আল্লামা ইকবাল ও তারানায়ে হিন্দি

A Hamidহামিদ মীর: ইকবালের দুশমনেরা আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। তাদের বেদনা ও কষ্টের কারণ, ৯ মে ২০১৫ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পাকিস্তানের জাতীয় কবি ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের জন্য ‘তারানায়ে হিন্দি’ সম্মাননা পুরস্কার ঘোষণা করেন। কলকাতার উর্দু অ্যাকাডেমি আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘জশনে ইকবাল’-এ আল্লামা ইকবালের পৌত্র ওয়ালিদ ইকবাল এ বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করেন। আল্লামা ইকবালের প্রতি এ সম্মান প্রদর্শনে ভারতে কিছু হিন্দু উগ্রবাদী এবং পাকিস্তানে কিছু লিবারেল ফ্যাসিস্ট বেদনাহত হয়ে কাতরাচ্ছে। কেননা এরা সবসময় চাঁদের দিকে থুথু নিক্ষেপের মন্দ অভ্যাসে লিপ্ত। ধর্মীয় উগ্রবাদী ও সেকুলারিজমের মিথ্যা প্রচারকেরা আল্লামা ইকবালের জীবদ্দশাতেও তার দুশমন ছিল। তার ওফাতের পরও দুশমন রয়ে গেছে। এ দুর্ভাগা লোকেরা আল্লামা ইকবালকে এক আবেগপ্রবণ কবি ও মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া সম্মানের আত্মগৌরবে বন্দী আখ্যায়িত করে সস্তা খ্যাতি লাভের নিন্দনীয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের উর্দু অ্যাকাডেমির ‘জশনে ইকবাল’-এ প্রাচ্যের কবির চিন্তাদর্শনের ওপর যে আলোচনা হয়েছে তা দিয়ে সাহিত্য ও শিক্ষা পরিমণ্ডলে নয়া আলোচনা-পর্যালোচনার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। আল্লামা ইকবালকে সম্মাননা দেয়া হলো এমন এক ঐতিহাসিক কলকাতা শহরে, যা বাংলা ভাষার বেশ বড় কবি রবীন্দ্র ঠাকুরের জন্মভূমি। ঠাকুর এই সম্মানের অধিকারী যে, একটি নয়, বরং দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত তার কবিতা থেকে নেয়া। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ মূলত ঠাকুরের কবিতা। আল্লামা ইকবাল ও ঠাকুর একে অপরের সমকালীন ছিলেন। উভয়ের জীবন ও কবিত্বের গভীর অধ্যয়ন করে জানা যায়, ঠাকুর তার বিখ্যাত কবিতা ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯০৫ সালে রচনা করেছেন।
এটা সেই ১৯০৫ সাল, যখন অখণ্ড ভারতের ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে ভাগ করে, আর ঠাকুর তার সোনার বাংলা ভাগের (বঙ্গভঙ্গের) বিরোধিতায় কবিসুলভ প্রতিবাদ করেন। আল্লামা ইকবালের ‘তারানায়ে হিন্দি’ এক বছর আগে ১৬ আগস্ট, ১৯০৪ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রকাশ হয় এবং ভারতের চতুর্দিকে তা ছড়িয়ে পড়ে। ‘তারানায়ে হিন্দি’র প্রথম ছত্র ছোট-বড় সবার মুখে মুখে ছিল-
সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা/হাম বুলবুলে হেঁ ইস কী ইয়ে গুলিস্তাঁ হামারা
সারা বিশ্বের চেয়ে সেরা হিন্দুস্তান আমাদের/আমরা বুলবুল এখানকার এতো পুষ্পোদ্যান আমাদের।
‘তারানায়ে হিন্দি’ লেখার পর ইকবাল উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যান। কয়েক বছর পর ফিরে এলে তার চিন্তাদর্শনে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি ‘তারানায়ে হিন্দি’র অনুকরণে ১৯১০ সালে ‘তারানায়ে মিল্লি’ রচনা করেন এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের রূপরেখা এভাবে প্রকাশ করেন-
চীন ও আরাব হামারা, হিন্দুস্তাঁ হামারা/মুসলিম হেঁ হাম, ওয়াতান হ্যায় সারা জাহাঁ হামারা/ তাওহীদ কী আমানাত সীনূঁ মেঁ হ্যায় হামারা/ আসাঁ নেহী মিটানা, নাম ও নিশাঁ হামারা।
চীন ও আরব আমাদের, হিন্দুস্তান আমাদের/ মুসলিম যে মোরা, সারা পৃথিবীটাই নিজভূমি আমাদের/তৌহিদের আমানত রয়েছে সিনাতে মোদের/মিটানো সহজ নয়, নাম-নিশানা মোদের।
অপর দিকে, ঠাকুরের অবস্থানেরও পরিবর্তান দেখা যায়। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করলে ঠাকুর নমনীয় হয়ে আসেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক চিফ জাস্টিস মারকান্ডে কাটজু সম্প্রতি লিখেছেন, তার গবেষণা অনুযায়ী ঠাকুর ১৯১১ সালে ‘জনগণমন’ ব্রিটিশ রাজা জর্জ পঞ্চমের সন্তুষ্টির জন্য লিখেছিলেন। ওই বছর জর্জ পঞ্চম হিন্দুস্তান সফরে আসেন। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস তার প্রশংসায় একটি প্রস্তাবও অনুমোদন করেছিল। জাস্টিস মারকান্ডে কাটজু ঠাকুরের ব্যাপারে অনেক বড় কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার কথাগুলো ঠাকুরের ভক্তদের মনে আঘাত করেছে। এ জন্য জাস্টিস কাটজুর কথাগুলো এখানে উল্লেখ করছি না। কেননা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কারো মনে আঘাত দেয়া মোটেও উচিত নয়। তবে ভারতে এ বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে যে, ঠাকুর বড় কবি ছিলেন নাকি ইকবাল? ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এ নোবেল পুরস্কার কাব্যসঙ্কলন গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের পর দেয়া হয়েছে।
