অনন্য প্রতিভা মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান

Ruhul Aminমোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী: বাংলাদেশের আলেম সমাজের মধ্যে বর্তমানে যারা সাহিত্য-সাংবাদিকতায়, ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন তৎপরতায়, তাবলীগ-প্রচারণায় এবং পুস্তক রচনা-সম্পাদনার প্রথম সারিতে অবস্থান করছেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি আলহাজ মাওলানা রূহুল আমীন খান অন্যতম। ঐতিহ্যবাহী এক সম্ভ্রান্ত পীর বংশের কৃতিসন্তান একজন প্রখ্যাত আলেম হওয়ার পাশাপাশি তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু তিনি আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে তার সমগ্র জীবনে শিক্ষা ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধগুলোকে জীবন ও কর্মে এবং ঘরোয়া জীবনে কঠোরভাবে লালন-পালন করে যাচ্ছেন। পারিবারিক জীবনের এ বৈশিষ্ট্য তাকে অনেকটা আলাদা করে রাখলেও আধুনিক জগত সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সজাগ, যা তার কর্মপদ্ধতিতে প্রতিফলিত। এদিক থেকে তিনি আধুনিক মনস্ক এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব।
পীর পরিবারের এ কৃতি সন্তান বাস্তব জীবনে পীর-আওলিয়ার অনুসারী ভক্ত- যারা ছিলেন খাটি শরীয়ত ও সুন্নাতে রাসূলের অনুগামী। একজন সুবক্তা ও সুলেখক হিসেবে দুই ধারায়ই তার সমান কৃতিত্ব। আলেমে-দ্বীন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিতি তার পারিবারিক ঐতিহ্য। লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে একই সঙ্গে তিনি প্রতিভার যে সাক্ষর রেখে চলেছেন তা অনস্বীকার্য। একজন ছড়াকার-কবি রূপে ইতিমধ্যে কবি রূহুল আমীন খান সুধী সাহিত্যিক মহলে সমাদৃত ও সুখ্যাতি লাভ করেছেন। স্বার্থক অনুবাদক, ভাষ্যকার, যোগ্য  উপস্থাপক এবং আদর্শিক সৎ, সাহসী বলে সমসাময়িকদের মধ্যে গণ্য হয়েছেন। সুকঠিন বহু আরবি-ফারসি-উর্দু কবিতা-কাসিদাকে অতি চমৎকারভাবে কাব্যিক অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করেছেন। পীর সাধক বংশের এ গুণী আলেম লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নরূপ-
মাওলানা রূহুল আমীন খান এক সম্ভ্রান্ত আলেম ও পীর  পরিবারের কৃতি সন্তান। তার পিতা মাওলানা ইউনুছ খান ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত পীরে কামেল হজরত মাওলানা নেছার উদ্দিন আহমদ (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা। তিনি ছিলেন  বাংলাদেশের প্রথম কামেল (টাইটেল) মাদ্রাসা (কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার পর) দারুচ্ছুন্নাত ছারছীনা আলিয়ার প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা। মাওলানা ইউনুছ খানের নবম পুরুষ পর্যন্ত তারা প্রত্যেকেই ধর্মীয় আলেম ও এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে  জানা যায়। ইসলামী শিক্ষা বিস্তার মানুষকে শরীয়ত ও মারেফতের শিক্ষা-দীক্ষা দান এবং জনসেবা ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় কীর্তির জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। তার এসব কীর্তির মধ্যে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন- তার নিজ বাড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, হাফেজী মাদ্রাসা, চৈতী নেছারিয়া ফাযিল মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং এবং একটি দ্বিতল জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মাওলানা রূহুল আমীন খানের পৈত্রিক ভূমি পটুয়াখালী জেলার মির্জাপুর থানাধীন চৈতী গ্রামে এবং সেখানে তিনি ১৯৪২ সালের ১২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা বাড়ির মাদ্রাসায় শুরু হয় এবং সেখানে থেকে আলেম পাস করার পর তিনি তার পিতার পীরের মাদ্রাসা দারুচ্ছুন্নাত ছারছীনা আলিয়া থেকে কামেলে হাদিসের ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন বরিশালের চাখার ফজলুল হক কলেজে এবং ঢাকার তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী কলেজ)।
