গাজার এক গর্ভবতী তরুণীর বেঁচে থাকার দিনলিপি

২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর, গর্ভাবস্থার সপ্তম মাসে, আমি গাজার তুফাহ অঞ্চলের বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়ি শুজাইয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। সে সময় আমি বিলিয়ারি কোলিক নামের এক অসুখে ভুগছিলাম, যা তীব্র পেটব্যথা সৃষ্টি করে। ব্যথা কয়েক দিন ধরে চলতে থাকলে আমি আমার স্বামী ও বাবা-মাকে নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে যাই। হাসপাতালটি আহত মানুষ ও শহীদের দেহে উপচে পড়ছিল। চারদিকে মৃত্যুর গন্ধ, আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠছিল। একজন ডাক্তার আমার গর্ভস্থ শিশুকে পরীক্ষা করে বললেন,
এই ব্যাথা আসলে আমার শরীরের ভয় ও মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া, কারণ ইসরায়েল তখন অবিরাম গাজায় গোলাবর্ষণ চালাচ্ছিল।
তিনি আমাকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিলেন।
কিন্তু পরের দিনই, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে দশ লাখেরও বেশি বেসামরিক মানুষকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেয়। দক্ষিণে কোনো আশ্রয় না থাকলেও, আমরা নিরাপত্তার আশায় পালানোর সিদ্ধান্ত নিই।
আমরা ফেলে আসি আমাদের ঘর, সব জিনিসপত্র, আর সেই নতুন পোশাকগুলো, যা আমি আমার অনাগত সন্তানের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। এক কিলোমিটার হাঁটার পর আমরা একটি দক্ষিণমুখী ট্রাকে চড়ে আল-জাহরায় পৌঁছাই, তারপর আরও কয়েক কিলোমিটার হেঁটে দেইর আল-বালাহ এলাকায় যাই, যেখানে আমার কিছু আত্মীয় আশ্রয় নিয়েছিল। গর্ভাবস্থার সপ্তম মাসে এমন দূরত্ব হাঁটা আমার পক্ষে উচিত ছিল না, কিন্তু তখন আমার কোনো বিকল্প ছিল না।
বিচ্ছিন্নতা ও আতঙ্ক:
পরের মাসে, নভেম্বর ২০২৩-এ, উত্তর ও দক্ষিণ গাজার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে আমার স্বামী আর তার পরিবারকে দেখতে ফিরতে পারেননি। তিনি আমাকে পরে জানান, তাদের নিয়ে তিনি ভয় ও উদ্বেগে ভুগছিলেন, তবুও আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্তে তিনি অনুতপ্ত নন, কারণ তিনি জানতেন—যদি আমরা থাকতাম, আমাদের অনাগত সন্তান বাঁচত না। আমরা দক্ষিণমুখী যাত্রা চালিয়ে গেলাম, শেষ পর্যন্ত রাফাহে পৌঁছালাম।
আনন্দ ও বেদনা:
এক ডিসেম্বরের রাতে, রাত ১০টা নাগাদ, আমার প্রসব বেদনা শুরু হয়। আমি ও আমার স্বামী তখন এক স্কুলের পেছনের আঙিনায়,
বাস্তুচ্যুতদের জন্য তৈরি একটি তাঁবুতে বসবাস করছিলাম।
বাতাসে ঠান্ডা, আর আমার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা।
আমার মা বললেন, “অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।” স্বামী চেষ্টা করলেন, কিন্তু ইসরায়েলের হামলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছিল না।
আমার ভাই ও স্বামী হেঁটে আল-হেলাল হাসপাতালে যান অ্যাম্বুলেন্স আনতে। অল্প পরেই তারা আমাকে নিতে ফিরে আসে। অ্যাম্বুলেন্স যখন নুসেইরাতের হাসপাতালের পথে দ্রুত এগোচ্ছে, ঠিক তখনই ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের সামনে রাস্তা বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। আমি বিছানা থেকে পড়ে যাই, মাথায় একটাই চিন্তা: আমার সন্তানের ক্ষতি হলো না তো? হাসপাতালের ভেতর ছিল লাশের সারি এবং অবিরাম বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, রাত ১২টা ৩০ মিনিটে আমার ছেলে রাকান জন্ম নেয়। সেটি ছিল আনন্দের মুহূর্ত, আবার অসহনীয় বেদনারও। যেদিন আমার সন্তান পৃথিবীতে আসে, সেদিন অন্য পরিবারগুলো তাদের সন্তান হারায়। আমি ভাবছিলাম, এমন পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে রাকানকে খাওয়াব, পরাব, বড় করব?
