ইরানের স্থাপত্য বিস্ময় তাব্রিজের নীল মসজিদ

mosqueমুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান: ‘তাব্রিজ’ ইরানের অন্যতম ঐতিহাসিক নগরী। নানা কারণে উচ্চারিত হয়েছে নগরীটির নাম। ইরানের পূর্ব আজারবাইন প্রদেশের এই নগরে আছে ইসলাম ও ইরানের স্থাপত্যকলার অনেক অপূর্ব নিদর্শন। এ রকম একটি নিদর্শনের নাম ‘নীল মসজিদ’। কেউ কেউ একে ‘টারকোয়েজ অব ইসলাম’ বা ‘ইসলামের ফিরোজা নিদর্শন’ নামেও ডাকেন। মসজিদটির ভেতর ও বাইরের অংশগুলো সাজানো হয়েছে মনোরম নীল ও ফিরোজা রঙের টাইলস দিয়ে। এ কারণেই মসজিদটির নাম নীল মসজিদ।
মসজিদটি নির্মিত হয়েছে পনের শতকে। সে সময় শিয়া তুর্কি সম্প্রদায় কারা কোইনলুর নেতা জাহান শাহের আদেশে এ অনবদ্য স্থাপনা তৈরি হয়। প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে নিহত হওয়ার পর এ মসজিদের দক্ষিণ অংশে দাফন করা হয় তাকে। কারা কোইনলুর সম্প্রদায় ১৩৭৫ থেকে ১৪৬৮ সাল পর্যন্ত বর্তমান আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, তুরস্কের পূর্বাঞ্চল এবং ইরাক পর্যন্ত শাসন করে। কারা কোইনলুর শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন জাহান শাহ। ১৪৩৮ থেকে ১৪৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ ককেশাস ও ইরানের আজারবাইজান শাসন করেন। আনাতোলিয়ার পশ্চিমাঞ্চল, বর্তমান ইরাকের প্রায় পুরোটা ও মধ্য ইরান পর্যন্ত ছিল তার সাম্রাজ্য। তাব্রিজকে সাম্রাজ্যের রাজধানী করার পর তিনি নির্মাণ করেন এই নীল মসজিদ।
মসজিদটির মূল কমপ্লেক্স নির্মিত হয় ১৪৬৫ সালে ইজ্জতদ্দিন কায়াপুচির সময়ে। সে সময়ে এখানে একটি বিদ্যালয়, একটি গণসৌচাগার ও গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হয়।
মনোরম নকশা টাইলস ও ইটের সমন্বয়ে নির্মিত হয় মসজিদটি। এক সময় এসব নকশায় মসজিদের পুরোটাই আচ্ছাদিত ছিল। বেশির ভাগ টাইলস ছিল নীল ও ফিরোজা বর্ণের। তাতে কালো ও সাদার ছাপ দেয়া হয়। মসজিদের প্রধান ফটকে তুলুথ ও কুফিক হরফে পবিত্র কুরআনের আয়াত লেখা ছিল।
মসজিদের প্রধান ফটকে আজারবাইজানের অন্যতম খ্যাতিমান ক্যালিওগ্রাফার বা লিপিশিল্পী নেয়ামতউল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ বাভাবের নাম লেখা আছে। তিনি মসজিদটির অভূতপূর্ব টালিগুলোর নকশাশিল্পী ছিলেন।
প্রধান এই ফটকে জাহান শাহের নামও লেখা আছে। এক সময় এটি স্বর্ণমণ্ডিত ছিল।
মসজিদের মূল অংশের ওপরের ভাগে পুরো সূরা আল ফাতেহা লেখা আছে।
দুই গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির তিন পাশ ঘিরে আছে খিলানের সারি। দণি অংশে আছে দু’টি দীর্ঘ মিনার। মসজিদের মূল অংশের ফটকে ফার্সি কবিতা লেখা আছে।
মসজিদটির দণি অংশে আছে ছোট একটি কক্ষ। জাহান শাহের ব্যক্তিগত কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো এটি। মর্মর পাথরে নির্মাণ করা এ কক্ষটিতে তুলুথ লিপিতে পবিত্র কুরআনের বাণী লেখা আছে। আর এ বাণী সাজানো হয় জ্যামিতিক নকশায়।
১৭৭৯ সালের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে প্রায় পুরো স্থাপনাটি ধ্বংস হয়ে যায়। সে সময় মসজিদটির কেবল সামনের অংশ ও কয়েকটি খিলান ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। ১৯৭৩ সালে মসজিদটি পুনর্গঠনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ধ্বংস স্তূপ থেকে প্রচুর স্বর্ণ ও মর্মর পাথর লুট হয়।
মূল ভবনের যে অংশ টিকে আছে তা থেকে দেখা যায়, মসজিদটি ফিরোজা এবং ষড়ভূজাকৃতি টাইলসে আবৃত। এসব টাইলসে জ্যামিতিক নকশাসহ ফুল-পাতা ও নানা বাণী খচিত ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মসজিদটির ছাদের ভেতরের দিক স্বর্ণমণ্ডিত ও মেঝ মর্মর পাথরে নির্মিত ছিল।
তৈমুর বংশীয় শাসকদের মহৎ এক শিল্পকর্মের নিদর্শন হয়ে আছে তাব্রিজের এই নীল মসজিদ। আজ এই মসজিদ প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে দেশী-বিদেশী হাজারো পর্যটকের পদভারে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button