দাপুটে সন্ত্রাসীরা বিদেশে পালানোর পথ খুঁজছে

সৈয়দ আতিক: দাপুটে সন্ত্রাসীরা অনেকটা চুপসে গেছেন। আওয়াজ নিচু হয়ে গেছে শাসকদলের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীদেরও। পারলে পাড়ি দিতেও বিদেশে প্রস্তুত তারা। মামলা আছে এদের অনেকের বিরুদ্ধে। সরকার বিদায় নিলে অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের হবে আরও মামলা। যুবলীগ-ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবকলীগে থাকা অনেক ক্যাডারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। তাদের মধ্যে কুখ্যাত কেউ কেউ সন্ত্রাসী লালন-পালন করেন। তারা এখন র‌্যাব-আতংকে ভুগছেন। অপরাধী হলে এই বাহিনী কাউকেই রেহাই দেয় না। আন্ডারগ্রাউন্ডে এখন র‌্যাবকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান যুগান্তরকে বলেন, ‘সন্ত্রাসী দমনে র‌্যাব সব সময় ভূমিকা রেখে আসছে। মানুষকে শান্তিতে রাখাই র‌্যাবের দায়িত্ব। আর আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সন্ত্রাস দমনের বিকল্প নেই।’ র‌্যাব সূত্র জানায়, রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর অর্ধশত জনের একটি তালিকা র‌্যাবের কাছে এসেছে। যেখানে কমবেশি সবার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আছে। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ যুগান্তরকে বলেন, যারা অপরাধী তারা র‌্যাবকে ভয় পায়। তিনি বলেন, মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। যে যতই শক্তিমান হোক না কেন তাকে আইনের সামনে মাথা নত করতে হবে।
আন্ডারগ্রাউন্ড সূত্রগুলো বলেছে, র‌্যাবের চোখে ধুলো দিয়ে বিদেশে চম্পট হওয়ার সুযোগ খুঁজছেন। সুযোগ সন্ধানীদের কয়েকজনের উপর র‌্যাবের কঠোর নজরদারিও আছে। পা বাড়ালেই কব্জায় নেবে র‌্যাব। তাদের শেষ পরিণতিও ভালো না। কারণ হিসেবে আন্ডরগ্রাউন্ড সূত্রগুলো বলেছে, আন্ডারগ্রাউন্ডে কিছু নেতা দলভারি করতে এ সরকারের আমলে কোটি কোটি টাকার টেন্ডারবাজি করেছে। তুলে দিয়েছে অস্ত্র। তৈরি করেছে নতুন নতুন শিষ্য। কিন্তু যুবলীগ নেতা মিল্কী হত্যার পর দাপুটে নেতাদের পিনপতন নীরবতায় শিষ্যরা অনেকটা ‘ফ্রেশ’ হতে প্রস্তুত। যারা ‘ফ্রেশ ইমেজে’ ফিরতে চায় র‌্যাব-পুলিশের তালিকায় তারা নতুন প্রজম্মের ভয়ংকর অপরাধী বটে। অনেকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত যুবলীগ নেতা তারেকের অনুসারী। কেউবা চঞ্চল আবার কেউ মিল্কী গ্রুপের। আর শিক্ষা ভবনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকারী শফিকের সঙ্গে চঞ্চল-তারেক গ্র“পের যোগাযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, আন্ডারগ্রাউন্ডের বাসিন্দা অথচ রাজনীতির ছদ্মবেশধারী ‘বড়ভাইদের’ আছে ছোট-বড় গ্র“প। এসব গ্রুপই নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন এলাকা। এক গ্র“প আরেক গ্র“পের উপর আক্রমণ করতেও মরিয়া। আবার তথ্য ফাঁস যাতে হয়ে না যায় সেজন্য একই গ্র“পের সদস্যদের উপর রয়েছে সাবধানী পর্যবেক্ষণ। বিশেষ করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নিজগ্র“পের সদস্য ধরা পড়লে তাকে ‘খতম’ করতে প্রস্তুত একই গ্রুপের সদস্যরা। তারেককে গুলি করে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে তাকে খতম করার চেষ্টা কি-না তা ভেবে দেখা হচ্ছে। তারেক বেঁচে থাকলে মিল্কী হত্যার নেপথ্যের অনেক তথ্য জানতে পারতো র‌্যাব। কিন্তু মিল্কীকে গুলি করে হত্যার পর অনেক তথ্য অজানা থেকে যায় তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের।
