বাংলাদেশের অর্থনীতি : একটি মূল্যায়ন

garmentsড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বাংলাদেশের অর্থনীতি মূল্যায়ন করতে গেলে একটু দীর্ঘ মেয়াদে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। সেদিক থেকে মোটামুটি গত তিন দশকে অর্থাৎ ১৯৮০ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে সেটা উল্লেখযোগ্য। আমি যদি জিডিপি গ্রোথ বা জাতীয় উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি দেখি তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আশির দশকে আমাদের জিডিপির অ্যাভারেজ গ্রোথ অর্থাৎ গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৭ শতাংশ। এটা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৮ শতাংশে। এবং ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত, এটা দাঁড়িয়েছে ৫.৮ শতাংশে। এর সাথে সাথে আমাদের যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, তা কিন্তু কমেছে ধারাবাহিকভাবে। তার ফলে এক দিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, অন্য দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। ফলে মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন অগ্রগতিটা আরো বেশি হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৮০-এর দশকে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল এক শতাংশ। নব্বইয়ের দশকে ২.৭ শতাংশ। এবং ২০০০ থেকে ২০১০-১২ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৪.৪ শতাংশে। কাজেই এ ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। আরেকটি সন্তোষের বিষয় হচ্ছে, এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে উন্নয়নের অন্য যেসব নির্ণায়ক আছে তার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ সন্তোষজনক। প্রথমত, একটা শিশুরাষ্ট্রে জন্মালে সে কত দিন পর্যন্ত বাঁচবে, এটার একটা এস্টিমেট করা হয়। এটা বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ছিল মাত্র ৩৯ বছর। ২০১১ সালে এটা দাঁড়িয়েছে ৬৯ বছরে। প্রায় ত্রিশ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার ১০০০-এ ১৫০ ছিল ১৯৭১ সালে। এটা এখন দ্রুত কমে নেমে এসেছে ১০০০ এ ৩৭। আরেকটি নির্ণায়ক হলো আন্ডার ফাইভ মর্টালিটি অর্থাৎ পাঁচ বছরের নিচে যেসব শিশু তাদের মধ্যে যে মৃত্যুর হার এই ক্ষেত্রে এটা ছিল ১৯৭১ সালে এক হাজারে প্রায় দুই শ পঁচিশ জন। এখন এটা দাঁড়িয়েছে ৪৬- এ। অন্য দিকে স্যানিটেশন ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। আরেকটি সন্তোষের বিষয় হচ্ছে ১৫ থেকে ২৪ বছরের যে জনগোষ্ঠী তাদের মধ্যে লিটারেট গ্রোথ শতকরা হার হিসেবে ১৯৭১ সালে ছিল মাত্র ৪৪। ২০১১ সালে দাঁড়িয়েছে ৭৭। পুরুষদের। আর মহিলাদের মধ্যে অগ্রগতি আরো বেশি। ১৫ থেকে ২৪ মহিলাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সালে ছিল ২৭। এটা এখন দাঁড়িয়েছে ৮০ তে। এটার একটা বড় কারণ হচ্ছে প্রাইমারি স্কুল লেভেলে ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের সংখ্যার চেয়ে বেশি। কাজেই এখানে যে পার্থক্যটা ছিল ৪৪ আর ২৭, ছেলে এবং মেয়েদের যে অনুপাত সেখানে মেয়েরা এখন এগিয়ে গেছে। এখন সেটা ৭৭ আর ৮০।
যে সূচকগুলো আমি বললাম, আমাদের পাশের দেশ ভারত, যাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম লেভেল আমাদের থেকে অনেক বেশি। এর সবগুলো সূচকেই কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। যেমন লাইফ এক্সপেন্টসিটি অব বার্থ, এখানে আমাদের ৬৯ ভারতে ৬৬। (ইন-মর্টালিটি) আমাদের ৩৭, ভারতে ৪৪। অর্থাৎ তাদের মৃত্যুহার বেশি। আন্ডার ফাইভ মর্টালিটি আমাদের ৪৬, ভারতে এটা ৬৫। তবে ছেলেদের শিক্ষার হারে, ভারত অনেক এগিয়ে আছে। আমাদের এখন প্রায় ৭৭, ভারতে ৮৮। আবার মেয়েদের ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে আছি। ভারতে ৭৪, আমাদের ৮০।
আমাদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের ১৯৯০ সালে, দরিদ্র লোকের হার অর্থাৎ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ ছিল প্রায় ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। ৫৮.৮ শতাংশ। ২০০০ সালে এটা আসে ৪৮.৯। এটা প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১০-এ এটা দাঁড়িয়েছে ৩১.৫। ২০১০ সালের পর আর ডিটেল সার্ভে হয়নি। তবে যেটা বলা হচ্ছে যে, গত তিন বছর আরো প্রায় ৫ বা ৬ শতাংশ কমেছে। তার মানে এখন ২৫-২৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে একটা বিষয় হচ্ছে আমাদের জাতীয়পর্যায়ে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ করার একটা রেখা আছে। আমরা যেটা ধরছি সেটা রেখার নিচে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রেখায় যেটা ধরা হয় ১ ডলার ২৫ সেন্টস পারচেজ ইমপারেটি বেসিসে দৈনিক আয়ের নিচে যারা আছে তাদেরকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের দারিদ্র্যের হার বেশ বেশি। ৪৩.৩। যেটা আমাদের ন্যাশনাল প্রপার্টি লাইন করলে দাঁড়ায় ৩১.৫। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই যে তফাত দুটো লাইনের মধ্যে মানে ন্যাশনাল লাইন এবং ইন্টারন্যাশনাল পারচেজ ইমপারেটি লাইন। এই তফাতটা কিন্তু অনেক বেড়ে যায়। যেমন ১৯৯৫ সালে ছিল আমাদের জাতীয় লাইন হিসেবে ৫১ শতাংশ। আর ইন্টারন্যাশনাল পারচেজ ইমপারেটিতে ছিল ৬০.৯। তার মানে ৯.৯ শতাংশের তফাত। এখন এটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ শতাংশে। ২০১০ সালে ৩১.৫ হচ্ছে জাতীয় সীমারেখা দিয়ে। আর ইন্টারন্যাশনাল পারচেজ ইমপারেটি ধরলে ৪৩.৩ শতাংশের মতো। কাজেই অগ্রগতি আমাদেরও যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু তবু আমার মনে হয় সন্তোষের কোনো কারণ নেই।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমাদের জনগোষ্ঠী তো বিরাট। কাজেই আমি যদি ৩১.৫ ধরি বা ২৫ বা ২৬ও ধরি তাহলে আমাদের যে টোটাল দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়াবে সেটা শ্রীলঙ্কার টোটাল পপুলেশনের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। এখন প্রায় ১৬০ মিলিয়ন লোক, তাদের এক-চতুর্থাংশ হলেও প্রায় ৪০ মিলিয়নে দাঁড়ায়। কাজেই এই দারিদ্র্যবিমোচনটা আমাদের জন্য ভবিষ্যতেও একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। এখন যে অগ্রগতি হয়েছে তা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য একটা শুভ ইঙ্গিত বহন করে। তবে আমাদের আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে এমনকি জিডিপির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও পার ক্যাপিটা আমাদের যে পাশের দেশগুলো আছে তাদের চেয়ে কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ইন্ডিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিনস, চায়না, বাংলাদেশ এই আটটি দেশের মধ্যে ১৯৮০ থেকে ২০১২, এই পিরিয়ডের ইমোলিটি অ্যাভারেজ গ্রোথ যদি ধরা হয়, অর্থাৎ গড় প্রবৃদ্ধির হার যদি দেখা হয় তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনি¤œ। আমাদের চেয়ে কম আছে শুধু ফিলিপিনস। ৩.৭। ফিলিপিনসে এই পারফরম্যান্সের কারণটা ছিল এই পিরিয়ডের একটা বিরাট অংশ মার্কোস সরকারের অধীনে ছিল। সে সময়ে নানা রকমের দুর্নীতি, অন্য অনেক কিছুর সমস্যা ছিল। জনসমর্থন ছিল না সরকারের পেছনে। কিন্তু পরে ফিলিপিনসের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে এবং সাম্প্রতিককালে এটার বেশ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে এই সময়ে আমাদের অ্যাভারেজ গ্রোথ হলো ৫.৬ শতাংশ, চায়নায় ১১.৮, থাইল্যান্ডে ৭.১, কোরিয়াতে ৮.২, ইন্দোনেশিয়ায় ৬.৪, শ্রীলঙ্কায় ৬.৮ এবং ভারতে (৭.১)। কাজেই আমাদের এটাও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে হবে যে, পাশের দেশগুলোর পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জন আমরা কেন করতে পারছি না। এই দিকে লক্ষ রেখে আমাদের প্রবৃদ্ধিটা কিভাবে অর্জন করা যায় তা ভাবতে হবে। এখন এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এবং আমরা যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি, ষষ্ঠ-পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়, ৭.