খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন তিনি

Aminaযারা সত্য পথে ফিরে যেতে চান, ইসলাম তাদেরকে দেয় পবিত্রতা ও শান্তি। আর ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে এমনই পবিত্রতা ও শান্তি পেয়েছেন আমিনা এসিলমির মতো পশ্চিমা নাগরিকরা।
এ্যামি এওয়ার্ড প্রাপ্ত সাংবাদিক আমিনা এসিলমির জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ মার্চ আমেরিকার ওকলাহামায়। তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক। তিনি মনে করতেন, ইসলাম একটি কৃত্রিম ধর্ম এবং মুসলমানেরা হল অনুন্নত ও পশ্চাদপদ একটি জাতি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন টার্মের ক্লাশে ভর্তি হবার সময় কম্পিউটারে নিবন্ধনের একটি ভুল তার জীবনের মোড় পুরোপুরি বদলে দেয়। এরপর থেকে তিনি বিশ্ব মুসলিম নারী সমাজের সভানেত্রী হিসেবে মুসলিম মহিলাদের অধিকার রক্ষার কাজ করেছেন। ২০০৯ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে প্রকাশিত রয়াল ইসলামিক স্ট্র্যাট্যাজিক স্টাডিজে প্রকাশিত ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিমের নামের তালিকায় তার নাম স্থান পায়।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মার্কিন নও-মুসলিম আমিনা এসিলমির জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। এক সময়ের খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক এই নারী আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মানুষের মনে জ্বালাতে পেরেছেন ইসলামের আলোর শিখা। তিনি বলেছেন, ইসলাম আমার হৃদয়ের স্পন্দন ও আমার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত রক্তধারা এবং আমার সমস্ত প্রেরণার উৎস। এ ধর্মের সুবাদে আমার জীবন হয়েছে অপরূপ সুন্দর ও অর্থপূর্ণ। ইসলাম ছাড়া আমি কিছুই নই।
আমিনা এসিলমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন টার্মের ক্লাশে ভর্তি হওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে গিয়ে একটি ভুল বিষয়ের ক্লাশে ভর্তি হন। কিন্তু সে সময় শহরের বাইরে থাকায় তিনি তার এই ভুল বুঝতে পারেননি। পরে যখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন জানতে পারেন, এই বিষয়ের ক্লাশে যোগ দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আর ওই ক্লাশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ছিলেন আরব মুসলমান।
যদিও আমিনা এসিলমি আরব মুসলমানদের ঘৃণা করতেন, কিন্তু বৃত্তির অর্থ বাঁচানোর জন্য তাদের সহপাঠী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না । এ অবস্থায় তার মন খুব খারাপ হয়ে পড়ে। কিন্তু তার স্বামী যখন বললেন, হয়তো স্রষ্টা এটাই চেয়েছিলেন এবং তিনি হয়তো তোমাকে আরব মুসলমানদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের জন্য মনোনীত করেছেন। তখন খৃস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই ক্লাশে গেলেন।
বিশ্ববিদ্যালের মুসলিম সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগ হলেই নানা অজুহাতে তাদের কাছে খ্রিস্ট ধর্মের দাওয়াত দিতেন। তিনি তাদের বলতেন, ঈসা মাসিহ’র অনুসরণের মাধ্যমে তারা যেন নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করেন। কারণ, ঈসা মাসিহ মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আরব মুসলিম শিক্ষার্থীরাও বেশ ভদ্রতা ও সম্মান দেখিয়ে আমিনার কথা শুনতেন। কিন্তু তাদের মধ্যে এইসব কথার কোনো প্রভাব পড়ত না। এ অবস্থায়  আমিনা ভিন্ন পথ ধরতে বাধ্য হন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মুসলমানদের বই-পুস্তক দিয়েই তাদের কাছে এ ধর্মের ভুল চিন্তা-বিশ্বাস প্রমাণ করব। এই উদ্দেশ্যে আমার বন্ধুদের বললাম, তারা যেন আমার জন্য পবিত্র কুরআনের একটি কপিসহ কিছু ইসলামী বই নিয়ে আসেন, যাতে এটা দেখানো যায় যে, ইসলাম ধর্ম একটি মিথ্যা ধর্ম এবং তাদের নবীও আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নয়।
এভাবে আমিনা বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া পবিত্র কুরআন পড়া শুরু করেন। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে পাওয়া দুটি ইসলামী বইও পড়েন তিনি। এ সময় তিনি ইসলামী বই-পুস্তক পড়ায় এত গভীরভাবে নিমজ্জিত হন যে, দেড় বছরের মধ্যে ১৫টি ইসলামী বই পড়েন এবং পবিত্র কুরআন দু’বার পড়া শেষ করেন। চিন্তাশীল হয়ে উঠা আমিনা বদলে যেতে থাকেন। মদ্যপান ও শূকরের মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন । সব-সময়ই পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকতেন এবং নারী-পুরুষের অবাধ-মেলামেশার সুযোগ থাকত এমন সব পার্টি বা উৎসব এড়িয়ে চলতেন। সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আমিনা বলেছেন-