ঢাকা ও চট্টগ্রামভিত্তিক তারেক এবং চঞ্চল সিন্ডিকেটের ঘনিষ্টসূত্র নিশ্চিত করেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রামে রেলওয়ের টেন্ডারবাজি নিয়ে যে খুনের ঘটনা ঘটেছে তা থেকে রেহাই পেতে চট্টগ্রাম যুবলীগের নেতারা ঢাকায় এসে তারেকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। যুবলীগ-ছাত্রলীগের সশস্ত্র দুটি গ্র“পের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান কার্যালয় (সিআরবি) চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে ফিল্মি স্টাইলে দুই গ্র“পের গোলাগুলিতে ঝরে যায় দুটি প্রাণ। প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের তিনটি প্রকল্পের টেন্ডার জমাদানের শেষদিনে এ তাণ্ডব চলে। তাণ্ডবকারীদের সঙ্গে ঢাকার যুবলীগ নেতা তারেক ও চঞ্চলের অত্যন্ত ঘনিষ্টতা ছিল। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন গ্র“প ও চট্টগ্রাম নগর যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর গ্রুপ এ তাণ্ডবের জন্ম দেয়।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) এক সময়কার তালিকাভুক্ত শীর্ষসন্ত্রাসী বাবর। ইনি নিয়ন্ত্রণ করেন ফোরস্টার সিন্ডিকেট। অন্যদিকে যুবলীগ নেতা দিদারুল আলম নিয়ন্ত্রণ করেন আরেকটি গ্র“প। অবশ্য সবাই কেন্দ্রীয় ‘প্রেসক্রিপশনে’ চলাফেরা করেন। তাদের রয়েছে আলাদা আলাদা গোপন বাহিনী। সূত্র মতে, চট্টগ্রামের ঘটনার পর কেন্দ্রে কয়েকজন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতার নাম উচ্চারিত হচ্ছিল; যেখানে তারেক, চঞ্চল ও মিল্কীর নামও ছিল। চট্টগ্রামের রক্তপাতের ঘটনার পর র‌্যাব নড়েচড়ে বসে। কিন্তু আগেভাগেই রাজধানীর গুলশান থানা এলাকা থেকে যুবলীগের ছয়জন নেতাকে ওই ঘটনায় গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগে কোণঠাসা এক নেতা বলেন, তারেক-চঞ্চলের আধিপত্য সর্বত্র। তারা সবার মনজয় করে সন্ত্রাসের মাধ্যমে। আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশনেই তাদের ‘হোমরাচোমরা’ বানিয়েছে। ওই নেতার মতে, টেন্ডারবাজের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীরা র‌্যাবকে খুবই ভয় পায়। তাই ওই ঘটনার সময় আত্মরক্ষার খাতিরে পুলিশের হাতে ধরা দেয়াটাকেই তারা ‘নিরাপদ’ বিবেচনা করে। এদের সঙ্গে কারাবন্দি শীর্ষসন্ত্রাসী ও তাদের কিলার গ্র“পের যোগসূত্র আছে। তাদের শংকা ছিল র‌্যাবের হাতে ধরা পড়লে ‘বন্দুকযুদ্ধের বিপদ’ কামড় দেবে।
নির্ভরযোগ সূত্র জানায়, বন্দুকযুদ্ধে তারেক নিহত হওয়ার আগে কারাবন্দি শীর্ষসন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের পক্ষে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশনের নেতাদের কাছে ফোন এসেছিল। বলা হয়েছিল- ‘তারেকের যেন কিছু না হয়।’ কিলার আব্বাস বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে একজন র‌্যাব কর্মকর্তা বলেছেন, র‌্যাবের কাছে এ তথ্য আছে। ফোনকলের তথ্যপ্রমাণও সংরক্ষণ করেছে র‌্যাব। কার সঙ্গে শীর্ষসন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ও আরমানের কথা হয়েছে, কখন হয়েছে সবই র‌্যাবের জানা। সময় হলে আইনের আওতায় সবাইকেই আনা হবে। প্রশ্ন উঠেছে, কারাগার থেকে শীর্ষসন্ত্রাসীরা কীভাবে জানলো- তারেকের কিছু একটা হতে পারে? জেলের ভেতর থেকে এত দূরের খবরদারি এবং তারেক রক্ষার কলকাঠি নাড়ার পেছনে অনেক রহস্য আছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তারেক তার স্বীকারোক্তিতে শীর্ষসন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসূত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। বড়দাগের অর্থ যেতো কিলার আব্বাস, আরমান ও তার বাহিনীর কাছে।’
মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার সুজন, রাশেদ মাহমুদ, সাইদুল ইসলাম, তুহিনুর রহমান ও সৈয়দ মুস্তাক আলী একেকটি আন্ডারওয়ার্ল্ডের উপ-শাখার প্রধান ছিলেন। তাদের হাত ধরে অনেকে অপরাধ জগতে নাম লিখিয়েছে। তাদের সহযোগীরা অনেকে আÍগোপন করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের ক্ষমতা শেষ হতে না হতেই কমপক্ষে ৫০ জন শীর্ষস্থানীয় ক্যাডার দেশ ছাড়তে পারেন। ইতিমধ্যে তারা বিদেশে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছেন। বর্তমানে গুরুরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আর শিষ্যরা ইমেজ ফিরে পেতে মরিয়া। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রগুলো জানায়, তারেক-মিল্কী দু’জনের দুইভাবে চলে যাওয়ার পর শিক্ষা ভবনের শফিক, ক্রীড়া ভবনের চঞ্চল, মৎস্য ভবনের বকুল ও বিদ্যুৎ ভবনের মিজানের অনুসারীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপন করে আছেন। কেউ আবার পথ ধরেছেন সীমান্তের।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button