শতবর্ষে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড

ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে এসে বিভিন্ন সময়ে যে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল, শাসিত ভারতের ওপর অস্ত্রবাজি করেছিল- সেসব ঘটনা হার মেনেছিল আজ থেকে শত বছর আগের জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার কাছে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। মিত্রশক্তির সঙ্গে ব্রিটিশরা যুদ্ধজয়ী বীর। যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণে তখন তারা ভার্সাই চুক্তি নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিপুঞ্জের গঠন নিয়ে।

অথচ একই সময়ে এই ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ নিয়ন্ত্রণে যে নৃশংসতার আশ্রয় নিয়েছিল, তাকে ‘সভ্যতার মোড়কে বর্বরতা’ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! কথা ছিল যুদ্ধের পর ভারতীয়রা স্বাধিকার ফিরে পাবে। কিন্তু স্বাধিকারের চেতনা ও উদ্দীপনা অবদমন করতে শঠতার সঙ্গে হঠাৎ মারমুখী অবস্থান গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। ঘটনার শত বছর পরও ভারতীয়রা ‘ব্রিটিশ’ শব্দটিকে শঠতা-কপটতার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করে।

সেদিন অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরসংলগ্ন জালিয়ানওয়ালাবাগে শিখদের নববর্ষ উৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন নানা ধর্মের অন্তত ২০ হাজার মানুষ। শহরে তখন চলছিল রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলন থামাতে ব্রিটিশ সরকার জারি করেছিল ১৪৪ ধারা। সে ধারা ভঙ্গ করেই নববর্ষ উৎসব পালনের জন্য সবাই সমবেত হয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের ঐতিহাসিক ময়দানে। ময়দানের চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশদ্বারও সংকীর্ণ। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের কানে পৌঁছে যায় এই জমায়েতের কথা। তৎক্ষণাৎ তিনি বন্দুকধারী একশ’ সেনা ও সাজোয়া যান নিয়ে হাজির হন সেখানে। মূল ফটক বন্ধ করে কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই নিরীহ ও নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। এতে স্তম্ভিত হয়ে যায় উপস্থিত লোকজন। একটানা ১০ মিনিট ধরে চলে গুলিবর্ষণ। ১,৬৫০টি গুলি কেড়ে নেয় কমপক্ষে ৩৭৯ মানুষের প্রাণ, আহত হয় তারও বেশি। ময়দানের পাশেই ছিল একটি কুয়ো। কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে অসহায় মানুষ। তাদেরকে কুয়োর মধ্যে পাথরচাপায় হত্যা করে ডায়ার বাহিনী।

দু’দিন পরে, ১৫ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও বিমান ব্যবহার করা হয়। ফলে সেদিন আরও ১২ জন প্রাণ হারায়, আহত হয় আরও শতাধিক। ইতিহাস ব্রিটিশদের ক্ষমা করেনি। সভ্যতার ইতিহাসে ব্রিটিশদের এই নির্মম গণহত্যা একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। জেনারেল ডায়ার একজন খুনি হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত।

১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার প্রায় এক শতাব্দী পর ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে এসে হত্যাকান্ডের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, ‘এটি ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যকান্ডের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন ব্রিটিশদের দেয়া নাইটহুড সম্মান। ব্রিটিশদের প্রদত্ত সম্মাননা তাদেরই মুখে ছুড়ে মারা চরম অপমানের, পরিষ্কার অর্থে ব্রিটেনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখানো। ইতিহাসে জঘন্যতম এ হত্যাকান্ডের শতবর্ষে নিহতদের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button