বাদশাহ আব্দুল্লাহর ইন্তেকাল এবং কিছু কথা
মুহাম্মদ আমিনুল হক: ফজর নামাজ শেষ করে মোবাইল ওপেন করতেই সৌদি বন্ধু আব্দুল আজিজের হোয়াটসআপ ম্যাসেজ, “ওল্লাহি ইন্নাল আ’ইনা লাতাদমা’ ওয়াইন্নাল ক্বালবা লাইয়াহযান ওয়া ইন্না আলা ফিরাক্বিকা ইয়া খাদিমাল হারামাইন লামাহযুনূন ওলা নাক্বুলু ইলা মা ইয়ারদ্বা রাব্বুনা ইন্না লিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহ রাজিউন…” অর্থাৎ ‘আল্লাহর শপথ, নিশ্চয়ই চক্ষু অনবরত অশ্রু বিসর্জন করছে, অন্তর ভারাক্রান্ত, হে খাদেমুল হারামাইন তোমার অন্তর্ধানে সবাই ব্যথিত, তবে আমরা এমন কথা বলতে চাই না, যে কথায় আল্লাহ নারাজ হন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহ রাজিউন……’ সকাল বেলা এমন ম্যাসেজ পেয়ে একটু হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। খবরটা এমন সময় এলো যখন সারা মুসলিম জাহান তো বটেই খোদ সৌদি আরব বহিঃশত্রুদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের চাপ অতিক্রম করছে। সিরিয়া জ্বলছে। লাখ লাখ লোক গৃহহারা। দু’লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন বুলেটের আঘাতে। সৌদির বর্ডার দেশ ইয়েমেনও জ্বলছে। শিয়া সমর্থিত হুথি সম্প্রদায় দেশটাকে তছনছ করে ফেলছে। ইরাক-সিরিয়ার বিশাল এলাকা ইসলামী খেলাফাত ঘোষণাকারী আইএসের দখলে। অশান্ত মিশর। গাদ্দাফিবিহীন লিবিয়াও জ্বলছে। তিউনিশিয়াও ভালো নেই। ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনে সর্বশেষ বর্বর হামলাসহ ইত্যাদি সঙ্গত কারণেই সৌদি আরব বেশ চাপের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিল। দাবার ঘুঁটির মতো চাল চালতে হচ্ছিল অতি সাবধানতার সাথে। কখন কাকে সমর্থন দিলে কী লাভ, কার বিরোধিতা করলে কী খেসারত এইসব কিছুই একসাথে মাথায় রেখে বিশাল রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ কাজ নয়। এ কারণেই বাদশাহ আব্দুল্লাহর মৃত্যু সংবাদ শুনে কিছুটা হলেও চিন্তিত হয়েছিলাম।
যাইহোক বাদশাহর মৃত্যুর খবর জানার জন্য ফেসবুক, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন মাধ্যম ঘাঁটাঘাঁটি করে নিশ্চিত হলাম বাদশাহ আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন। রাসুলের দেশ, আরব মরুভূমি, আর দুই হারামের অধিবাসীদের জীবন আচার, সভ্যতা, সংস্কৃতি জানতে প্রায়ই বন্ধুদের নানা প্রশ্ন করি। এরই মধ্যে বাদশা আব্দুল্লাহর ইন্তেকালের খবর আমার সেই আগ্রহের পারদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বৈ কি? বাংলাদেশে কেউ মারা গেলে কতকিছু ঘটে। বিখ্যাত কেউ মারা গেলে তাকে নিয়ে কত মাতামাতি দেখি আমরা। মৃত ব্যক্তির লাশ শহীদ মিনারে রাখা হবে নাকি অন্য কোথাও এ নিয়ে মিছিল মিটিং হয়। কেউ রাখতে চায় কেউ বাধা দিতে চায়। আরও কত নোংরামি চলে মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে। সৌদি আরবের বাদশাহ ইন্তেকাল করেছেন এখন দেখা যাক তার বেলায় কী