১৯৬৬ সালে টাইটেল পাস করার পর রূহুল আমীন খান সাহেব আধুনিক শিক্ষা লাভ করে কর্মজীবনের সূচনা করেন সেই ছারছীনা মাদ্রাসায় অধ্যাপনার মাধ্যমে। এ সময় তিনি সাংবাদিকতার সাথেও যুক্ত হয়ে পড়েন। আর তা এইভাবে যে, মরহুম পীর মাওলানা নেছার উদ্দীন (রহ.) প্রতিষ্ঠিত বাংলা পাক্ষিক তাবলীগের তখন প্রায় অর্ধশত বছর অতিবাহিত হয়েছে যা প্রকাশিত হতো দারুচ্ছুন্নাত ছারছীনা হতে। যেহেতু তিনি কিশোর বয়স থেকেই লেখালেখি করে আসছিলেন, তাই তাবলীগ  তাকে  সাংবাদিকতার পথে অগ্রসর হতে সহায়ক হয়, তাকে এ পত্রিকার সম্পাদনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অধ্যাপনার পাশাপাশি তার সাংবাদিকতার সূচনা এখানেই। তিনি ছারছীনা হতে ঢাকায় চলে আসার পর সাংবাদিকতাকেই আঁকড়ে ধরেন এবং ঢাকার বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত ‘ইশায়াত’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন পর্যন্ত আলেম সমাজের মধ্যে সাংবাদিকতার ময়দানে খুব বেশি লোক পদার্পণ করেছেন বলে জানা যায় না। মাওলানা রূহুল আমীন খান দেশে প্রচলিত দুই ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাই প্রিয় পেশা হিসেবে বেছে নেন, যার পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল মরহুম মাওলানা এমএ মান্নান (রহ.)-এর।
মাওলানা রূহুল আমীন খান সাহেবের সত্যিকারের কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকায় আসার পর থেকে, ১৯৭৬ সালে দেশে প্রখ্যাত আলেম, রাজনীতিবিদ, সংগঠক এবং অসাধারণ প্রতিভা মরহুম মাওলানা এমএ মান্নানের সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে; মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন ‘জমিয়াতুল মোদার্রেছীন’কে সংগঠিত করার কাজে সভাপতি  হিসেবে তিনি যখন তৎপরতা আরম্ভ করেন, তখন তার সাহায্যকারী হিসেবে রূহুল আমীন খান সাহেব আত্মনিয়োগ করেন। তাকে এ সংগঠনের জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। এখান থেকে তার সাংগঠনিক দক্ষতাসহ নানামুখী প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। হজরত মরহুম মাওলানার সুযোগ্য নেতৃত্বে তার প্রাণপ্রিয় সংগঠন জমিয়াত উত্তরোত্তর অগ্রগতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। রূহুল আমীন সাহেবও মাওলানার অন্যতম বিশ্বস্ত ও পরমভক্ত অনুসারী হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এর ফলে তার সম্ভাবনাময় জীবনের অনেক দ্বার খুলে যেতে শুরু করে।
হজরত মরহুম মাওলানা অনেকদিন থেকে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন বাংলাদেশের আলেম সমাজের একখানা মুখপত্র প্রকাশের, যাতে  জমিয়াতের তৎপরতার কথাবার্তাও থাকবে। কারণ তখন পর্যন্ত  যেসব দৈনিক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতো, সেগুলোর সবটাতে জমিয়াতের পক্ষ হতে প্রেরিত খবরাখবর ছাপা হতো না। কোন কোনটিতে সংক্ষিপ্ত ছাপা হলেও বিকৃতভাবে পরিবেশনের দৃষ্টান্তও কম ছিল না।
