আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন

ড. এমএ সবুর: বাঙালি জাতির ইতিহাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। বৃটিশ শাসনামল থেকেই বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দাবি করা হয়। তবে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আনুষ্ঠানিক আন্দোলন শুরু হয়। আর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির শাহাদাতের ঘটনা ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। একুশে শহীদদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাভাষা প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। তাই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালিত হয়। এছাড়া ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর মাধ্যমে জাতিসংঘ কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বিশ্বের অধিকাংশ দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিবসটি উদযাপিত হয়। এতে বাংলাভাষা ও  বাংলাদেশের মর্যাদা অনেক গুণে বেড়ে যায়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা আন্দোলন হিসেবে আখ্যাত করা হলেও মূলত এ আন্দোলন শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই।  ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের আগে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত স্বাধীন সর্বভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করার দাবির প্রেক্ষিতে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং তারা উর্দুকে সর্বভারতের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাকে সর্বভারতের রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি তুলে ধরে ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল মওলানা আকরম খাঁ দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদকীয়তে লিখেন, ‘….. সাহিত্যের দিক দিয়া বাঙলা ভারতের সমস্ত প্রাদেশিক সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাঙলা ভাষার বিবিধ ভাব প্রকাশোপযোগী শব্দের সংখ্যাও বেশি। অতএব, বাঙলা সবদিক দিয়াই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবি করিতে পারে।’ অবশ্য এর আগে ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধে ‘শুধু ভারতে কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশে বাংলা ভাষার স্থান সর্বোচ্চ’ উল্লেখ করে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তারও আগে অর্থাৎ ১৯১১ সালে রংপুরে প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে ঢাকার জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ‘বাংলাভাষা মুসলমানদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা’ মন্তব্য করে বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দাবি করেন।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের পর প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পাঞ্জাব-বেলুচিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা উর্দুকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ  শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর, ফররুখ আহমদ, আব্দুল হক, ড. এনামুল হক প্রমুখ সাহিত্যিক বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে প্রবন্ধ লিখেন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিয়ে প্রবন্ধ লিখেন। এর প্রতিবাদে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি উল্লেখ করেন। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ বিভক্তির মাত্র কয়েকদিন পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘তমুদ্দুন মজলিশ’র পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেমের প্রবন্ধ স্থান পায়। এর মাধ্যমে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শুরু হয়। এ দিকে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে বক্তৃতা দেন। একই দাবিতে ছাত্ররা ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ ঘটে। এতে বেশকিছু ছাত্র আহত এবং গ্রেপ্তার হয়। তবে কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র আগমন নিষ্কণ্টক করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দীন ১৫ মার্চে ছাত্রদের সাথে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এক ভাষণ দেন। এতে তিনি উদুর্কে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দিলে ছাত্ররা নো নো বলে প্রতিবাদ করেন। একই অবস্থার অবতারণা ঘটে ২৪ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বক্তৃতাকালে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র মৃত্যুর পরে পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে লিয়াকত আলী খান ১৯৪৯ সালে ঢাকায় আগমন করেন। তখন বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিএস এবং জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমর অধ্যাপক গোলাম আযম তাকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। একই দাবিতে ছাত্রনেতা আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ১৯৫০ সালের ১১ মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা দিবস উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের উদ্যোগে বাংলাভাষা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এতে পূর্ব-পাকিস্তানের জনমনে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে পূর্ব-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারিতে পল্টন ময়দানের জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র মতো উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা বিস্মিত ও বিক্ষুব্দ হন। পরে ৩১ জানুয়ারি তারিখে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্র্রভাষা করার দাবিতে মওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সংগঠনের ডাকে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রধর্মঘট পালিত হয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়। এ কর্মসূচিকে বানচাল করতে তৎকালীন নূরুল আমিন সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। তবে ২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের করে। সরকারের পুলিশ বাহিনী মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন সালাউদ্দীন, ছালাম, বরকত, জব্বার, রফিকসহ অনেকে। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে এবং বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলন সমর্থনে গণপরিষদ সদস্য ও তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রমুখ গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে দেশব্যাপী আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। মূলত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন একীভূত হয়। তাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ পূর্ব-পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যায়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তার স্বতন্ত্র বিকাশের গতিপথ নির্ধারিত হয় এবং স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত হয়।
লেখক: আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গবর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)। প্রয়োজনে : ০১৭১২১৮২২১, dmasobur09@gmail.com

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button