ঘটে এরকম জল্পনা আমার মাথায় ভর করে। জুমার দিন সকাল আটটা গড়িয়ে যাচ্ছে। স্ত্রীকে বললাম চলো- কা‘বা ঘরে চলে যাই। সেখানে গিয়ে ওমরাহ এবং জুমুয়ার নামাজ দুটোই একসাথে করি। যটপট রেডি হয়ে জেদ্দা থেকে ছুটলাম মক্কা শরীফের দিকে। গাড়ি চলছে। আমার নজর অন্যদের দিকে। কেউ বাদশাহ আব্দুল্লাহকে নিয়ে কিছু বলছে কিনা। খেয়াল করলাম সবাই স্বাভাবিক। গাড়ির চালক গাড়ি চালাচ্ছে আর পাশের আরেক সৌদির সাথে কথা বলছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ওরা বলছে আল্লাহ বাদশাকে রহম করুন। এই এতটুকু। বেলা সাড়ে দশটায় হেরেমে প্রবেশ করতেই দেখলাম, পুলিশ প্রধান গেট ব্লক করে দিয়েছে। নীচ তলায় কানায় কানায় লোক ভরে গেছে তাই। ছুটলাম স্ক্যালটারের দিকে। সেখান থেকে মসজিদুল হারামের একেবারে ছাদে চলে গেলাম। চারদিকে লোক আর লোক। তাওয়াফ করতে কষ্ট হচ্ছে।
ভাবলাম, বাদশাহ আব্দুল্লাহর জন্য অনেকেই হেরেম শরীফে চলে এসেছে একটু দোয়া করার জন্য। তাওয়াফ শেষ করলাম কোনো মতে। জুমুয়ার আজানের তখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। সাফা মারওয়ায় তাওয়াফ করতে রওয়ানা হলাম। কিন্তু যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। সবখানে মানুষ আর মানুষ। সবাই বসে আছেন। হজ্জের সময়ও সাফা মারওয়ায় সায়ীর জায়গায় কেউ বসতে পারে না। সব সময় হাজীদের দৌড়ানোর রাস্তা খোলা থাকে। কিন্তু আজ দেখছি উল্টা দৃশ্য। হাজীদের দৌড়ানোর রাস্তাও ব্লক! বাদশাহ আব্দুল্লাহর জন্য দোয়া করার জন্যই এমনটা হচ্ছে মেনে নিয়ে স্ত্রী ও ছেলেদের সহ কোনো রকম এক জায়গায় বসে পড়লাম জুমুয়ার নামাজের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে আজান ধ্বনিত হলো। পবিত্র হেরেম শরীফের সম্মানিত খতিব সাহেব খুৎবা দিতে শুরু করেছেন। তিনি হামদ ও ছানা পাঠ করে দু-চার মিনিট তাকওয়ার ওয়াজ করলেন। এরপর সৌদি বাদশাহর ইন্তেকালের খবর পৌঁছে দিলেন উপস্থিত মুসল্লিদের মাঝে। সবাই ভারাক্রান্ত। চুপচাপ খতিব সাহেবের বয়ান শুনছেন। তিনি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উত্তম কাজগুলোর কিছু বর্ণনা দিলেন বিশেষ করে মক্কার হেরেম শরীফের সংস্কার কাজের কথা উল্লেখ করলেন। এরপর তিনি সৌদি নাগরিক ও মুসলিম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নসিহত করলেন। তিনি সাবধান করলেন শত্রুদের ব্যাপারে। বললেন, আল্লাহ হায়াত মউয়তের মালিক। এক বাদশাহ চলে গেছেন আরেক জন আসবেন। এভাবেই চলতে থাকবে। আমাদেরকে সঠিক পথে থাকতে হবে। আমরা যেন কেউ মারা গেলে দিশেহারা না হই। শত্রুদের হাতে যেন অস্ত্র তুলে না দেই। যিনি মারা গেছেন তার দোষ-ত্রুটি খুঁজে দেশের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদের আগুন যেন জ্বলতে না দেই। যিনি নতুন বাদশাহর দায়িত্ব নিয়েছেন তার ওপর যেন আমরা বাইয়াত গ্রহণ করি। সদা-সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালকদের আনুগত্য করি…..