মরহুম মাওলানা সাহেব রূহুল আমীন সাহেবকে সম্পাদক করে সাপ্তাহিক ইনকিলাব নাম দিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ডিকলারেশন নেন। পরে সাপ্তাহিক নয়, ঐ নামেই একটি দৈনিক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, বলে তার বক্তব্য হতে জানা যায়। নাম পরিবর্তিত ডিকলারেশন অনুযায়ী ১৯৮৬ সালের ৪ জুন দৈনিক ইনকিলাব আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা এমএ মান্নানের সাথে এ ব্যাপারে সার্বিক পরিকল্পনায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। তাকে এ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক করা হয়। বর্তমানেও এ পদে বহাল থেকে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। পত্রিকার নানাবিধ উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হজরত মরহুম মাওলানার আহ্বানে ১৯৮৯ সালে আমি দৈনিক আজাদ হতে ইনকিলাবে যোগদান করি এবং মাওলানা খানের সাথেই চলমান কর্মরত আছি।
মরহুম মাওলানা এমএ মান্নান (রহ.)-এর জীবদ্দশায় ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মাওলানা রূহুল আমীন খান দীর্ঘকাল তার সান্নিধ্যেই থেকেছেন এবং একদিকে তার কর্মকা-ে সহযোগিতা করেছেন, অভিজ্ঞতা-দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং অপরদিকে তার ফয়েজ লাভ করেছেন। তিনি মরহুম মাওলানা সাহেবের সফরসঙ্গী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বহু দেশ সফরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। জমিয়াতের প্রচার-প্রচারণায় তার ভূমিকা অতুলনীয়। উহার পূনর্গঠন-উন্নয়ন-সংস্কারে মাওলানা সাহেবের দক্ষিণ হস্ত হিসেবে তিনি কাজ করেন। উভয় প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ জমিয়াত ও দৈনিক ইনকিলাবের খেদমতে তিনি নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে ভূমিকা রাখেন। তাই দেখা যায়, মরহুম মাওলানা সাহেব তাকে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও তার নিকট অতিপ্রিয় মানুষ হিসেবে গণ্য হন এবং তার ঘরানা সদস্যদের ন্যায় মর্যাদা লাভ করেন যা বাইরের কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
হজরত মরহুম মাওলানা এমএ মান্নান (রহ.)-এর জীবদ্দশায় তার সুযোগ্যপুত্র এএমএম বহাউদ্দীন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন এবং তার ইন্তেকালের পর তিনি জমিয়াতের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় মাওলানা রূহুল আমীন খান জমিয়াতের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে তিনি এখনো বহাল আছেন। বাহাউদ্দীন সাহেব সংগঠনের সভাপতি হিসেবে যখন সাংগঠনিক অভিযানে দেশময় ব্যাপক সফর শুরু করেন মাওলানা রূহুল আমীন খানও তার সঙ্গে থাকেন এবং সভাপতি সাহেবের মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার উন্নয়নে এবং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের নৈতিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তার ভূমিকাও স্মরণীয়।
আমাদের দেশে ও বিশ্বের নানাস্থানে অহরহ দেখা যায় ইসলামবিরোধী নানামুখী অপতৎপরতা। কখনো মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে, কখনো কোরআনের অবমাননা, কখনো মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা হানিকর তৎপরতা ইত্যাদি অপকর্ম। এসবের বিরুদ্ধে নিন্দা-প্রতিবাদে সোচ্চার হতে দেখা যায়। বিশেষত, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনও এ ব্যাপারে সরব হয়ে উঠে। এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রতিবাদ, নিন্দা- বিবৃতি প্রেরণ করা হয়ে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রে মাওলানা রূহুল আমীন খানই সেগুলো রচনা করে থাকেন। কখনো কখনো ইনকিলাবেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার নিজস্ব কলামে আলোকপাত করতেও দ্বিধাবোধ করেন না এবং বলিষ্ঠ ও জোরালোভাবে লিখে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি মাদ্রাসা তথা ইসলামী শিক্ষাসহ ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনের ওপর প্রচুর লিখেছেন যা জমিয়াত ও জমিয়াত প্রধানের নীতি-মনোভাবের প্রতিফলন। বর্তমান জমিয়াত সভাপতি এএমএম বাহাউদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে পরিচালিত নিরলস শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ফলে বর্তমান সরকার সেই প্রস্তাবিত আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিল ইতিপূর্বেই জাতীয় সংসদে পাস করেছে। ভিসি নিয়োগসহ প্রাথমিক দাপ্তরিক কাজও শুরু হয়েছে।
