একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আজ

মিয়া হোসেন: প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে একতরফা প্রচারণা শেষে আজ রোববার বাংলাদেশে ২৯৯টি আসনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে। ভোট গ্রহণ শেষে ফলাফল প্রকাশ করা হবে কেন্দ্রেই। এবারের নির্বাচনে প্রচারণার সময় একতরফা প্রচারণা, ধরপাকড় ও সহিংসতার ঘটনায় ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। তবে আজ ভয় না পেয়ে ভোট কেন্দ্রে নিরাপদে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। সেই সাথে প্রার্থীর এজেন্টদের হয়রানি না করতে আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় সব দলের সমান সুযোগ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। এমন কী এ বিষয়ে খোদ কমিশনের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা গেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের রদবদলসহ পুলিশী হয়রানি ও গ্রেফতার বন্ধের জন্য বিভিন্ন দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের অভিযোগের অধিকাংশেরই কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আজ রোববার দেশের সাড়ে ১০ কোটি ভোটার যাদের পক্ষে রায় দেবে, আগামী পাঁচ বছর তাদের হাতেই থাকবে বাংলাদেশের শাসনদ-। অধিকাংশ নিবন্ধিত দলের বর্জনে ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার পাঁচ বছর পর এবারের নির্বাচনে সব দলকেই পাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ লাখের মত সদস্য, ৭ লাখের মত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক-পর্যবেক্ষক মিলিয়ে ১৫ লাখ লোক নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি। সিইসি নূরুল হুদা গত ৮ নবেম্বর তফসিল ঘোষণার পর ১২ নবেম্বর পুনঃতফসিল করা হয়। ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা প্রচার শুরু করেন, সেই সুযোগ শেষ হয় শুক্রবার সকাল ৮টায়।

আসন: এক প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় ৩০০ আসনের মধ্যে আজ রোববার ভোট হবে ২৯৯ আসনে। বাকি থাকা গাইবান্ধা-৩ আসনে ২৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ নির্ধারণ করেছে ইসি। ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২ আসনে এবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হবে। বাকি ২৯৩টি আসনে ভোট হবে সনাতন পদ্ধতিতে ব্যালট পেপার ব্যবহার করে।
ভোটার: ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৬ হাজার ৮২৩ জন ভোটারের মধ্যে ৫ কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৬২০ জন পুরুষ; ৫ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ২০৩ জন নারী।
কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: ৪০ হাজার ৫১টি ভোট কেন্দ্রের ২ লাখ ৫ হাজার ৬৯১টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হবে।
ফল ঘোষণা: কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনা শেষে প্রিজাইডিং অফিসাররা লিখিত ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ঢাকায় নির্বাচন ভবনের ফোয়ারা প্রাঙ্গণে বিশেষ মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে।
প্রতিদ্বন্দ্বী: এবার নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন ১৮৬১ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৭৩৩ জন দেশের ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী; বাকি ১২৮ জন স্বতন্ত্র।
কোন দলের কত প্রার্থী: এলডিপি ৮ (ধানের শীষ ৪), জেপি ১১ (মহাজোট ২), সাম্যবাদী দল ২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৯ (ধানের শীষ ৪), সিপিবি ৭৪, আওয়ামী লীগ ২৬১ (নৌকা ২৭৪), বিএনপি ২৭২ (ধানের শীষ ২৯৭), গণতন্ত্রী পার্টি ৬, ন্যাপ ৯, জাতীয় পার্টি ১৭৬ (মহাজোট ২৫), বিকল্পধারা ২৫ (নৌকা ৩), ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ (নৌকা ৫), জাসদ ১২ (নৌকা ৩), জেএসডি ১৯ (ধানের শীষ ৪), জাকের পার্টি ৯০, বাসদ ৪৫, বিজেপি ৩ (ধানের শীষ ১), তরিকত ফেডারেশন ১৭ (নৌকা ১), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২৩, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ ৪৮, এনপিপি ৭৯, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম ৮ (ধানের শীষ ৩), গণফোরাম ২৭ (ধানের শীষ ৭), গণফ্রন্ট ১৩, পিডিপি ১৪, বাংলাদেশ ন্যাপ ৩, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১১, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১৮, কল্যাণ পার্টি ২ (ধানের শীষ ১), ইসলামী ঐক্যজোট ২৪, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ৫, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২৯৮, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২৫, জাগপা ৪, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ২৮, খেলাফত মজলিস ১২ (ধানের শীষ ২), বিএমএল ১, মুক্তিজোট ২, বিএনএফ ৫৭ জন।

