ইমাম আব্দুল কাইয়ূম এবং ইষ্ট লন্ডন মসজিদে একটি বিয়ে..

Abdul Qayumসৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ: বিলেতের পূর্ব লন্ডন-এ যেন এক খণ্ড এক বাংলা।ঠিক একখণ্ড বাংলা বললে বোধ হয় ভুল হবে। দ্বিতীয় বাংলা মনে হয় বেশী মানানসই হবে। কেননা, বাংলার চা, বাংলার পান, সুপারি, বাংলার বিস্কিট, মাছ, তরিতরকারি, শুঁটকী,বাংলা পত্রিকা, বাংলার ডাক, বাংলার বানান, বাংলার সাইন,টুনটুনি, ঝুমঝুম শব্দ, ঘমঘম করে আওয়াজ, হৈ-হুল্লোড়,ক্যারম খেলা, ব্যাডমিন্টন, ভাটিয়ালী, জারি গানের আসর, কবির লড়াই, সাহিত্যের আড্ডা, সাংবাদিকদের জম্পেশ পদচারণা, কোরআনের তাফসীর, মসজিদের আযানের সুমধুর ধ্বনি,ক্যাসেট প্লেয়ারে উচ্চ সুরে গান বাজানো, পানের পিক, পেছন থেকে উচ্চ স্বরে মামা ডাক- কি নেই এই পূর্ব লন্ডনে। নেই কেবলমাত্র রিকসার টুনটুনি আর ঘণ্টা বাজিয়ে চলার আওয়াজ। আর সবই আছে এই পূর্ব লন্ডনে।
এই পূর্ব লন্ডনে বাঙালি মুসলমানের স্থাপত্য কীর্তির এক অপরূপ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে লন্ডন মুসলিম সেন্টার ও এর সংলগ্ন মসজিদ। যেখান থেকে দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান মাইকে প্রকাশ্যে স্পীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায় দেয়া হয়। আযানের সুমধুর ধ্বনি এই এলাকার সকলের দেহ ও মনে, কলিজায় এমনভাবে গেঁথে আছে যেন মনেই হয়না এখানে অবস্থান করে আমরা কোন ভিনদেশে অবস্থান করছি। আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠ রহমত ও বরকতের এক বিশাল ভাণ্ডারের সীমাহীন এক প্রকাশ এই এলএমসি মসজিদ। এ মসজিদ ঘিরে বিশাল কর্মযজ্ঞ প্রতিদিন বেড়েই চলছে। প্রতি ওয়াক্তের নামাযে এখানে কতো হাজার হাজার মুসল্লি যে মিলিত হন আবার নিমিষে মিলিয়ে যান-আল্লাহ পাকই কেবল এর হিসেব যথাযথভাবে রাখতে পারবেন। এখানে প্রতিদিন যেমন অসংখ্য অমুসলিম মুসলমান হচ্ছেন, একই সাথে প্রতিদিন ২ থেকে ৪/৫টি জানাজা প্রায় প্রতি ওয়াক্তে পড়ানো হয়ে থাকে।সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, কমিউনিটির মিটিং প্রতিদিনই লেগেই আছে।
আমার পরম সৌভাগ্য, এশার নামায পড়ার পর পরই নামাযের ইমাম ও খতিব হযরত আল্লামা আব্দুল কাইয়ূম ঘোষণা করলেন, বাকি নামাযের পর এখানে একজন মুসলমান ভাইয়ের শাদী মোবারক সম্পন্ন করা হবে। এর পর পরই কোরআনের নিয়মিত তাফসীর ইংরেজিতে করা হবে। যথারীতি নামায আদায় করে বিয়ের ঐ অনুষ্ঠানে শরিক হলাম । আলহামদুলিল্লাহ, ব্রিটেনের মতো জায়গায় এবং একই সাথে আজকের দিনে মুসলিম- অমুসলিম, সেটা বাঙালি নন বাঙালি, যেকোন বিয়ের অনুষ্ঠান কখনো এরকম সম্পূর্ণ ইসলামিক রীতি নীতিতে সম্পন্ন হওয়ার নজির খুব একটা দেখাতো দূরে থাকুক, কেউ কল্পনাও করতে পারেনা। অন্তত: প্রকৃত আলেম উলামার পরিবারের বিয়ে ছাড়া।যিনি বর তিনি মাশাআল্লাহ দেখতেও সুদর্শন, টুপি ও সাধারণ শেরওয়ানী-পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছেন শায়েখ আব্দুল কাইয়ূমের পাশে। তার ঠিক পাশে কনের ভাই বসে আছেন। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন যাবতীয় ইসলামি তরিকার রীতি অনুযায়ী সকল কিছু এবং সব শেষে জিজ্ঞেস করলেন মোহরানার ব্যাপারে। উভয় পক্ষকে বললেল তাওফিক অনুযায়ী নগদ এবং পরিশোধ করতে সক্ষম হওয়াই ভালো। মাশাআল্লাহ সেমতোই উভয় পক্ষ একমত হলেন, বাকী যে অংশ আগেই তাদের মধ্যে ফায়সালা ছিলো আল্লাহর রহমতে সে অংশও তিরোহিত হলো।তারপর যথারীতি ইমাম সাহেব কন্যার ভাইয়ের হাত বরের হাতে দিয়ে ইসলামী সুন্নত মোতাবেক সব শিখিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, কনের ভাই স্বেচ্ছায় সেসব বলে গেলেন যে উনার বোন খাদিজা বেগম(পিতা অমুক্…..কে বরের হাতে তুলে দিলেন, বর তখন মোহরানা সহ আলহামদুলিল্লাহ বলে কবুল করে নিয়ে খাদিজাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন। সকলেই তখন মৃদুভাবে বলাবলি করছিলেন, আহারে এরকমভাবে যদি সবাই বিয়ে শাদির ব্যবস্থা করতে পারতো ? তাহলে অসংখ্য পরিবার ঋনের অহেতুক বোঝা আর কর্জের ফাঁপর থেকে বেচে যেতো।