মাওলানা রূহুল আমীন খানের কর্মক্ষেত্র এতই প্রশস্ত-বিশাল যে, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার জন্য বিরাট পরিসর প্রয়োজন, যা এখানে সম্ভব নয়। তবে অতি সংক্ষেপে তার কর্মজীবনের আরো দুই দিক তুলে ধরতে চাই, যা নিম্নরূপ :
মাওলানা রূহুল আমীন খান একজন অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভাশালী গুণী লেখক ও কবি। তার প্রখর স্মরণশক্তি লক্ষ্য করলে অবাক ও বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। তিনি বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বহু কবিতা, গজল উদ্ধৃতি ইত্যাদি মুখস্ত বলে দিতে পারেন। প্রাচীন বিভিন্ন পুঁথি হতে অনর্গল বহু দীর্ঘ উদ্ধৃতি এতই আত্মস্থ করেছেন যে, শুনলে অবাক হতে হয়। এ প্রসঙ্গে রূহুল আমীন সাহেবের স্বরচিত একটি নাতে রাসূলের কথা উল্লেখ করতে চাই যা তিনি বিশেষভাবে মিলাদ মাহফিল ছাড়াও শ্রোতাদের আগ্রহ নিবারণে ঘরোয়া মজলিস বৈঠকেও আবৃত্তি করে থাকেন। তার এ বিখ্যাত নাত রাসূল (সা.), হজরত আদম (আ.)-এর জন্ম থেকে নবী পরম্পরায় সর্বশেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম বৃত্তান্তে শেষ হয়েছে। এটি দেখে দেখে পাঠ করতে একজন দ্রুত পাঠকের অন্তত ১৫ মিনিট সময়ের প্রয়োজন। অথচ রূহুল আমীন সাহেব যখন স্মরণ-শক্তি থেকে মুখস্থ পাঠ করতে পারেন, তা অনলবর্ষী বক্তার ন্যায় কোনো জড়তা ছাড়াই দ্রুত পাঠ শেষ করেন, কোন শব্দও বাদ পড়ে না, আটকও হন না, কোরআনের হাফেজের ন্যায় গড়গড় করে আবৃত্তি করতে থাকেন। সাধারণ এরূপ দৃষ্টান্ত কেবল নয় বিস্ময়করও বটে।
রূহুল আমীন সাহেব কেবল একজন মজলিসী কথক নন, তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে জনসমাবেশকে যেমন আকৃষ্ট করতে পারেন, তেমনি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় ওয়াজেও খতীব হিসেবে শ্রোতাদের বিমোহিত করতে পারেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি ওয়াজ-বক্তৃতা উপস্থাপন করতে ক্লান্তি বোধ করেন না। বিরাট বিরাট সমাবেশে মহাসমাবেশে জোরালো ভাষায় বক্তৃতা করতে তিনি মোটেও বিচলিত বোধ করেন না। উপস্থিত বক্তা হিসেবেও তিনি সুখ্যাতির অধিকারী।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহঃ)-এর সম্পর্ক থেকে মাওলানা রূহুল আমীন খান বিশেষ সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা-দক্ষতা লাভ করেছেন। তাই দেখা যায়, একদিকে তিনি সংগঠক, পাশাপাশি বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সংস্থার- উপদেষ্টা, সভাপতি, সম্পাদক এবং সদস্য হিসেবে এক সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব জনকল্যাণ, সেবামূলক এবং সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। যেমন- তিনি উপদেষ্টা সাপ্তাহিক পূর্ণিমা (অধুনালুপ্ত), সভাপতি ঢাকা মহানগরী, জামায়াতে হিজবুল্লাহ, বাংলাদেশ জমিয়াতে মোদার্রেছীনের সিনিয়র সহসভাপতি, বোর্ড অব গর্ভনরের সাবেক সদস্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সদস্য বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, সদস্য জাতীয় জাকাত বোর্ড, সদস্য জাতীয় ওয়াকফ কমিটি, সদস্য সচিব মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার কমিটি এবং ভাষ্যকার বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
