আজব দেশে করি বাস, নেতার দোষে সর্বনাশ

আব্দুল আহাদ
বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশার জন্য অনেক ক্ষেত্রে এ দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরাই অনেকটা দায়ী। আমাদের নেতা নেত্রীরা যথা সময়ে সঠিক সিন্ধান্ত না নেয়ার কারনে সৃষ্ট পরিস্থিতির পরিণতি এ দেশের সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হয়। রাজনৈতিতে অস্থিরতা, সংঘাত, সহিংসতা যেন বাংলাদেশে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে সহনশীলতা না থাকার কারনে আজ বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। আজব খেলা চলছে পার্লামেন্টে, যেখান থেকে জাতির ভাগ্য নির্ধারণ হওয়ার কথা, সেখানে বসে আমাদের প্রতিনিধিরা একে অন্যকে ঘায়েল করতে নানা কটুক্তি মূলক বাক্য ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের ইতিাহসে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটার ছাড়া নির্বাচন ও সংখ্যাগরিষ্ট সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়  নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি দুনিয়ার রাজনৈতিক সচেতন মানুষজনকে হতবাক করেছে। সরকার গঠনে জাতীয় পার্টি অংশ গ্রহণ করে মন্ত্রীর ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের বিষয়টি হাস্যরসের সৃষ্টি করে। এ দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারে অংশ গ্রহণ করে বিরোধী দলের আসনে বসার বিষয়টি সংবিধান সম্মত নয়। কে শোনে কার কথা, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান এরশাদ নিজে নির্বাচন বর্জনের আহবান করে শেষ পর্যন্ত সংসদ সদস্য হয়ে আজ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করছেন। কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে জাতীয় পার্টি একই সময়ে সরকারের অংশীদার ও বিরোধী দলের ভূমিকা পালন দু’টি কাজই করে যাচ্ছে। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ দেশে অনেক কিছু হয়েছে। রাজপথে রক্ত ঝরেছে, হরতাল-অবরোধের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।  আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে খেটে খাওয়া মানুষ চরম দূর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তারপরও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার একতরফা সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবার সরকার গঠন করে। নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করে সকলের অংশ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিরোধী দল কঠোর আন্দোলনে মাঠে নামলে এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলি সংলাপের মাধ্যমে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া তখন বলেছিলেন, নির্ধারিত সময়ের অবরোধ শেষ হলে আলোচনায় বসবেন। দু’নেত্রীর টেলিসংলাপের কথোপকথন মিডিয়ার বদৌলতে সারা দুনিয়ার মানুষ জানতে পেরেছে। তাদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনা গোপন থাকেনি। সেদিন শেখ হাসিনা সংলাপের আহ্বান জানালেও বিরোধী দলীয় নেত্রী আন্দোলনের বিষয়ে কঠোর ছিলেন বলে শেষ পর্যন্ত আলোচনা হয়নি। আজ দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসন করার ইচ্ছা পোষণ করলেও সরকার দল তাতে পাত্তা দিচ্ছে না। তারা জোর গলায় বলছেন, এ মুহূর্তে আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই, ৫ বছর পর নির্বাচন হবে, এরপূর্বে নির্বাচন সংক্রান্ত কোন বিষয়ে তারা কথা বলতে রাজি নন। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গ ভবনে গিয়েছিলেন। সেদিন বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক এ সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে সংবিধানের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ধর্য্য সহকারে  খালেদা জিয়ার বক্তব্য শোনে বলেছিলেন, আপনি ও শেখ হাসিনা পরস্পর বিরোধী দু’টি দলের প্রধান হলেও একটি জায়গায় আপনাদের মিল রয়েছে। খালেদা জিয়া বিষয়টি জানতে চাইলে স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে সেদিন খালেদা জিয়ার প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটা ছিনিয়ে নেয়া যায় সে ব্যাপারে আপনারা দু’জনই সমভাবে কাজ করেছেন। রাষ্ট্রপতি সংসদে যে বক্তব্য দেন তা মন্ত্রীসভা অনুমোদন করে দেয়। একটি বাক্যও রাষ্ট্রপতি নিজে সংযোজন করতে পারেন না, যা রাষ্ট্রপতি নিয়ম রক্ষায় সংসদে দাঁড়িয়ে পাঠ করেন। সেদিন রাষ্ট্রপতি বেগম খালেদা জিয়াকে আরও বলেছিলেন, সংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্রপতিকে