আরব বসন্তের সাত বছর পরেও কেন এখনো বিক্ষুব্ধ তিউনিসীয়রা?

Tunisiaআরব বসন্তের জন্মভূমি তিউনিসিয়া ফের ক্রোধের আগুনে জ্বলছে। গত কয়েক দিন ধরে দেশটির রাজপথ দখল করে নিয়েছে প্রতিবাদকারীরা। এই প্রতিবাদে সরকারও হার্ডলাইনে অবস্থান নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ২০১১ সালে তারা যে দাবিতে রাজপথে নেমে ছিল, এবারো সেই একই দাবিতে উত্তাল তিউনিশিয়ার রাজপথ আর সেটি হচ্ছে ‘কর্মসংস্থান’।
যাইহোক, তাদের স্লোগান অত্যন্ত সহজ হলেও এই বিক্ষোভের পিছনে রয়েছে গতিশীলতা এবং আজকে তিউনিসিয়ায় যেসব কারণ এই ধরনের অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে, তা আরো বেশি জটিল।
শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
তিউনিসিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। দেশটির পর্যটনে খাতে ২,০০,০০০ এরও বেশি মানুষ কর্মরত রয়েছে। কিন্তু দেশটির ওপর ইউরোপের ক্রমবর্ধমান ভ্রমণ সতর্কতার কারণে এই সেক্টরটি এখন বিশাল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং আইএমএফের ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশাল অর্থ ঋণে কঠোরতা আরোপ তিউনিশিয়ার সরকারের অর্থনৈতিক বিকল্পগুলোকে সীমিত করে দিয়েছে। এসব কারণ দেশটির অনুন্নত বিশাল কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ অঞ্চলে বিনিয়োগকে সীমিত করেছে; যা অব্যাহত অসন্তোষ এবং হতাশাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে আঞ্চলিকতাবাদ; যেটি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দেশটির ‘সাউসি’, ‘মোনাসটির’ বা অন্য উপকূলীয় শহরগুলো থেকে প্রশংসিত হয়েছেন। এরা উন্নয়নের জন্য সব সময়ই আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সব ধরনের উন্নয়ন ঘটেছে উপকূলীয় শহরকেন্দ্রিক। অন্যদিকে, অভ্যন্তর অঞ্চলগুলো অর্থনৈতিক অবহেলার শিকার হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ অঞ্চলের এই বিমাতাসুলভ নীতিকে ‘দাম্ভিকতার উপেক্ষা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
অনন্ত হতাশার আবর্তন
উপরন্তু, দেশটির অভিজাতরা সহজেই সমব্যথী হন না। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ফ্রান্স তাদের পছন্দের গন্তব্য। তিউনিশিয়ার যারা অবহেলিত অঞ্চলে বাস করেন, চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে তাদের জন্য এটি সম্ভবত সুস্পষ্ট অভিযোগ। কর্মসংস্থান-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার ‘কার্নেজ’ ব্যবস্থাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। দরিদ্র এলাকার বিশাল জনসাধারণ খুব সহজেই এই কার্ড সুবিধা পায় না কিংবা কাজের অভাবের কারণে তারা এই কার্ডের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না। ফলে হাজার হাজার মানুষ মৌলিক চিকিৎসা সেবার প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত এই মানুষগুলোর জন্য ডাক্তার দেখানো যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি ঔষধ কেনাও আরো কষ্টকর।
এছাড়াও, কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ অঞ্চলের সম্প্রদায় মৌলিক স্যানিটারি এবং বিশুদ্ধ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে এটি অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু বয়ে আনছে; যেটি কঠিন সময়ের দুর্ভাগ্যজনক চিহ্নকে প্রকাশ করে। বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। তিউনিশিয়ার যুবকদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি। এটি তাদের মধ্যে হতাশার অনুভূতি জাগ্রত করছে। এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দৈনন্দিন পণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধিতে তিউনিসীয়দের মাঝে অবিরাম হতাশার চক্র আবর্তন করছে; যা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
নাহদা’র রাজনৈতিক রণকৌশল
দেশটিতে যদি কোনো আশা থেকে থাকে, তবে তা ‘নাহদা’ পার্টির মধ্যে রয়েছে। ২০১১ সালের বিপ্লবের পর ‘নাহদা’ পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। যাইহোক, দলটির আশাবাদ প্রতিস্থাপিত হয়েছে উপলব্ধির দ্বারা। দেশটির ত্রাণকর্তা হিসেবে অনুমিত হওয়া ‘নাহদা’ পার্টি কোনো সিরিয়াস অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের চেয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। সর্বনাশার তিন বছরে নাহদা’র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি আরায়েদ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে, দলটিকে ভোট না দেয়ায় ‘সিদি বাউজিদ’ শহরের ভোটারদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী হামাদী জেবালি মানহানিকর মন্তব্য করেছেন।
‘নাহদা’কে রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার জন্য কিছু যুক্তিও রয়েছে। ২০১৩ সালে মিসরের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ার জন্য দলটি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল। ওই অভ্যুত্থানে মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহামদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল।
বিপ্লবের পর প্রথম দিকে মোস্তফা বিন জাফর এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মেন্সেফ মারজুকির সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য একটি সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ করেছিল এবং পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বেজি কাইদ এসসেবির সঙ্গে এই নীতি গ্রহণ করে। যাইহোক, বিপ্লব এবং বাস্তবতার নিরিখে প্রত্যাশার মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যের কারণে দলটির প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া ২০১৪ সালের নির্বাচনে নাহদা তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button