ইসলামপন্থীদের বৃহত্তর ঐক্যের চিন্তা

ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলন প্রশ্নে ইসলামপন্থী প্রায় সব দলই এখন একই অবস্থানে রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ইসলাম, আলেম উলামা ও ইসলামি দল সম্পর্কিত অসংখ্য ঘটনা ইসলামি দলগুলোকে পরস্পরের কাছে নিয়ে এসেছে। দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বৃদ্ধি ছাড়াও পরস্পরের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগদানের ঘটনাও লক্ষ করা যাচ্ছে। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা বিশ্বাস বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজনের পর ইসলামি দল ও সংগঠনগুলোকে ঘিরে বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপ ইসলামি দলগুলোকে কাছাকাছি আনার মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর সাথে অপরাপর ইসলামি দলগুলোর আদর্শিক দূরত্ব থাকলেও জামায়াতের প্রতি এই সরকারের আচরণকে ইসলামি দলগুলো এ দেশের ইসলাম ও আলেম উলামাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ সঙ্কেত হিসেবেই দেখছে। সর্বশেষ হাইকোর্টের এক রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর ইসলামি দলগুলোর মধ্যে এই আশঙ্কা আরো ঘনীভূত হয়েছে। ইসলামি দলগুলোর অনেক নেতাই অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে হলেও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে মত দিচ্ছেন। সমমনা রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানোকে অপরিহার্য মনে করছেন তারা। বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতাদের সাথে আলাপ করে দলগুলোর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে এই ধারণা পাওয়া যায়। নেতারা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ধর্মীয় ইস্যুতে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ইসলামি দলগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ঐক্যের সুফলের দিক দেখিয়ে দিয়েছে। ইসলামি দলগুলো বিভক্ত থাকার কারণেই মূলত ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং দলগুলোর ওপর তারা আস্থা রাখতে পারে না। দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে মানুষের আস্থার একটি জায়গা তৈরি হবে এবং মানুষ তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বামপন্থীদের প্রভাবে দেশকে ইসলাম শূন্য করার কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলেও তারা মনে করছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সব ইসলামি শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে তারা জরুরি মনে করছেন। দেশে বর্তমানে জনসমর্থন এবং রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ইসলামি দলগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। এ ছাড়াও রয়েছে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদসহ আরো ছোটখাটো ইসলামি দল ও সংগঠন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামি দলগুলোতে বর্তমানে একমাত্র চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি সব দলই চিন্তা ও কর্মসূচির দিক থেকে অভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। ইসলামী আন্দোলন অনেক বিষয়ে বাকি ইসলামি দলগুলোর সাথে একমত হলেও সরকার পতনের আন্দোলন এবং বর্তমান সরকারবিরোধী অন্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির সাথে যুগপৎ বা অন্য কোনোভাবে একই ধরনের আন্দোলনে একমত নয়। এই দলটি হেফাজতে ইসলামের সাথে প্রথম দিকে থাকার ঘোষণা দিলেও কার্যত মাঠের কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি। দলটি আগে কখনো হেফাজতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ইফতার মাহফিলে দলের আমির চরমোনাই পীর হেফাজতের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। আর সারা দেশে তার অনুসারিরাও হেফাজতের সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। দলটি ইতোমধ্যেই সারা দেশে তাদের ২৫০ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে অন্য ইসলামি দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক ও কর্মসূচিগত ঐক্যের পাশাপাশি পারস্পরিক যোগাযোগও বেড়েছে। জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ১৮ দলীয় জোটের থাকায় তাদের মধ্যে এমনিতেই যোগাযোগ ও একত্রে বৈঠক হয়। ইসলামি বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের সুবাদে গড়ে উঠা ১২ দলীয় জোটসহ অন্য সংগঠনের কার্যক্রমের সুবাদে খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ অন্য ছোট দলগুলোর মধ্যেও যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলের বাইরে মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের ব্যানারে ধর্মীয় ইস্যুতে আন্দোলনের সুবাদেও অনেকগুলো ইসলামি দলের মধ্যে পাস্পরিক দূরত্ব অনেক কমে যায়। সর্বশেষ হেফাজতের ১৩ দফা আন্দোলন এবং দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামীর সাথে আকিদাগত মতপার্থক্যের কারণে অন্য ইসলামি দলগুলোর বেশ দূরত্ব ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জামায়াতের প্রতি ইসলামি দলগুলো একটি সহানভূতিশীল মনোভাব বেশ লক্ষণীয়। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে জামায়াত নেতাদের একের পর এক সাজা দেয়াকে ইসলামি দলগুলো স্বাভাবিক ঘটনা মনে করছে না। বিশেষ করে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়ার পর ইসলামি দলগুলো এটিকে মেনে নিতে পারেননি বলে অনেকে জানান। ওই রায়ের পর সারা দেশে যে প্রতিক্রিয়া হয় তার প্রভাব ইসলামি দলগুলোর ওপর পড়ে। এরপর অন্যান্য রায়ের ঘটনা, নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলসহ সব ঘটনাকে ইসলামি দলগুলো এখন ইসলামবিরোধী চক্রান্তের অংশ হিসেবেই দেখছে। বিগত প্রায় চার বছর জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোকে রাজপথে মিছিল সমাবেশ করতে না দেয়ার ঘটনাও জামায়াত ও ইসলামি দলের মধ্যে দূরত্ব কমানো অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে। ফলে চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও রমজানে রুপসী বাংলা হোটেলে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে যে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় তাতে ইসলমি দলগুলোর অনেক শীর্ষ নেতাও অংশ নেন। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ, নেজামে ইসলাম পার্টির চেয়ারম্যান মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, খেলাফত মসলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোটসহ প্রায় সব ইসলামি দল ও সংগঠনের নেতারা প্রথমবারের মতো জামায়াতের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেন। জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলনের পেছনেও জামায়াতের প্রতি কওমি আলেমদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সহানুভূতি নেপথ্যে কাজ করেছে। জামায়াতের সাথে বর্তমান সরকারের অন্যায় আচরণ ছাড়াও আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের পর শাহবাগের আন্দোলন আলেম সমাজকে পীড়িত করে। সেখানে ইসলামের লেবাসধারীদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা ছাড়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ইসলামী ব্যাংক, কয়েকটি পত্রিকা বন্ধের দাবি জানানো হয়। ফলে আলেম ওলামা জামায়াতের ব্যাপারেই শঙ্কিত হননি, দেশের ইসলাম ও আলেম উলামাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় পড়েন। তখনই কওমি আলেমদের নেতৃত্বে হেফাজতের আন্দোলনের সূচনা এবং সব ইসলামি দল সংগঠনের অকুণ্ঠ সমর্থনে হেফাজত আলোড়ন সৃষ্টিকারী আন্দোলন করে শাহবাগ আন্দোলনকে স্তিমিত করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। হেফাজতের আন্দোলনের সাথে প্রকাশ্যে জামায়াত না জড়ালেও অন্যান্য ইসলামি ও সমমনা দলের মতো জামায়াতেরও অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল হেফাজতের প্রতি। সর্বশেষ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর এ নিয়ে আরো শঙ্কা দেখা দিয়েছে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে। এই ঘটনায় ইসলামী আন্দোলনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দলটির মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নয়া দিগন্তকে এ ব্যাপারে বলেন, এই ঘটনায় অবশ্যই জামায়াতের প্রতি ইসলামী আন্দোলন সহানুভূতিশীল। জামায়াতের সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা থাকার কারণে নিবন্ধন বাতিল হলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যান্য ইসলামি দলও তাদের শঙ্কার কথা প্রকাশ করে জামায়াতের প্রতি তাদেরও সহানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ইসলামি দলের নেতারা জানিয়েছেন, বামপন্থীদের সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি পরিবর্তন করে যেভাবে নানা পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে তাতে ইসলামি শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ছাড়া এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। এ ব্যাপারে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে তবে কার্যকর বৃহত্তর ঐক্য এখনো গড়ে উঠেনি। কুরআনে পাকে ‘সিসাঢালা প্রাচীরের মতো’ যে ঐক্যের কথা বলা হয়েছে সেটা গড়ে না উঠা পর্যন্ত ইসলাম বিদ্বেষী শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এই চিন্তা আমাদের তাড়িত করছে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। পরিস্থিতি আমাদের বৃহত্তর ঐক্য এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button