বড় জোটে ইসলামি দলগুলোর অবমূল্যায়ন?

মাত্র কয়েক মাস আগেও দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ইসলামি দলগুলোর বিশেষ মূল্যায়ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। বিশেষত সরকারের সঙ্গে কওমি ভিত্তিক কয়েকটি দল ও কতিপয় ইসলামি নেতার যোগাযোগের মাত্রা দেখে অনেকেই মনে করছিলেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আলেম রাজনীতিকরা উভয় শিবিরে যথেষ্ট মূল্য পাবেন। যদিও তাদের যোগাযোগ, যোগাযোগের মাত্রা ও উচ্ছসিত ভাষা নিয়ে অস্বস্তি ছিল সাধারণ আলেম সমাজে। তবুও আলেমদের ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল, তারা মূল্যায়িত হোক।

অপরদিকে বিএনপির সঙ্গে আলেমদের যোগাযোগ ও রাজনৈতিক সমঝোতার প্রায় দুই দশক পার হয়েছে। চিন্তা, আদর্শ, বক্তব্য নানাবিধ সাদৃশ্যের কারণে রাজনৈতিক জোটের জন্য বিএনপিকেই প্রথম বেছে নিয়েছিলেন আলেমরা। সে হিসাবে বিএনপির কাছে আলেম সমাজের প্রত্যাশার পরিমাণ ছিলো আরেকটু বেশি।

আওয়ামী লীগের ছায়াসঙ্গী এরশাদ আলেমদের দলে ভেড়ানোর জন্য বলেছিলেন, আমি শেষ জীবনে কয়েকজন আলেমকে জাতীয় সংসদে দেখতে চাই। তার কথায় সরলভাবে বিশ্বাস করেন কিছু ইসলামি রাজনীতিক। জাতীয় সংসদে ইসলাম ও মুসলমানের প্রতিনিধিত্বের আশায় জোটবদ্ধ হন তার সাথেও।

কিন্তু বড় এই তিন দলের সঙ্গেই জোট করে হতাশ হয়েছেন ইসলামি দলগুলোর নেতা-কর্মীরা। নির্মোহভাবে বললে, দ্বিধা ছাড়াই বলা যায় ইসলামি দলগুলো নির্বাচনী রাজনীতি ও আসন বণ্টনে অবমূল্যায়নের শিকার। মাত্র কয়েক মাস আগেও আশা-আকাঙ্ক্ষার যে রঙিন বেলুন ফুলে উঠেছিলো আসন বণ্টন শেষে তা চুপসে গেছে।

ক্ষমতাসীন মহাজোট থেকে একটি আসনও পাননি মূলধারার কোনো ইসলামি দল বা ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ছায়াসঙ্গী এরশাদও মহাজোট থেকে প্রাপ্ত আসন থেকে একটিও ছেড়ে দেননি শরিক ইসলামি দলগুলোর জন্য। একই চিত্র বিএনপি শিবিরে। সেখানে ৪টি ইসলামি দলকে দেয়া হয়েছে ৫টি আসনের মনোনয়ন। যা এখনও চূড়ান্ত কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে।

সার্বিক বিচারে বলা যায়, ইসলামি দলগুলো ব্যাপক অবমূল্যায়ন ও উপেক্ষার শিকার হয়েছেন জোটের রাজনীতিতে। কিন্তু কেন?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এবারই ইসলামি শক্তিসমূহের বিক্ষিপ্ততা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়েছে। প্রত্যেক দল ও দলের কর্ণধার নিজস্ব হিসাব নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছে। সামগ্রিকতার অভাব ছিলো প্রত্যেকের কাজে-কর্মে। ফলে তাদের মূল্যায়নও হয়েছে বিক্ষিপ্ত ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক।

তারা আরও মনে করেন, ইসলামি দলগুলো তাদের প্রত্যাশা পূরণে নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলোর সঙ্গে শুধু সদাচার ও সৌজন্যই দেখিয়েছে, আপোষ-মীমাংসার মধ্য দিয়ে সব পেয়ে যাবেন এমন ধারণারই প্রকাশ পেয়েছে তাদের আচরণে। বিপরীতে নিজেদের ব্যক্তিত্ববোধ, নিজস্বতা, কৌশল ও রাজনৈতিক বার্গেনিং-এর মতো বিষয়গুলোর অভাব ছিলো তাদের মধ্যে। আর এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করায় ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলেম রাজনীতিকরা তুলনামূলক ভালো মূল্যায়ন পেয়েছিলেন।