মজার ব্যাপার হলো, শায়েখ আব্দুল কাইয়ূম এখানেই থেমে যেতে পারতেন। সঙ্গতও ছিলো। কিন্তু না, তিনি দোয়া করার আগে কিছু নসিহত করলেন অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায়। যা উপস্থিত সকলের হ্রদয়-মন ছুঁয়ে যায়। তিনি বললেন, দেখেন আজকাল বিশেষ করে এই দেশে শত শত বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। শয়তান ওছওছা দিয়ে একাজ করছে। কারণ দুজনের সুন্দর ভবিষ্যৎ- আল্লাহর এই রহমতের মিলনের মাধ্যমে জীবন শুরু হউক-শয়তান চায়না। এখনকার এই সমাজে কনে ও বর – উভয় পক্ষের মা, বাবা, ভাই, বোন, দুলাভাই, মামা, কাজিন সবাই সমানভাবে কনে পক্ষ কনেকে, বর পক্ষ বরকে অতিরিক্ত প্রভাব বা অল্প অভিমানের ইস্যুতে ইন্ধন জুগিয়ে থাকেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-মনোমালিন্য হতেই থাকবে, নিজেদের মধ্যেই আপোষ ফায়সালা করে নেওয়া উত্তম। দুজনের মধ্যখানে তৃতীয়, চতুর্থ, অধিক পরিবার ইনভলভ করে সমস্যার সমাধান নয়, আজকের এই সমাজে বরং পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে।এমন শত শত উদাহরণ আমাদের শরীয়া কাউন্সিলে আসছে। তাই উভয়কে বলবো ধৈর্য এবং সবর আর নিজেদের মনোমালিন্য হয়ে গেলে নিজেদের মধ্যে সমাধান করে নিবেন। উভয় পরিবার বেশী ইনভলভ না হয়ে ওদেরকে সংসার ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে নিজেদের বাস্তব জীবনের বোঝা কাঁধে নিয়ে চলার সুযোগ করে দিন। ইমাম আরো বললেন, আজকেই বর যেন স্ত্রীকে দেখে এবং স্ত্রী যেন বরকে দেখে এই দোয়াই প্রথমে করেন “হে আল্লাহ স্ত্রীর মধ্যে তুমি তোমার কুদরতের মাধ্যমে যে সব ভালো নেয়ামত রেখেছ, আল্লাহ সেই সব নেয়ামত দিয়ে তুমি আমাকে মালামাল করে দাও। আর যে সব খারাপ নেয়ামত রয়েছে, আল্লাহ সে সব থেকে তুমি আমাকে রক্ষা ও হেফাজত করো।“ একইভাবে স্ত্রী ও একই রকম দোয়া করবেন। তারপর দুজনে (স্ত্রী পেছনে দাড়াবেন)ভালো মতো অজু ইতিমধ্যে না করে থাকলে, করে নিয়ে দুরাকায়াত নফল নামায পড়ে আল্লাহর শোকরা আদায় করবেন।
ইমাম বললেন, খাওয়া-দাওয়ার পার্টি নিজের অবস্থা ও তাওফিক অনুযায়ী করবেন। নিজের উপর বোঝা হয়, এমন কোন কিছু করবেননা।আর শয়তান কিন্তু অতিরিক্ত সব কিছুই পছন্দ করে।
ইমাম তার সুন্দর নসিহতের মাধ্যমে( যা এখনকার ব্রিটিশ মুসলিম সমাজের অন্ধর মহলের প্রধান সমস্যা)বর ও কনের জন্য উপস্থিত সকলকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন।তারপর বর ও কনের পক্ষ উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে খেজুর বিতরণ করেন।
এর পর পরই যথারীতি ইমাম শায়েখ আব্দুল কাইয়ূম প্রতি সপ্তাহের বুধবার বাদ এশার পরে উনার কোরআনের ইংরেজি মুসল্লিদের জন্য তাফসীর শুরু করেন।প্রায় আধ ঘণ্টা কেমন করে চলে গেলো বুঝতেই পারলামনা। পিন পতন নীরবতার মধ্যে তাফসীর শেষে ইমাম সকলকে দুরুদ শরীফ তেলাওয়াত করে এ সপ্তাহের সমাপ্তি টানেন।বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য ইমাম সপ্তাহের প্রতি শনিবার বাদ আসর( সময়ের তারতম্য হেতু এখন মনে হয় বাদ এশা)কোরআনের নিয়মিত তাফসীর করে থাকেন। ফেরার সময় শায়েখ নিজেই আসসালামু আলাইকুম বললেন, যা সচরাচর আমাদের সমাজের বড় বড় আলেম, উলামা, দীনের দাওয়াত কারীরা আগ বাড়িয়ে করেননা।
আল্লাহ পাক সকলের মঙ্গল করুন। আমীন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button