‘শান্তি’ ফেরি করে টনি ব্লেয়ার যেভাবে বিলিয়নেয়ার

Tonyবাংলা প্রবাদ ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ ইউরোপের ক্ষেত্রে হতে পারে ‘ব্লেয়ার ফুলে বটগাছ’! হ্যাঁ, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের কথাই বলা হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে তার বেশ নামডাক ছিল। ইরাকে মার্কিন হামলার একজন প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি।
কিন্তু ২০০৭ সালে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধবাজ এই নেতাই কোনো এক জাদুবলে হুট করে ‘শান্তির দূত’ হয়ে গেলেন! মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘শান্তির দূত’। আনুষ্ঠানিক নাম ‘কোয়ার্টেট রিপ্রেজেন্টেটিভ’। তার দায়িত্ব হচ্ছে গাজা এবং পশ্চিম তীরে শান্তি প্রক্রিয়া জোরদার করা এবং স্থান দুটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করা।
কথিত শান্তি ফেরি করতে করতে ব্লেয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন বটে। তবে গাজা আর পশ্চিমতীরের পরিবর্তে উন্নয়ন করেছেন তার নিজের পকেটের।
গত কয়েক বছরে ব্রিটেনের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী তার পরিচয় ব্যবহার করে হাতিয়ে নিয়েছেন শত মিলিয়ন ডলার।
ব্লেয়ারের এই ‘ফুলে বটগাছ’ হয়ে যাওয়ার কাহিনী সম্প্রতি বিস্তারিত প্রকাশ করেছে ব্রিটেনেরই খ্যাতনামা পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ। গত ১৮ এপ্রিল এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর ব্লেয়ার গত ৮ বছরে বেশ কয়েকটি বাড়ি, একটি বিশাল অবকাশ এস্টেটসহ ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার (৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরোর) মালিক হয়েছেন।
ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফ এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল—
‘হতে পারে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বের হওয়ার পর নিজের পকেট ভরতে সবসময় ব্লেয়ারের এক চোখ খোলা ছিল। অথবা হতে পারে একের পর এক শান্তি ও দাতব্য মিশনে বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়ানোর সময় বিভিন্ন সুবিধা হিসাবে সেগুলো পেয়েছেন। পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে গত আট বছরে ব্লেয়ারের ‘ব্যবসা’ যারপরনাই তুঙ্গে ছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দেয়ার জন্য তার একটি কন্সালটেন্সি ফার্ম আছে। গত আট বছরে ব্লেয়ার ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকাসহ বেশক’টি বাড়ি এবং একটি অবকাশ যাপনের খামার বাড়ির মালিক হয়েছেন। যদিও তিনি নিজে এসব অস্বীকার করেন।
যেভাবে শত কোটি টাকার মালিক ব্লেয়ার
২০০৭ সাল থেকেই সেটা শুরু। ক্ষমতা ছাড়ার এক মাসের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির দূত হিসেবে গিয়ে সেখানে রাজপরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মধ্যপ্রাচ্য দূত হিসেবে গাজা এবং পশ্চিমতীরে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া এবং সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে পরামর্শ দেয়াই ছিল তার দায়িত্ব। এই সুযোগে ব্লেয়ার উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী শেখদের কাছে আসার সুযোগ পান। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় এদের অনেকের সাথে পূর্ব পরিচয়ও বেশ কাজে লাগে।
তখন শান্তিদূত হিসেবে সফরে গিয়ে তার ব্যবসা বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের সরকারি লোকজনের সাথে বৈঠক করেন।
আবুধাবির শাসক শেখ আবদুল্লাহর সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে সবচেয়ে বেশি। তখন এক প্রকাশ্য বক্তব্যে শেখ আবদুল্লাহ বলেছিলেন, এই ব্যক্তি (ব্লেয়ার) শান্তিদূত হিসেবে কাজ করার জন্য খুবই দক্ষ একজন লোক। আবুধাবি তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী।
এরপর থেকে রাজপ্রাসাদেই অবস্থান করতেন ব্লেয়ার। রাজকীয় সব সুযোগ সুবিধা তার জন্য ছিল উন্মুক্ত। তার জন্য ছিল টাকায় লেনদেনের পরিবর্তে স্বর্ণে লেনদেনের সুযোগ! দুবাইর ক্রাউন প্রিন্স ব্লেয়ারের সাথে তার সম্পর্ক বর্ণনা করতে বলেছিলেন, তারা উভয়ে একই ‘রসায়ন’ ধারণ করেন। তারা্ উভয়ই কাতারভিত্তিক ইসলমপন্থী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধী।
তখন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্লেয়ারের প্রতিষ্ঠান টিবিএ’র বিভিন্ন ব্যবসায়িক চুক্তিতে অর্থায়ন শুরু করে। ইউরোপের সাইবেরিয়া, এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম এবং মঙ্গোলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কন্সালটেন্সি করার জন্য ব্লেয়ারের উপদেষ্টাদের যাবতীয় খরচ আমিরাত সরকার বহন করতো। কাজাখস্তানের স্বৈরশাসককেও আকর্ষণীয় চুক্তিতে পরামর্শ দিতেন ব্লেয়ার। এছাড়া ব্রাজিল, পেরু এবং আলবেনিয়াসহ কয়েকটি দেশে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েও কামিয়েছেন বড় অংকের টাকা।
টনি ব্লেয়ারের ব্যবসা সাম্রাজ্যের আকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ছোট্ট একটি উদাহরণ থেকে। তিনি তার ব্যবসার একটা অংশ পরিচালনার প্রশাসনিক দিক দেখে যে কোম্পানি, সেই উন্ডরাশ ভেনচারস লিমিটেডের কর্মকর্তা কর্মচারিদের চার বছরে বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে ৫৭ মিলিয়ন ইউরো (৫৭০ কোটি টাকা)।
বিলিয়নেয়ারদের মতো জীবন যাপন করা ব্লেয়ার বিলাসবহুল একাধিক প্রাইভেট জেট ব্যবহার করেন। স্বর্ণালি আর কালো রংয়ের মিশ্রণে তৈরি তার সবচেয়ে পছন্দের জেটটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ব্লেয়ার ফোর্স ওয়ান’।
সমালোচকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য দূত হিসেবে ব্লেয়ার বেশি কিছু করেননি। বিশেষ করে ব্লেয়ারের মতো মেধাবী একজন লোক যতটা করতে পারতেন। বিগত বছরগুলোতে গাজা এবং পশ্চিমতীর বিভিন্নভাবে ভোগান্তির শিকার হয়েছে। কিন্তু ওই সময়টিতে ব্লেয়ারের ব্যাংক ব্যালেন্স ঠিকই হুহু করে বেড়েছে।’ -দ্য টেলিগ্রাফ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button