কখনো ভাবিনি, ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে গেলে বিশেষ ঘটনা ঘটবে এমনকি আমার প্রাত্যহিক জীবন-ধারাও বদলে যাবে। সে সময় এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, খুব শিগগিরই আমার হৃদয়ে প্রশান্তি আসবে ও ঘুমিয়ে থাকা ঈমান নিয়ে ইসলামী বিশ্বের সৌভাগ্যের আকাশে উড়ে বেড়াব।
এর পরের ঘটনা বলতে গিয়ে আমিনা বলেছেন, আমার আচরণে কিছু পরিবর্তন এলেও নিজেকে তখনো খ্রিস্টানই মনে করতাম। একদিন একদল মুসলমানের সাথে সংলাপের সময় আমি যতই তাদের প্রশ্ন করছিলাম, তারা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দক্ষতার সাথে তার  জবাব দিচ্ছিলেন। পবিত্র কুরআন সম্পর্কে আমার অদ্ভূত সব মন্তব্য ও বক্তব্যের জন্য তারা আমাকে একটুও পরিহাস করেন নি। এমনকি ইসলাম সম্পর্কে আমার তীব্র আক্রমণাত্মক বক্তব্য শুনেও তারা মোটেও দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হননি। তারা বলতেন, জ্ঞান মুসলমানের হারানো সম্পদ। আর প্রশ্ন হলো জ্ঞান অর্জনের একটি পথ। তারা যখন চলে গেলেন মনে হল আমার ভিতরে যেন কিছু একটা ঘটে গেছে। এরপর থেকে মুসলমানদের সাথে আমার যোগাযোগ বাড়তে থাকে। আমি যখনই কিছু প্রশ্ন করতাম তখনই তারা আমার কাছে আরও কিছু নতুন প্রসঙ্গ তুলে ধরতেন। এ অবস্থায় একদিন একজন মুসলিম আলেমের সামনে সাক্ষ্য দিলাম- আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) আল্লাহর রাসূল।
মুসলমান হওয়ার পর হিজাব বেছে নেন আমিনা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের ও সন্তানরা কার কাছে থাকবে সে প্রশ্ন চলে আসে।  বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিচারক তাকে তার দুই সন্তান ও ইসলামের মধ্যে একটি বেছে নিতে বললে মহাদ্বিধা-দ্বন্দের পড়েন তিনি। একজন মমতাময়ী মায়ের জন্য সন্তানের দাবী ত্যাগ করা তো দূরের কথা, তাদের কাছ থেকে একদিনের জন্যও দূরে থাকাও কঠিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি ও মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মার্কিন নও-মুসলিম আমিনা এসিলমি।
দুই বছর ধরে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতাই তাকে শক্তি যুগিয়েছে। তার মনে পড়ে কুর’আনে উল্লিখিত হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম )-এর সন্তান কুরবানি দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনের ঘটনা। মনে পড়ে কুর’আনের  আয়াত-
যে ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান হতে পারে, যে আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করেছে? বস্তুতঃ তার ঠিকানা হল দোযখ আর তা কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল!
আমিনা মুসলমান হওয়ার পর আমেরিকায় ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কয়েক বছরের চেষ্টায় তিনি মুসলমানদের জন্য আরবি ভাষায় ঈদের শুভেচ্ছার সরকারি স্ট্যাম্প প্রকাশ করতে মার্কিন সরকারকে সম্মত করেন।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ও শহরে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার অনুভূতি তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এইসব ভাষণ শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এইসব প্রচেষ্টার অন্যতম সুফল হিসেবে একদিন তার দাদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর তার বাবা, মা, বোনও মুসলমান হন।
এর কিছুকাল পর তার সাবেক স্বামীও জানান, তিনি এবং তাদের সন্তানেরা মায়ের ধর্মই অনুসরণ করুক। তিনি সন্তানদের কেড়ে নেয়ার জন্য ক্ষমাও চান। আর আমিনা তাকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অপরাধে একদিন যারা তাকে ত্যাগ করেছিল, সবাই তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং সত্যকে স্বীকার করে নেয়। প্রাণপ্রিয় সন্তানদের ফিরে পাওয়াকে আমিনা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য আরও একটি বড় বিজয় বলে মনে করেন।
২০১০ সালে একটি অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান আমিনা এসিলমি। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।
মুসলিম নারী কেন হিজাব পরে সে সম্পর্কে আমিনা এসিলমির একটি বক্তৃতার ভিডিও লিংক- https://www.youtube.com/watch?v=kdxj_ygsCPQ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button