বারবার বাস্তুচ্যুতি:
ইসরায়েলি বাহিনী আবার দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সতর্কতাসূচক লিফলেট ছুড়ে দেয়। আমরা আবারও পালালাম রাকানের জন্য নিরাপদ স্থান খোঁজার আশায়। কিন্তু গাজায় নিরাপদ স্থান বলে কিছু নেই। পরবর্তী এক মাস আমরা দেইর আল-বালাহর আত্মীয়দের বাড়িতে ছিলাম—দুই তলা ছোট বাড়ি, যেখানে ৬৮ জন মানুষ ঠাসাঠাসি করে থাকছিল। তারপর আমরা আবার তাঁবু শিবিরে ফিরে যাই।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। আমরা উত্তর গাজায় ফিরে যাই। বাড়ি আংশিক ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু এক ঘরে থাকা সম্ভব হয়েছিল। তাঁবুর চেয়ে একটু ভালোই ছিল জীবন। কিন্তু মার্চ মাসেই ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়। এপ্রিলের শুরুতে আবারও লিফলেট ফেলা হয় : “দক্ষিণে পালাও।” আমরা আবার পালালাম, রাকানের জন্য নিরাপত্তা খুঁজতে, যদিও জানতাম, গাজায় কোথাও নিরাপদ নয়। এই সময় আমি জানতে পারি, আমি দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে।
ঘর নেই, কেবল ধ্বংস:
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খবর পেলাম, ইসরায়েলি সেনারা আমাদের তুফাহ এলাকার বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে, এমনকি পুরো পাড়া মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এতে আমার বুক ভেঙে যায়। এদিকে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় শিশুর ডায়াপারের দাম আকাশছোঁয়া। আমাদের এক বছরের রাকানকে টয়লেট ব্যবহার শিখাতে হয়েছে, কারণ একটি ডায়াপারের দাম ছিল ৬ ডলার, যা আমার স্বামীর পক্ষে কেনা সম্ভব ছিল না। আমরা যে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখানকার টয়লেটগুলো ছিল নোংরা, তাই আমরা রাকানকে একটি জলভরা ও বালুভরা জার দিতাম, যাতে সে নিজে নিজে পরিষ্কার হতে পারে।
দুর্ভিক্ষ ও অসহায়ত্ব:
শীঘ্রই গাজা জুড়ে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। আমি দিনে একবার খেতাম এবং ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট নিতাম। আমার ওজন কমতে থাকে, আর রাকান অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে। সম্প্রতি রাকান জ্বরে ও তীব্র বুকের সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি তার সঙ্গে হাসপাতালে দুই রাত থাকি—রাত জেগে তার যত্ন নিই। ঘরে আরও সাতজন শিশু ও তাদের মায়েরা ছিল— সবাই সারারাত জেগে থাকত, চেয়ারে বসে। বাসায় ফিরে আমি সম্পূর্ণ ক্লান্ত ও অবসন্ন। এক সপ্তাহ পর আমি আবার গর্ভের তীব্র ব্যথায় ভুগতে থাকি।
এই সন্তানটিকে আমি আর চাইতাম না, কারণ জানতাম—আমি তাকে একটা যন্ত্রণাময় দুনিয়ায় আনব। কিন্তু গাজায় কোনো স্বাস্থ্যসেবা নেই, তাই বিকল্পও ছিল না।
আমি ডিসেম্বরেই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেব বলে আশা করছি, যে মাসে রাকান জন্মেছিল। আমার শরীর প্রোটিনের অভাবে বিধ্বস্ত—গর্ভাবস্থার পুরো সময় আমি প্রায় কিছুই খেতে পারিনি।
বেঁচে থাকা, না টিকে থাকা:
যুদ্ধবিরতি হলেও আমরা এখনো বাস্তুচ্যুত, একটি তাঁবুতে আগুন জ্বেলে রান্না করি। খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। ইয়া আমার বয়স ২৫, কিন্তু আমি অনুভব করি যেন ৫০। আমাদের পরিবারেরও পৃথিবীর অন্য যেকোনো পরিবারের মতোই শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতি প্রাপ্য। কিন্তু আমি জানি না, ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। -ইতিমাদ শাল্লাহ, গাজা সিটিভিত্তিক একজন সাংবাদিক।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button