আশির দশকের শেষভাগ থেকে ইসলামি রাজনীতির গতিধারা পর্যবেক্ষণ করছেন মাওলানা আবু হেলাল। তার বিশ্লেষণ হলো, শাসক দলের কাছে ইসলামি রাজনীতিকদের একটি ধারার আত্মসমর্পণ, তৈলমর্দন নীতি ও ব্যক্তিত্বহীন আচরণ উভয় শিবিরেই রাজনৈতিক হিসাবটাকে দুর্বল করে দিয়েছে। কারণ, ক্ষমতাসীনদের প্রতি অতি মাত্রায় ঝুঁকে যাওয়ায় তাদের কাছে এসব নেতাদের গুরুত্বহীন করে তুলেছে। অন্যদিকে ইসলামি ধারার সম্মিলিত আয়োজনসমূতে সরকার ঘণিষ্ঠদের অংশগ্রহণ বিরোধী শিবিরকেও সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সবাই।

এদেশে আলেম উলামাদের ত্যাগ ও অবদান, প্রভাব ও প্রতিপত্তি এবং ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের অনুরাগ বিচার করলে বলতে হবে, আলেম রাজনীতিকরা তাদের সঠিক মূল্যায়ন কখনোই পাননি। তবে কোনো সন্দেহ নেই এবারের জাতীয় নির্বাচনে বড় দলের কাছে আলেম রাজনীতিকদের অবমূল্যায়ন অনেক বেশি চোখে পড়ছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার তা অনেক বেশি প্রকট।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বড় দলগুলোর আচরণ থেকে ইসলামি দলগুলোর শেখার আছে অনেক কিছু। যেমন, তাদের উচিত বিক্ষিপ্ততা পরিহার করে স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম তৈরি, আত্মশক্তিতে বলিয়ান হওয়ার পর অন্যের সঙ্গে বার্গেনিংয়ে যাওয়া। শুধু বাংলাদেশ নয়; সাম্প্রতিককালের পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচন থেকেও এই বার্তা নেয়া যায়। দেশ দুটোতে ইসলামি দলগুলো নিজস্ব প্লাটফর্ম তৈরি করে নির্বাচনী ফলাফল ও ক্ষমতার ভাগাভাগি প্রশ্নে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে যেতে পেরেছে।

অনেকেই জোটবদ্ধ ইসলামি দলগুলোর জন্য এখনো কিছু সম্ভাবনা বাকি আছে বলেই দাবি করছেন। তারা বলছেন, প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত জোটের কাছ থেকে আরও কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু এ পর্যন্ত যে আচরণ বড় দলগুলো করেছে, তাতে প্রশ্নটা থেকেই যায়-সত্যিই কি সম্ভাবনা বেঁচে আছে? মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পরও বার্গেনিংয়ের কতোটুকুই বা হাতে থাকে দলগুলোর?

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন প্রতিকূলতার মুখে ইসলামি দলগুলোর কৌশলচিন্তা ও আগামীর কর্মসূচির পুনর্গঠন প্রয়োজন। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে কওমি ভিত্তিক ইসলামি দলগুলোকে আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত নতুন কৌশল সামনে নিয়ে এগুতে হবে। নতুবা শুধু আসন বণ্টনের রাজনীতি নয়, অবমূল্যায়নের ধারা শুরু হতে পারে সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্য সকল ক্ষেত্রেও।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলের ইসলামি দলগুলোর তরুণ কয়েকজন রাজনীতিক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘এক আসনে একজন ইসলামি দলের প্রার্থী’ নীতিতে সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই প্রক্রিয়াকে তারা এগিয়ে নেবেন। কিন্তু আসন বণ্টন শুরু হওয়ার পর পুরো প্রক্রিয়াটাই ভেস্তে যায়। তারা তাদের দলগুলোর পারস্পরিক নির্বাচনী সমঝোতার চেয়ে বড় দলের নামমাত্র মনোনয়নকে শ্রেয় মনে করছেন। অথচ তাদের এই সমঝোতা এদেশের ইসলামি রাজনীতিতে বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারতো। এতে বড় দলগুলো ইসলামি দলগুলোকে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ পেতো।

অবশ্য অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ইসলামি দলগুলোর অবমূল্যায়নের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ইচ্ছারও প্রভাব থাকতে পারে। যেমন, মাত্র একদিন আগেই আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদ আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোকে থামানোর আহবান জানিয়ে রেজুলেশন উত্থাপন করেছে। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে তাদের এসব আহবানও যে কম ক্রিয়াশীল নয় তা অনেকেরই জানার কথা।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন প্রতিকূলতার মুখে ইসলামি দলগুলোর কৌশলচিন্তা ও আগামীর কর্মসূচির পুনর্গঠন প্রয়োজন। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে কওমি ভিত্তিক ইসলামি দলগুলোকে আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত নতুন কৌশল সামনে নিয়ে এগুতে হবে। নতুবা শুধু আসন বণ্টনের রাজনীতি নয়, অবমূল্যায়নের ধারা শুরু হতে পারে সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্য সকল ক্ষেত্রেও।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button