কাশ্মীর বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বক্তব্য: বাংলাদেশী জমিয়তের হতাশ হওয়ার কিছু নেই

সৈয়দ মবনু: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বার্ষিক অধিবেশনে এক প্রস্তাবে কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলোপ ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রতি সমর্থন দেয়া হয়েছে। অবশ্য অন্যদিকে তারা আসামের এনআরসির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। তারা এই অধিবেশনে অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তান কাশ্মীরিদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা সাইয়্যদ মাহমুদ মাদানি এই অধিবেশনে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ভারতের নিরাপত্তা ও সংহতির প্রশ্নে তারা কারো সাথে কোনো আপোস করবেন না।
অন্যদিকে ২ সেপ্টেম্বর বিজেপির সাবেক সাধারণ্ সম্পাদক রাম লালের উদ্যোগে আরএসএস প্রধান মোহন ভগৎ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি আল্লামা সাইয়্যদ আরশাদ মাদানির মধ্যে দিল্লির কেশব কুঞ্জে সংঘ অফিসে এক বৈঠকে মাওলানা মাদানি কাশ্মীর বিষয়ে সরকারের কার্যক্রম সঠিক বলে মন্তব্য করেন। এছাড়া তাঁরা হিন্দু মুসলিম ঐক্য জোরদারসহ বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের এই দুই নেতা বা অধ্যাত্মিক গুরুর বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে জমিয়তের বিভিন্ন গ্রুপে এবং জমিয়ত বিরোধী কিছু ইসলামী দলে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যারা ধাতুগতভাবে জমিয়তের বিরোধী তাদের বক্তব্য নিয়ে আমার কোন মন্তব্য প্রয়োজন নেই। আমার প্রশ্ন তাদের কাছে যারা মনে করেন নিজদেরকে জমিয়তের সৈনিক বা কর্মি, তারা মাওলানা সাইয়্যদ আরশদ মাদানী কিংবা মাওলানা সাইয়্যদ মাহমুদ মাদানীর কাশ্মীর সম্পর্কিত বক্তব্যে হতাশ হওয়ার মতো নতুন কি শোনলেন যা তাদের আকাবির বা নেতারা পূর্বে বলেননি? তারা কি জানেন না যে, মাওলানা সাইয়্যদ আরশদ মাদানীর বাবা এবং মাওলানা সাইয়্যদ মাহমুদ মাদানীর দাদা মাওলানা সাইয়্যদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.) ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অখন্ড ভারতের পক্ষে লড়াই করেছেন? তারা কি শোনেননি মাওলানা সাইয়্যদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.) পাকিস্তান জন্মের সময় বিরোধীতা করে ময়দানে অনেক রাজনৈতিক লড়াই করেছেন? অখন্ড ভারত অর্থ কি ৩৭০ ধারা বাতিল নয়? অখন্ড ভারত অর্থ কি কাশ্মীরের স্বাধীনতা অস্বীকার করা নয়?
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্মি বা নেতা আজকে যারা হয়েছেন তারা হয়তো ইতিহাসের সেই পর্ব না-জানার কারণে মাওলানা সাইয়্যদ আরশদ মাদানী কিংবা মাওলানা সাইয়্যদ মাহমুদ মাদানীর কাশ্মীর সম্পর্কিত বক্তব্যে হতাশ হচ্ছেন, বাস্তবে ইতিহাসের অধ্যায়ে তাদের এখানে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ অখন্ড ভারত তাদের আকাবিরদের আদর্শ। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সিলেট অখন্ড ভারতে থাকবে না পাকিস্তানে যোগ দিবে সেই প্রশ্নে যখন গণভোট হয় তখন মাওলানা সাইয়্যদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর খলিফা জমিয়তের বাংলাদেশের নেতা হাফিজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র.) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অখন্ড ভারতের পক্ষে প্রকাশ্যে ময়দানে কাজ করেছেন জমিয়ত মাদানী গ্রুপ নিয়ে। অবশ্য মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানী (র.)-এর গ্রুপ তখন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। গণভোটে যখন অখন্ড ভারতপন্থীরা পরাজিত হলেন তখন মাওলানা সাইয়্যদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর খলিফা সিলেটের প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা আব্দুল জলিল বদরপুরী র. (প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান কাজিরবাজারীর পির) সিলেট থেকে ভারতের বদরপুরে হিজরত করেছিলেন। আশির দশকে একবার মাওলানা সাইয়্যদ আরশদ মাদানীর বড়ভাই এবং মাওলানা সাইয়্যদ মাহমুদ মাদানীর বাবা মাওলানা সাইয়্যদ আসআদ আল মাদানী (র.) সিলেটের সোবহানীঘাট মসজিদে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, কাশ্মীরে কোন জিহাদ হচ্ছে না, সেখানে যা হচ্ছে তা হলো রাষ্ট্রদ্রোহীতা বা দেশদগর্দি। সেই অনুষ্ঠানে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। তাই অখন্ড ভারতের চিন্তা কিংবা ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ধারা বাতিল করা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পুরাতন একটি চিন্তা বা দাবী, এখানে আরশদ মাদানী কিংবা মাহমুদ মাদানীর বক্তব্যে নতুন করে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
অবশ্য কাশ্মীর বিষয়ে মাদানী পরিবারের বক্তব্য সম্পর্কে পাকিস্তান জমিয়তের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান মিমাংসিত একটি সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি পাকিস্তানে কাশ্মীর বিষয়ক সংসদিয় কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে এক সাংবাদিক তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন কাশ্মীর বিষয়ে মুসলমানেরা কি দারুল উলুম দেওবন্দ এর বক্তব্য বা ফতুয় অনুসরণ করবে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় মুসলিম দারুল উলুম দেওবন্দ এর বক্তব্য এবং পাকিস্তানের মুসলিম পাকিস্তানের আলেমদের বক্তব্যকে অনুসরণ করবে।’ প্রকৃত অর্থে এটাই সত্যকথা, প্রত্যেক দেশের মুসলমানেরা নিজ নিজ দেশের আলেমদেরকে অনুসরণ করা উচিৎ। তা শুধু কাশ্মীর বিষয়ে নয়, দ্বীনের প্রত্যেক বিষয়ে। স্মরণ রাখতে হবে, দ্বীন অর্থ নিচক ধর্ম নয়, দ্বীন বলে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থাকে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের মুসলমানেরা অনুসরণ করবে বাংলাদেশের আলেমদের বক্তব্য বা ফতোয়াকে। কারণ, প্রত্যেক দেশের আলেম বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাদের দেশীয় চিন্তা-চেতনা থেকে। প্রত্যেকের বক্তব্যকে তার নিজ স্থানে রেখে বিচার-বিবেচনা করলে অন্য স্থানের কেউ বিভ্রান্ত কিংবা হতাশ হওয়ার কিছু নেই। স্থান-কাল-পাত্র না বুঝলে অনেক সময় বক্তব্য থেকে ভুল ধারণারও সৃষ্টি হতে পারে। বুঝতে হবে দারুল উলুম দেওবন্দ আর দারুল উলুম করাচি কিংবা মঈনুল উলুম দেওবন্দ হাটাজারী স্থান-কাল-পাত্রে সমান নয়। তাই তাদের ফতোয়াও সমান হতে নাও পারে। তেমনি ভাবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ সমান নয়। তাই কাশ্মীর বিষয়ে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের বক্তব্যে বাংলাদেশী জমিয়তিরা হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তারা বলেছেন তাদের মতো করে, আপনারা বলুন আপনাদের মতো করে।
-সৈয়দ মবনু এর টাইমলাইন থেকে

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button