পীর পরিবারের কৃতী সন্তান মাওলানা রূহুল আমীন খান তার চালচলন, আচার-আচরণ সবকিছুতেই ধর্মীয় ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে চলেছেন যা সাধারণত দেখা যায় না। তিনি ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষিত হয়েও স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলতে নারাজ, তাই দেখা যায় তার পারিবারিক ঘরোয়া পরিবেশে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয় এবং তার পরিবারে মহিলারা ইসলামী পর্দা প্রথার কঠোর অনুসারী। তার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এক ছেলে টাইটেল ও মাস্টার্স করা মাওলানা এবং এক কন্যা টাইটেল ও মাস্টার্স পাস। তার মরহুমা স্ত্রী ছিলেন ধর্মীয় রক্ষণশীল পরিবারের পর্দানশীন নারী। তার ভ্রাতাগণ প্রায় সকলেই মাওলানা ও শিক্ষক।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মাওলানা রূহুল আমীন খান সম্পর্কে নতুনভাবে বলার কিছু নেই। তিনি দেশের প্রথম শ্রেণীর অত্যাধুনিক দৈনিক পত্রিকা ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। অসংখ্য সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ছাড়াও স্বনামে-বেনামে তার নানা বিষয়ের উপর প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন, বিবৃতি ইত্যাদি প্রচুর ছাপা হয়েছে এবং এ ধারা চলমান রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চলতি শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে দৈনিক ইনকিলাবে তখন পর্যন্ত দীর্ঘ এক যুগ ধরে প্রকাশিত তার জনপ্রিয় কলাম ‘দেশ-জাতি-রাষ্ট্র’র দুই খ- নির্বাচিত সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক ইনকিলাব ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা গবেষণাধর্মী সাময়িকী এবং স্মরণিকা ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে তার বহু প্রবন্ধ, মুখবন্ধ ভূমিকা ও ছড়া-কবিতা প্রকাশিত হয়েছে এবং অহরহ হচ্ছে।
মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান ছাত্রজীবন হতে কবিতা রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশের সাথে সাথে সাহিত্যচর্চা এবং কবিতা রচনাকে এগিয়ে নিতে থাকেন। তিনি একজন বিজ্ঞ আলেম হওয়ায় আরবি, ফারসি ও উর্দু সাহিত্যও মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং এসব ভাষার কবি সাহিত্যিকদের রচনাবলী ব্যাপকভাবে পাঠ করেন। তাই দেখা যায় তিনি ফারসি-সাহিত্যে জালাল উদ্দীন রুমী (রহঃ), শেখ সাদী (রহঃ), মোল্লা জামী (রহঃ), হাফেজ সিরাজি (রহঃ), উমর খাইয়াম এবং উর্দুতে আল্লামা ইকবাল, গালিব এবং আলতাফ হোসেন হালি প্রমুখের কালাম প্রচুর মুখস্ত বলতে পারেন এবং তাদের কবিতার প্রভাবও রহুল আমীন সাহেবের কথা ও কবিতায় প্রতিফলিত।
প্রসঙ্গক্রমে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত কাসীদা সওগাতের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭ পৃষ্ঠার এ কাব্য পুস্তকে যাদের কাসীদা স্থান পেয়েছে তারা হচ্ছেন :
১. কবি ইবনে যুহায়র (রহঃ)-এর বানাত সুআদ
২. ইমাম শরফুদ্দীন আল বুসীরী (রঃ)’র কাসীদায়ে বুরদা
৩. ইমাম আবু হানিফা নুমান ইবনে সাবেত (রঃ)’র কাসীদায়ে নুমান
৪. শায়খ মহীউদ্দীন আব্দুল কাদির জিলানী (রঃ)’র কাসীদায়ে গাওসিয়া
৫. শাহ নেয়ামতুল্লাহ কাশ্মীরী (রঃ)’র কাসীদায়ে শাহ নেয়ামতুল্লাহ
তিনি কাব্য অনুবাদ করেছেন দিওয়ান-ই-ওয়াইসি ও কালাম-ই- ইকবাল ইত্যাদির। তার সম্পাদনার মধ্যে রয়েছে স্কুল টেক্সটবুক বোর্ডের তয়, চতুর্থ, পঞ্চম গ্রেডের পাঠ্যবই ইসলামিয়াত ইত্যাদিসহ বহুগ্রন্থ।
আরো কয়েকটি বইয়ের পরিচয় :
ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে ১৯৮৬ সালের জুন মাসে প্রথম প্রকাশিত “স্বর্ণ-ঈগল” রূহুল আমীন সাহেবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৩২ পৃষ্ঠার এ পুস্তকে ইসলামী আদর্শ জাগরণমূলক কবিতা (৭৪টি) স্থান পেয়েছে।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইনকিলাব পাবলিকেশন্সের প্রকাশনা হতে রূহুল আমীন খানের বইগুলো প্রকাশিত হয় :
১. দশকোটি গিনিপিগ
২. এ লড়াই চলবে
৩. সে আগুন জ্বলবে।
এসব ছাড়া কাব্যপুস্তকে সমাজ জীবনের বাস্তবরূপ ফুটে উঠেছে। যা স্বদেশে-বিদেশে সবই কোনো না কোনো আকারে বিদ্যমান। কার্টুন ছবির মাধ্যমে বইগুলোর কভার ও বিষয়গুলো চিত্রিত করা হয়েছে।
রূহুল আমীন খানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক হচ্ছে- ‘সরাবান তহুরা’। এটির প্রথম প্রকাশ ২০০২ সালের মার্চ মাসে বাংলাবাজার হতে। ১২৮ পৃষ্ঠাব্যাপী হামদ ও নাত সম্বলিত এ পুস্তকে ১০১টি বিষয় স্থান পেয়েছে। ৭৯ পৃষ্ঠার “তাওয়াললুদ শরীফ” শীর্ষক এটি একটি নাতিয়া কাসীদা। ১০৬ লাইন সম্বলিত এ দীর্ঘ নাতটি রূহুল আমীন সাহেবকে মিলাদ মাহফিলে দ্রুত মুখস্ত পাঠ করতে দেখা যায়।
“মামু সমাচার’ ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাবাজারের ঐ একই প্রকাশনা হতে ছাপা হয়। লেখক রূহুল আমীন খানের এটি একটি স্যাটায়ার ধর্মী রচনা। ১৬০ পৃষ্ঠার এ পুস্তকে ২৯টি বিষয় রয়েছে নানা অভিনব ধরনের।
এতদ্ব্যতীত ‘ইতিহাসের আয়নায়’ মাওলানা খানের একটি ৪৮ পৃষ্ঠার সংকলন পুস্তিকা। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক ২০০৫ সালের জুলাই মাসে প্রথম প্রকাশিত এ পুস্তিকায় নিম্নে বর্ণিত চারটি প্রবন্ধ রয়েছে :
১. বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন-রূহুল আমীন খান
২. আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা কেন?- মুহাম্মদ ইসা শাহেদী।
৩. ইসলামী-আরবী বিশ্ববিদ্যালয় ও ফাযিল কামিলের মান-ডঃ মাওলানা একেএম মাহবুবুর রহমান
৪. টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া-রূহুল আমীন খান
মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহঃ)-এর জীবদ্দশায় কবি মাওলানা রূহুল আমীন খান তার সফরসঙ্গী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জেদ্দায় আন্তর্জাতিক সাংবাদিক কনফারেন্স, বাগদাদে ইসলামী প-িতদের ইন্টারন্যাশনাল পপুলার কনফারেন্স, রাবেতাতুল আলমিল ইসলামীর মিশরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সসহ বিদেশে বহু আন্তর্জাতিক সভা-সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, ভারত, পাকিস্তান, মিশর, সউদী আরব, ইরাক ইত্যাদি দেশ সফর করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি যুক্তরাজ্য, লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা) সফর করেছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করে ভাষণ প্রদান করেছেন। বিবিসি থেকে তার সাক্ষাতকারও প্রচারিত হয়েছে।
ব্যক্তিজীবনে মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান অত্যন্ত অমায়িক, সাহসী, স্পষ্টভাষী, আদর্শবাদী, আজীবন সুন্নতি পোশাকধারী, পীর-আওলিয়া, হক্কানী, উলামাভক্ত। কথা ও কর্মে এবং লেখনিতে তিনি চরম ও পরম রাসূল প্রেমিক। তিনি দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত পীর-আওলিয়া, মাশায়েখ, উলামা, খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ ও নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। নির্লোভ, নিরহঙ্কার, পরোপকারী বহুগুণে গুণান্বিত, ইসলামী আদর্শের প্রতীক মাওলানা রূহুল আমীন খানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে শেষ করছি। আমীন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button