৫ গ্রোথ রেট বলা হয়েছিল টার্গেট হিসেবে। আমরা তো সেখানে পৌঁছতে পারিনি। আমরা ৬ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছি। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করার একটা সরকারি ঘোষণা আছে। সেটা অর্জন করতে গেলে আমাদের প্রায় ৭.৫%-৮% গ্রোথ রেট থাকতে হবে। আমরা এর থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। এক দিকে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের চেয়ে আমাদের যে অর্জন তুলনামূলকভাবে সন্তোষজনক নয়। অন্য দিকে আমাদের যে টার্গেট ছিল, টার্গেট অর্জনেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কাজেই প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। কেননা সাধারণত দেখা যায় যখন প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে তখন দারিদ্র্যবিমোচনের হারও বাড়ে। কেননা প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে যারা দরিদ্র লোক তাদের তো সম্পদ শুধু তাদের শ্রম, কাজেই কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তারা উপার্জন করতে পারে। তারা তাদের অবস্থানটাকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে পারে। এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে সাধারণত প্রবৃদ্ধি ভালো হলে সরকারের রাজস্ব আহরণের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। তার ফলে সরকার বাজেট ঘাটতি, সীমাবদ্ধতার ভেতরে রেখেও কিন্তু দারিদ্র্যবিমোচনসংক্রান্ত যেসব সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত সে ক্ষেত্রেও সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। এটাও দেখা যায় সাধারণত এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাথে সাথে অন্যান্য যে সূচক আছে সেগুলোর উন্নতি হয়। যদিও বিভিন্ন দেশের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকে। যেমন আমি ভারতের কথা বললাম যে, ভারতের প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু সূচকে তারা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। তবুও প্রবৃদ্ধি, একটা পূর্বশর্ত হচ্ছে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে আমাদের যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেই চ্যালেঞ্জগুলো অ্যাড্রেস করার জন্য আমার মনে হয় নীতিনির্ধারণকে খুব বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া উচিত। প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমার যদি ৭.৫-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই তাহলে জাতীয় উৎপাদনের আনুপাতিক হার হিসেবে বিনিয়োগ হওয়া দরকার প্রায় ৩৩-৩৪ শতাংশ। সেখানে আমাদের এখন আছে ২৬-২৭ শতাংশ এবং সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে বেসরকারি খাতের যে বিনিয়োগ সেটা সার্বিক বিনিয়োগের বড় একটা অংশ ৭৫-৮০ শতাংশ। বেসকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। কাজেই সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমার ফলে টোটাল ইনভেস্টমেন্ট খুব একটা বাড়ছে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করাটা হচ্ছে সরকারের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের দেশী বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়াও বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ উৎসাহিত করার দরকার আছে।
কারণ আমি আগে অন্য একটা গবেষণায় দেখেছিলাম, এশিয়ার যেসব দেশ আছে সেখানে প্রায় আট- দশটা দেশের পরিসংখ্যান দেখেছিলাম। এখানে আগে যে আমি সাত-আটটা দেশের নাম উল্লেখ করেছি এ ছাড়াও কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম রয়েছে। এসব দেশের চেয়ে জিডিপির আনুপাতিক হার হিসেবে আমাদের দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ কম। কাজেই বৈদেশিক বিনিয়োগটাকে আরো কিভাবে উৎসাহিত করা যায় এবং সার্বিকভাবে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, যাতে বৈদেশিক এবং দেশী বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। দ্বিতীয় একটি বিষয় হচ্ছে আমাদের রফতানি। রফতানির ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি সেটা