পঙ্গু বানিয়ে রাখা হয়েছে। একজন পঙ্গু মানুষের কাছে কি চাইতে পারেন? আর পঙ্গু মানুষ অন্যকে কি বা দিতে পারে! রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বক্তব্য শোনে খালেদা জিয়া ও তার সতীর্থরা শুধু হেসেছিলেন। আব্দুল হামিদ তারপরও খালেদা জিয়াকে আশ্বস্থ করে বলেছিলেন, আমি আপনার দাবি ও কথাটুকু যথাযথ ভাবে যথাস্থানে পৌঁছে দেব। একই বিষয়ে এ দেশের প্রখ্যাত আইনজীবি সংবিধান প্রনেতা ড. কামাল হোসেন সিভিল সোসাইটির বিশিষ্টজনদের নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে আপনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারেন। উত্তরে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, সংবিধানতো আপনিই তৈরি করেছিলেন। সংবিধানের প্রতি অনুগত্য রাখার শপথইতো আমি নিয়েছি। আমাকে দেখান শপথ অনুযায়ী সংবিধানের কোন জায়গায় সুযোগ আছে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার? রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তখন ড. কামাল হোসেন ও তার সঙ্গিদেরকে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি হিসাবে সংবিধানের আলোকে যেভাবে ভূমিকা পালন কথা ছিল, বিগত দিনে রাজনীতিবিদরা সে সুযোগটি না রাখার কারণে আজ তিনি যথাযথ ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাচ্ছেন না। দেশের প্রথম সারির দৈনিক সংবাদপত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনের চীফ রির্পোটার পীর হাবিবুর রহমান বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর সুনামগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিছবাহ সহ বিশিষ্ট ক’জন ব্যক্তিকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গ ভবনে গেলে ভাটি বাংলার মানুষের জীবন চিত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপকালে হাওরের রাজপুত্র রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এ সব কথাগুলো বলেন। আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হলেও ভাটি বাংলার মানুষের জীবন যাত্রার কথা ভুলে যাননি। রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি হাওর জনপদের মানুষের খোঁজ খবর কি ভাবে রাখেন, ঐসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে গত ৪ফেব্রুয়ারী সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। তার প্রতিবেদনে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকসহ বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ পায়। আওয়ামীলীগ সরকার বিগত ৫ বছরে তার দলের নেতাকর্মীদের উপর দায়েরকৃত হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী, সাজাপ্রাপ্ত আসামী, দাগী অপরাধী রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি পেলেও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনেককে আজ অপরাধ ছাড়াই আসামী হয়ে জেলে যেতে হচ্ছে। সরকার দলের রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেট এম.সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পুড়ানোর সঙ্গে জড়িতরা মামলা থেকে আজ রেহাই পাচ্ছে। অথচ ঘটনাস্থল থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করার পরও বিরোধী দলের শীর্ষ অনেক নেতা গাড়ি পুড়ানো মামলার আসামী হয়ে কারাবরণ করতে হচ্ছে। আমরা এমন এক আজব দেশে বসবাস করছি। নেতা-নেত্রীরা তাদের স্বার্থে অনেক কাজ করেন, যা জাতির জন্য মহাদূর্ভোগ সৃষ্টি করে, আর এর পরিণতি ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষ জনকে। বিরোধী দলের নেত্রী হুংকার দিয়ে বলছেন, উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। আন্দোলন সংগ্রাম, আর হরতার-অবরোধ হলে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কি অবস্থায় হয়, তা তো সবার জানা। আগামী দিনে জাতির ভাগ্যে কি রয়েছে এ নিয়ে প্রতিটা মুহূর্তে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে দেশবাসী। দেশের শান্তিপ্রিয় প্রতিটি মানুষ চায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শীতার কারণে জাতির ভাগ্যে যেন কোন দূর্যোগ নেমে না আসে। একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের নেতা-নেত্রীরা দল ও ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশের মাটি ও মানুষের স্বার্থকে প্রধান্য দিয়ে কাজ করবেন এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ তা কামনা করে।
লেখক: সভাপতি গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাব, সিলেট

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button