হোসে মুহিকা : জনতার প্রেসিডেন্ট

Uruguyবিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্টের তকমা জুটেছিল তার। তিনি উরুগুয়ের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট। হোসে আলবার্তো পেপে মুহিকা কর্দানো। অবশ্য তার কাছে দরিদ্রের সংজ্ঞা ভিন্ন। বিলাসী জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে যারা গলদঘর্ম হয়ে পরিশ্রম করে তারাই দরিদ্র; এমনটাই মনে করেন মুহিকা। যা কিছু আছে তা দিয়েই তো ভালভাবে জীবনযাপন করতে পারি, দর্শন তার।
২০১০ সালে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। কিন্তু সরকারি বাসভবনের বিলাস আকর্ষণ করেনি মুহিকা’কে। স্ত্রীর কৃষি খামারের একতলা টিনশেড বাড়িই ভরসা। রাজধানী মোন্তেবিদেও’র বাইরের’ সে বাড়িতেই মেয়াদ পার করলেন তিনি। স্ত্রী ছাড়া সঙ্গী ছিল দুই পুলিশ সদস্য আর তিন পা ওয়ালা পোষা কুকুর। সম্পদের মধ্যে সর্বসাকুল্যে ১৯৮৭ মডেলের একটি ভক্সওয়াগন বিট্ল গাড়ি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিমাসে বেতন প্রায় বারো হাজার ডলার। কিন্তু তার ৯০ শতাংশই বরাদ্দ ছিল দরিদ্র আর সমাজ সেবার জন্য। বাকি ১০ শতাংশ জীবন ধারণের খরচ। পোশাক-আশাক বড়ই সেকেলে। জীবনে কখনো টাই পরেননি।
তবে গোপন বিলাসিতাও আছে তার জীবনে। আর তা বই কেনা আর পড়া নিয়ে। মতাদর্শের পক্ষ-বিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের জীবনী আর স্মৃতিকথায় ঠাসা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি মুহিকা’র। সাবেক এ গেরিলা যোদ্ধার জীবনে বই-ই নাকি গুরুত্বপূর্ণ। কি আন্দোলন-গেরিলা যুদ্ধ, কি মন্ত্রিত্ব আর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সবক্ষেত্রেই বই সাহায্য করেছে তাকে। তবে ১৩ বছরের কারাজীবনের সময় সাত-আট বছর বই পড়তে পারেননি তিনি। আর কারাগারই নাকি জীবন সম্পর্কে মুহিকার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছে। কঠোর নিঃসঙ্গ কারাবাস আমলেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। সে সময়েই অন্তর্চক্ষু খুলেছে, অন্তর্শক্তিও খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি তার। কারাগারেই গেরিলা যোদ্ধা থেকে পরিণত হন রাজনীতিকে।
১৯৩৫ সালের ২০ মে জন্ম নেন মুহিকা। ষাট ও সত্তরের দশকে কিউবার বিপ্লবে অনুপ্রাণিত বামপন্থী। গেরিলা দলের নেতা হিসেবে উরুগুয়ের বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। ছয়বার গুলীবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান। অবশেষে সরকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কারাবাস। স্বৈরশাসনামলে ১৯৭৩ থেকে ৮৫ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন তিনি। তারপরের ইতিহাস সামনে এগিয়ে চলার।
আশি বছর বয়সী মুহিকা’র জীবন দর্শন খোলামেলা। অধিকারের বলে খোলামেলা তার মুখও। সাধারণের স্তর থেকে উঠে আসা রাষ্ট্র প্রধানদের ভড়ং বিরক্ত করে তাকে। কেন তারা দেশের আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারেন না তা নিয়ে প্রশ্ন তারও। জনগণের একটি অংশ সাধারণ বিষয় নিয়ে কেন হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকে তা নিয়ে বিরক্ত তিনি।
কিন্তু গর্ভপাত এবং গাঁজা বৈধ করার মত পশ্চিমা কেতা কি তার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মানানসই? দূরদৃষ্টির নেতা হিসেবে মুহিকা’র সাফ জবাব, দেড় লাখ গাঁজাসেবীকে তো আর মাদক চোরাকারবারীদের দয়ার উপর ছেড়ে দিতে পারি না। আইন করে গাঁজা বৈধ করা হলো, ধীরে ধীরে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু যে সুস্থির অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা তিনি উরুগুয়েতে রেখে যাচ্ছেন তা নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিবেশী দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা হিংসা করতেই পারে।
কি গাঁজা, কি সিগারেট বা মদ সব ধরণের নেশার বিরোধী মুহিকা। তার কাছে আসল নেশা হলো প্রেম। হয়তো সে নেশার কারণেই দীর্ঘ দিনের প্রেমিকা লুসিয়া তপোনস্কিকে ২০০৫ সালে  বিয়ে করেছেন তিনি। লুসিয়া শুধু দীর্ঘ দিনের প্রেমিকাই নন, তার আদর্শের অনুসারী ও সহযোদ্ধাও।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তার মতো প্রেসিডেন্ট থাকা উচিত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বিকার মুহিকা। তার পাল্টা প্রশ্ন, তারচেয়েও কেন ভালো প্রেসিডেন্ট গড়ে উঠবে না। আদর্শ থাকলেই রাষ্ট্র পরিচালনায় সরলতা আসবে বলে বিশ্বাস তার। স্মরণ করিয়ে দেন, রাজনীতি হচ্ছে বিনয়ী মানুষদের সম্মানজনক পেশা।
তা হলে কি অবসরে যাচ্ছেন মুহিকা? তার নিজের ভাষায়, দীর্ঘ জীবনযাত্রা শেষে প্রতিদিনই কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তারপরও বাড়ির কোনায় বসে স্মৃতিকথা লেখা আর অবসরভাতা নেয়া?.. অসম্ভব। সন্দেহ নেই আমি ক্লান্ত, কিন্তু আমি থামতে রাজি না। একজন বিপ্লবী কখনোই থামে না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button