বিএনপিসহ তাদের জোট শরিক আটটি দল ধানের শীষে ভোট করছে এবার। নিবন্ধিত দলের বাইরে জামায়াত ও নাগরিক ঐক্যের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক ১৬টি দল এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে। এছাড়া তাদের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির নিজেদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে।
গণতান্ত্রিক বাম জোটের দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কাঁস্তে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মই এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কোদাল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ হাতপাখা, বিএনএফ টেলিভিশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বটগাছ, ইসলামী ঐক্যজোট মিনার, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল বাঘ, জাকের পার্টি গোলাপ ফুল প্রতীক নিয়ে ভোটে রয়েছে।

বিধিনিষেধ: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ভোটের দিন ২৪ ঘণ্টা নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সি ক্যাব, বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোট চলাচলের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে শনি থেকে সোম তিন দিন।
তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, সরকারি গাড়ি, সেবা সংস্থা যেমন- ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রবাহী গাড়ি এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, কেন্দ্রের ভেতরে কেবল প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ইনচার্জ মোবাইল ব্যবহার করতে পারবেন।
ভোটাররা কোনোভাবেই বুথ বা কেন্দ্রের ভেতরে ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। ভোটাররা কেউ মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে গেলেও তা বন্ধ রেখে যেতে হবে।
ভোট দিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়বে না। তবে ভোটারের এনআইডি নম্বর, ভোটার নম্বর বা স্মার্ট কার্ড সঙ্গে থাকলে ভোটার তালিকা থেকে নাম বের করতে সুবিধা হবে।

৬ আসনে ইভিএম: যে ৬টি আসনে এবার ইভিএমে ভোট হবে, সেখানে ৮৪৫টি কেন্দ্রের ৫ হাজার ৪৫টি ভোটকক্ষে মোট ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪ জন ভোটার রয়েছেন। মোট ৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে থেকে তারা বেছে নেবেন ছয়জনকে।
এ ছয় আসনের ভোটার সংখ্যা হলো, রংপুর-৩ এ ৪,৪১,৬৭১ জন, খুলনা-২ এ ২,৯৪,১১৬ জন, সাতক্ষীরা-২ এ
৩,৫৬,২৪৬ জন, ঢাকা-৬ এ ২,৬৯,৩১৫ জন, ঢাকা-১৩ এ ৩,৭২,৭৭৫ জন, চট্টগ্রাম-৯ এ ৩,৯০,৪৩১ জন।
কর্মী বাহিনী: ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার জেলা এবং ৫৮২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার উপজেলা পর্যায়ে সার্বিক তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করবেন। ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন কেন্দ্রের দায়িত্বে। তাদের অধীনে ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন পোলিং অফিসার ভোটগ্রহণের মূল কাজটি করবেন।
নিরাপত্তা: ভোটের মাঠের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য নিয়োজিত থাকবেন ভোটেকেন্দ্রে। এর মধ্যে ১ লাখ ২১ হাজার পুলিশ; ৪ লাখ ৪৬ হাজার আনসার এবং ৪১ হাজার গ্রাম পুলিশ রয়েছেন।
৬০০ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) র‌্যাব এবং ৯৮৩ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) বিজিবি সদস্যও রয়েছেন ভোটের মাঠে। এর বাইরে ৩৮৯ উপজেলায় ৪১৪ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন ) সেনা সদস্য, ১৮ উপজেলায় নৌবাহিনীর ৪৮ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) এবং ১২ উপজেলায় ৪২ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) কোস্টগার্ড ভোটের দায়িত্ব পালন করছেন।
সারা দেশে ১ হাজার ৩২৮ জন নির্বাহী হাকিম এবং ৬৪০ জন বিচারিক হাকিম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে থাকবেন। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটির ২৪৪ জন সদস্য থাকবেন ভোটের মাঠে।
পর্যবেক্ষক: ৮১টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন প্রতিনিধি, ৩৮ জন (ফেমবোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েল্থ থেকে আমন্ত্রিত) বিদেশি পর্যবেক্ষক, বিভিন্ন বিদেশি মিশনের ৬৪ জন কর্মকর্তা এবং দূতাবাস ও বিদেশি সংস্থায় কর্মরত ৬১ জন বাংলাদেশি এবার ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।
বাজেট: একাদশ সংসদ নির্বাচনে পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলায় ৭০০ কোটি টাকার খাতওয়ারি বরাদ্দ অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। এর দুই- তৃতীয়াংশই যাবে নিরাপত্তা খাতে।
সর্বশেষ নির্বাচন: বিএনপিসহ অধিকাংশ নিবন্ধিত দলের বর্জনের মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে একক প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭টি আসনে ৪০.০৪ শতাংশ ভোট পড়ে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট ২৩৪ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। জাতীয় পার্টি ৩৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, তরিকত ফেডারেশন ২, জাতীয় পার্টি-জেপি ২, বিএনএফ ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসন পায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button