হচ্ছে রেডিমেড গার্মেন্ট। একটা মাত্র পণ্য। এই পণ্যটাই প্রায় সার্বিক রফতানির ৭৫-৮০ শতাংশ। কাজেই আমাদের এখানে ডাইভার্সিফাই করতে হবে। অর্থাৎ আরো নতুন পণ্য রফতানির দিকে নজর দিতে হবে এবং এর সাথে সাথে আমাদের মার্কেট ডাইভার্সিফাই করতে হবে। কারণ আমাদের এখন যে রফতানি এটা মূলত যায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকায়। সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু মার্কেট ডাইভার্সিফিকেশন হয়েছে যেমন চায়না, ইন্ডিয়া, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় কিছুটা মার্কেট করতে পেরেছি। কিন্তু এটা আমার মনে হয় আরো বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। যেমন রাশা একটা বিরাট দেশ। সেখানটায় আমরা রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি। সেন্ট্রাল এশিয়ান যে দেশগুলো আছে সেখানে রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি।
লেভার এক্সপোর্টের মাধ্যমে, শ্রম রফতানির যে রেমিট্যান্স পাই, বিদেশে কর্মরত আমাদের শ্রমিকেরা যে অর্থ পাঠান সেটা কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে একটা উল্লেখযোগ্য এবং বড় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে। কেননা যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক এবং তারা একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে না হলেও দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি বা তার একটু ওপরে এই ধরনের পরিবার থেকে যাচ্ছে। কাজেই শ্রম রফতাানিও আমাদের বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা সম্প্রতি দেখেছি টোটাল নাম্বার অব পিপলস যারা বিদেশে যাচ্ছে নতুন নিয়োগ নিয়ে সে সংখ্যা কিন্তু কমে গেছে। বেশ উল্লেখযোগ্যভাবেই কমে গেছে। এখানে মালয়েশিয়ার সাথে একটা সরকারি চুক্তি হয়েছিল। এটার খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। কিছু লোক গেছে কিন্তু যে টার্গেট ছিল তার চেয়ে অনেক কম। ইউআইই-তে এখনো আমাদের সমস্যা আছে। সৌদি আরবে সমস্যা আছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও কিছু সমস্যা আছে। এই সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। এর সাথে আমাদের মার্কেট ডাইভার্সিফাই করার দরকার আছে। বিশেষ করে ইস্টার্ন ইউরোপ বা সেন্ট্রাল এশিয়ান কান্ট্রিগুলোতে শ্রমের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা যদি কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে এসব মার্কেট পেনিট্রেট করতে পারি তাহলে আমাদের জনসংখ্যা রফতানির যে সংখ্যা তা হয়তো বাড়ানো যাবে। এর সাথে সাথে আরেকটা চেষ্টা করতে হবে আমাদের দেশ থেকে যেসব শ্রমিক যাচ্ছে তারা বেশির ভাগই অদক্ষ। ফিলিপিনস বা শ্রীলঙ্কা তাদেরও কিন্তু শ্রম রফতানির থেকে বেশ একটা ভালো উপার্জন হয়। তাদের শ্রমিক যারা যাচ্ছে তারা কিন্তু সেমি-স্কিলড বা স্কিলড। যেমন ফিলিপিনস অনেক নার্স তারা বাইরে পাঠায়। তার ফলে দেখা যায় পার ক্যাপিটা রেমিট্যান্স অর্থাৎ মাথাপিছু যে বিদেশী অর্থ আমাদের দেশে আসে সেটা কিন্তু ফিলিপিন, শ্রীলঙ্কা বা ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে অনেক কম। কারণ হচ্ছে আমাদের বেশির ভাগ শ্রমিক অদক্ষ। এ কারণে তারা কম বেতনে কাজ করছে। কাজেই তাদেরকে যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে আমরা বিদেশে পাঠাতে পারি তাহলে তাদের উপার্জনও বাড়বে এবং তার ফলে দেশে তারা যে অর্থ পাঠাবে সেটারও মাত্রা বাড়বে। অন্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয় আমাদের দেশে। খুব বেশি চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু অগ্রগতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। তার মধ্যে প্রথম হলো এনার্জি শর্ট। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের যে অপ্রতুলতা সেটা একটা বড় অন্তরায় আমাদের প্রবৃদ্ধি তরান্বিত করার ক্ষেত্রে। তারপর সার্বিকভাবে ইনাফ্রাসট্রাকচার অবকাঠামোগত দুর্বলতা বা অপর্যাপ্ততা। পরিবহনের ক্ষেত্রে রাস্তাঘাট, রেলওয়ে বা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট বলি সব জায়গাতেই ঘাটতি আছে। এতে প্রচুর সময়ক্ষেপণ হয়, ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়ে যায়। কাজেই এটা একটা বিষয়। এ ছাড়া আমাদের পোর্ট ম্যানেজমেন্ট এবং পোর্টের যে ক্যাপাসিটি সেগুলোও বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার। যেমন সোনাদিয়ায় পোর্ট করার কথাবার্তা হচ্ছে কিন্তু এখনো খুব বেশি একটা আগ্রগতি হয়নি।
