির জন্য কল্পনাতীত। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছিল গাণিতিক হারে। ১৯৫০ সালের পর থেকে মানুষের আয় বেড়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬ গুণ, জাপানে ১১ গুণ এবং স্পেনে ৬ গুণ। অপেক্ষাকৃত উচ্চমান থেকেও জার্মানীতে এই আয় বেড়েছে পাঁচ গুণ, ফ্রান্সে চার গুণ ও যুক্তরাষ্ট্রে তিন গুণ। শেষোক্ত সমৃদ্ধ দেশগুলোতে আয় ইতোপূর্বেই ঈর্ষণীয় ছিল। তাই তাদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম হারে প্রবৃদ্ধিও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে বিশ্ব ইতিহাসের এই বিস্ময়কর সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি এমনিতেই হয়েছিল বলে মনে করা ঠিক হবে না। সেই মার্শাল প্লানের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনগুলোর ওপর একটি স্থিতিশীল প্রভাব রেখেছিল। যদিও ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো কিছু কিছু অশুভ ক্রিয়া-কর্মের জন্য অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র দায়ি ছিল। এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় সত্তর দশকের মুদ্রাস্ফীতি এবং বর্তমান ইরাকের কারণে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা ইতিহাসের বিপথগামীতারই অংশ। মার্কিন শক্তির সাফল্যের দিকগুলোতে বিশ্বের নিরাপত্তায় একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বময় বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং ব্যবস্থাপনা বিশ্বকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের চরম দুর্দিনেও মুক্ত রেখেছে বাজার। অন্য কোন শক্তির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দেয়া মোটেই সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু এই পরাশক্তি প্রায় বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি সত্ত্বেও তার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমদানি বাণিজ্য সঙ্কোচনেরও কোন চেষ্টা করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃতিত্ব ও উদারতা এখানেই।
মার্কিনীদের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শিক্ষাই ছিল এমন একটি বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে যুক্তরাষ্ট্রকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে  হবে। তাই দেশটি স্বল্পমেয়াদি বেশ কিছু দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ও ঝুঁকির সম্ভাবনাকে এড়াতে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ জয়ের পর এক ধরনের অপরাজেয় মনোভাব দেশটিকে মাত্রাতিরিক্ত আস্থা দিয়েছিল। আর অতি আস্থায় বোধ হয় তাদের জন্য বিভীষণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
মার্কিনীরা ভেবেছিল, তাদের প্যাক্স অ্যামেরিকানার চিরস্থায়ী। তাদের ধারণা, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার সাফল্যের পথে আর কোন বাধা নেই। তারা আরও ভেবেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি থেকে মহাপরাশক্তিতে বা হাইপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে। এমন প্রবণতাই প্যাক্স অ্যামেরিকানার কাল হয়েছে। সভ্যতার উত্থান-পতনের কথা বিস্মৃতি হয়েছে। কিন্তু অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও পতনের চূড়ান্ত সময় উপনীতি না হলেও তার উপসর্গগুলা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন ও পশ্চিমী শক্তির ক্রমেই প্রভাব বলয় ক্ষীণ হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে তাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ হিসাবে দেখা দিয়েছে চীন ও রাশিয়ার ঐক্য। স্নায়ুযুদ্ধের মার্কিন ও পশ্চিমী শক্তি এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন কখনো হয়নি। সম্প্রতি প্রাপ্ত খবরে প্রকাশিত হয়েছে, আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে চীন এবং রাশিয়া দৃঢ়ভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের প্রেস টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বিশ্লেষক ও অ্যাটাক দ্যা সিস্টেম ডট কম’র পরিচালক কিথ প্রেসটন।
তিনি বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে বেইজিংয়ের অবস্থান দেখে তাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে। মূলত পূর্ব এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব বিস্তারে চীন উদ্বিগ্ন। প্রেসটন বলেন, আমেরিকার প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য চীন জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং যেভাবেই হোক প্রতিরোধের জন্য একটি সামরিক অবস্থান তৈরি করছে। যা মার্কিন ও পশ্চিমী শক্তির জন্য রীতিমত উদ্বেগের।
দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন সামরিক প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে একটি কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করেছে বেইজিং। কিন্তু আমেরিকা বলছে, তারা ওই কৃত্রিম দ্বীপে চীনের সার্বভৌমত্ব মানবে না। গত ২৪ অক্টোবর বার্তা সংস্থা রয়টার্স খবর দিয়েছে যে, সম্ভবত কয়েক দিনের মধ্যে ওই দ্বীপের ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে আমেরিকা তার যুদ্ধজাহাজ কিংবা সামরিক বিমান পাঠাবে। তবে চলতি মাসেই চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চীন কাউকেই তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে দেবে না।
মার্কিনী ও পশ্চিমী শক্তির জন্য সময়টা মোটেই অনুকূল নয় বলেই মনে হচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমেই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মার্কিনী ইরাক অভিযান চালিয়েছিল কালের বিবর্তনে তা ভুল বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। এমন কী ইরাক অভিযানের মার্কিন মিত্র সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও ইরাক অভিযানকে ভুল বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেসব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাকে হামলা করা হয়েছিল সেসবকেও ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছে খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। হয়তো নিকট-ভবিষ্যতে মার্কিনীদেরও একথার আত্মস্বীকৃতি দিতে হবে। এমতাবস্থায় মার্কিনীরা আবার কী ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, না গাণিতিকহারে ক্ষমতার প্রভাব বলয় ক্রমহ্রাস পেতে পেতে তা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে তা অবশ্য দিব্বি দিয়ে এখনও বলা যাচ্ছে না। হবে পরিস্থিতি অনুকূল বলে মনে করার কোন কারণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button