ভারতের বিশিষ্ট গবেষক সুমিত এস পালের অভিমত হচ্ছে, ঠাকুর ও ইকবাল উভয়ে রুমি ও হাফিজের দ্বারা প্রভাবিত। ইকবাল রুমিকে তার শিক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেছেন, আর হাফিজের প্রশংসা করেছেন অনেক। ঠাকুর হাফিজের কবিতার অনুকরণে বাংলায় কবিতা রচনা শুরু করেন। সুমিতের মতে গীতাঞ্জলিতে কমপক্ষে ১০৩টি শ্লোক রয়েছে, যা হাফিজের কাব্যের অনুকরণে রচিত। তারপরও ঠাকুরের কাব্যপ্রতিভার শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ঠাকুর তার বিরুদ্ধে আরোপিত কিছু অভিযোগের জবাব ১৯৩৭ সালে দিয়েছিলেন। ঠাকুর ও ইকবাল একে অপরের সমকালীন হওয়া সত্ত্বেও সারা জীবনে কখনোই একে অপরের সাথে তাদের সাক্ষাৎ ঘটেনি। ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও কবি ড. অমিয় চক্রবর্তী ইকবালের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে আল্লামা ইকবালের ‘তারানায়ে মিল্লি’র বাংলায় অনুবাদ করেন, যা কলকাতায় মাসিক আল এছলাম-এ প্রকাশ হয়েছিল। ড. চক্রবর্তী ১৯২৪ সাল থেকে নিয়ে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ঠাকুরের সেক্রেটারিও ছিলেন। তিনি কয়েকবার লাহোর যান এবং আল্লামা ইকবালের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৩৪ সালে ঠাকুর আল্লামা ইকবালের খোঁজখবর নেয়ার জন্য বিশেষ করে লাহোর যান। কিন্তু ইকবাল লাহোরে না থাকায় আর সাক্ষাৎ হয়নি। ওই বছর ঠাকুর কলকাতায় এক বক্তৃতার সময় রাস মাসউদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ইকবালের কাব্যচর্চা উন্নতমানের মানবতার শিক্ষা দেয়। আর আমার লক্ষ্যও মানবতার সেবা। কিছু সমালোচকের অভিমত হচ্ছে, ইকবাল মূলত আন্দোলন ও বিপ্লবের কবি ছিলেন। আর ঠাকুর ছিলেন রক্ষণশীল কবি। উভয়কেই ব্রিটিশ সরকার ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে। এর পরেও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে বৈরিতা ও প্রতিবাদ ইকবালের কবিতায় পাওয়া যায়, তা ঠাকুরের কবিতায় দেখা যায় না। আর সম্ভবত ওই কারণেই ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আর ইকবালকে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২০১১ সালে কলকাতার একটি স্টেডিয়ামের নাম ঠাকুরের গীতাঞ্জলির নামে নামকরণ করেন। ২০১৫ সালে তিনি আল্লামা ইকবালের জন্য ‘তারানায়ে হিন্দি’ পুরস্কারের পাশাপাশি কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল চেয়ার প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দেন। কিছু বিশ্লেষকের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে নতুন নির্বাচন আসন্ন। মমতা ব্যানার্জি আল্লামা ইকবালের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে মূলত বাঙালি মুসলমানদের ভোট হাসিল করার চেষ্টা করেছেন। এ কথাও বলা হয়েছে, মমতা ব্যানার্জি মূলত ইকবালের মধ্যপন্থা ও ইনসাফবাদিতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ইকবালকে কট্টরবাদীরা কাফের এবং সেকুলার কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করত। মমতা ব্যানার্জিকেও বিজেপি ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া উভয়েরই বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মমতা কিছু দিন আগে আল্লামা ইকবালের পক্ষ থেকে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ১৯৩৭ সালে লেখা একটি পত্র পাঠ করেন। ওই পত্রে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে ইসলামের খুব কাছের বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং একটি নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারের রূপরেখার প্রস্তাব করা হয়। মমতা ব্যানার্জি ওই পত্রগুলো দিয়ে বেশ প্রভাবিত হন। কেননা তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস এজন্য গঠন করেছেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থার মাঝে যেন এক নতুন পথ বের করা যায়। উর্দু অ্যাকাডেমি মমতা ব্যানার্জিকেও ‘পাসবানে উর্দু’ (উর্দুর পাহারাদার) খেতাবে ভূষিত করেছে। ‘পাসবানে উর্দু’র প্রতি কৃতজ্ঞতা যে, তিনি আল্লামা ইকবালের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু ইকবালের আসল পরিচয় শুধু তার এক ‘তারানায়ে হিন্দি’ নয়, বরং ‘তারানায়ে মিল্লি’ও তার পরিচয়। মোট কথা নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে মমতা ব্যানার্জির পক্ষ থেকে পাকিস্তানের জাতীয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ বৈকি। আমাদের আগামী বংশধররা যার সুফল ভোগ করবে।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৪ জুন, ২০১৫ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button