আরেকটি বড় সমস্যা আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমি। বিনিয়োগকারীরা যখন বিনিয়োগ করতে চান, ফ্যাক্টরি করতে চান তাদের জমির দরকার হয়। জমি জোগাড় করাটা বাংলাদেশে খুব কঠিন। এ ক্ষেত্রে স্পেশাল ইকোনমিক জোন করার কথাবার্তা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দেখেছি। কিন্তু এখনো খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। এ ক্ষেত্রেও আরেকটি জিনিস আমাদের যেটা লক্ষ রাখতে হবে, শুধু স্পেশাল ইকোনমিক জোন করলে হবে না। তাতে যেন পর্যাপ্ত ইনফ্রাসট্রাকচার থাকে। মেইন মার্কেটিং সেন্টার বা পোর্ট সেগুলোর সাথে যদি ফিজিক্যাল কানেকটিভিটি যেটাকে বলা হয় অর্থাৎ সংযোগের জন্য যদি ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে একটা স্পেশাল ইকোনমিক জোন করতে পারি। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা সেখানে যাবে না। যেমন ঈশ্বরদীতে একটা জোন আছে, নীলফামারীতেও বোধহয় একটা জোন আছে। কিন্তু এগুলোতে খুব একটা বিনিয়োগ হচ্ছে না। কেননা এগুলোতে ট্রান্সপোর্টেশনের যে সমস্যা তাতে ওখানে বিনিয়োগ করে মধ্যবর্তী পণ্য বা কাঁচামাল এগুলো পরিবহন করাও কঠিন আবার পণ্য উৎপাদন করে যেখানে বিক্রি করব বা রফতানির জন্য আমি পোর্টে পাঠাব সেটাতেও সমস্যা। কাজেই এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে এই জমির সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায় সে দিকে নজর দিতে হবে। আর সবশেষে আরেকটা কথা হচ্ছে সাম্প্রতিককালে আমাদের যে ফিন্যান্সিয়াল দুর্ঘটনাগুলো, দুর্ঘটনা বলি বা এটাকে দুর্নীতি বলি যার ফলে দেখা যাচ্ছে অপরিশোধিত ঋণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর গভর্ন্যান্স আমাদের আরো শক্তিশালী করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর একটা বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের সচ্ছলতা নিয়ে যদি কোনো প্রশ্ন জাগে তখন তারা পর্যাপ্ত মাত্রায় ঋণ দিতে পারবে না। যদি ব্যাংকের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পেতে অসুবিধা হয় তাহলে বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হবে। উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হবে। আমরা যা-ই করতে চাই না কেন যেকোনো দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটা যে শুধু সাময়িকভাবে হরতাল হচ্ছে না বা ভাঙচুর হচ্ছে না সেটাই বড় বিষয় নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটা দীর্ঘমেয়াদি বা মধ্যমেয়াদি নিশ্চয়তার প্রয়োজন আছে। আমাদের বর্তমান যে পরিস্থিতি এই দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সন্তোষজনক নয়। প্রাণহানি খুব একটা হয়নি সাম্প্রতিককালে। কিন্তু হরতাল হলো কয়েক দিন। কিছু কিছু ভাঙচুরও হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে একটা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের তো একটা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে। আজকে বিনিয়োগ করলে তার ফল পেতে তিন-চার বা পাঁচ বছর লাগবে। সুতরাং এই যে আগামী পাঁচ বছর, দশ বছরের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এই নিশ্চয়তা না পেলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে এবং হয়েছেও। যার ফলে আমরা দেখেছি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ জাতীয় উৎপাদনের আনুপাতিক হারের চেয়ে কমেছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কিভাবে আমরা একটি সমঝোতামূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পেতে পারি সে দিকে দেশের সবারই দৃষ্টি দেয়া উচিত।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button