বাদশাহ আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আজিজের ৪৫ ছেলের মধ্যে বারোতম ছেলে। তিনি বাদশাহ আব্দুল আজিজের পর সৌদির পঞ্চম বাদশাহ। তার জন্ম রিয়াদে ১৯২৪ সালে। ১৯৮২ সালে তিনি সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পর থেকেই তিনি নিজ গুণে চলে আসেন নেতৃত্বের আসনে। ২০০৫ সালে বাদশাহ ফাহাদ ইন্তেকালের পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদির বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
বাদশাহ আব্দুল্লাহ তার জাদুকরী নেতৃত্ব দিয়ে সৌদি আরবের চেহারা পাল্টে ফেলেন। তার শাসনামলের দশ বছরে সৌদি আরবে ব্যাপক উন্নয়ন ও সংস্কার হয়েছে। অর্থনীতির চাকা মজবুত থেকে আরো মজবুতর হয়েছে। শিক্ষা-ক্ষেত্রে জাগরণ তৈরি হয়েছে। রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত আধুনিক হয়েছে। হাজীদের হজ্জ ও ওমরাহ সহজে সম্পাদন করার সকল প্রচেষ্টা করা হয়েছে। এ সমস্ত কাজে বিলিয়ন বিলিয়ন রিয়াল খরচ করেছেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ। ২০০৫ সালে যখন তিনি সৌদির ক্ষমতা গ্রহণ করেন সেসময় সৌদির নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১.২৩ ট্রিলিয়ন রিয়াল যা ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৮৩ ট্রিলিয়ন রিয়ালে অর্থাৎ- বাদশাহ আব্দুল্লাহর শাসনামলে সৌদির উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ১২৯.৩ পার্সেন্ট। এটি জি-২০ কান্ট্রিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সূচক। তার শাসনামলে সৌদি জনগণের বাৎসরিক আয় বেড়েছে প্রায় ৭৪ পার্সেন্ট। ২০০৫ সালে সৌদি নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৩ হাজার রিয়াল আর ২০১৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার রিয়ালে। বাদশাহ আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের মাথা থেকে বৈদেশিক ঋণের বোঝাও কমিয়েছেন। ২০০৫ সালের ৪৬০ বিলিয়ন রিয়াল ঋণ থেকে ২০১৪ সালে এসে ৪৪ বিলিয়ন পর্যন্ত কমিয়েছেন। আর স্থানীয় উৎপাদন ঋণ ৩৭ পার্সেন্ট থেকে নামিয়ে এনেছেন ১.৬ পার্সেন্টে। বাদশাহ আব্দুল্লাহর শাসনামলে সৌদির রিজার্ভ ফান্ড বেড়েছে প্রায় ২৭৩ গুণ। ২০০৫ সালে রিজার্ভ ফান্ড ছিল ৫৮১ বিলিয়ন রিয়াল। তিনি তা বাড়িয়ে ২.৭৫ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় এবং চীন জাপানের পর সৌদি আরবের রিজার্ভ ফান্ডের বর্তমান অবস্থান। তার শাসনামলে সৌদি নাগরিকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন। ২০০৫ সালে সাত লাখ সৌদি নাগরিক সরকারি চাকরি করত এখন তা ৪৩ পার্সেন্ট বেড়ে ১২ লাখ দাঁড়িয়েছে।
তার শাসনামলে শিক্ষাখাতে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়েছে। তিনি নতুন ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশেষ করে যে সমস্ত অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, সেইসব এলাকায় তিনি বিশেষ নজর দিয়েছেন। তায়েফ, কাছিম, আল জাওফ, জিজান, তাবুক, হায়েলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। জেদ্দায় তিনি অত্যাধুনিক সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন যার নাম হচ্ছে- কিং আব্দুল্লাহ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি। মেয়েদের জন্য তিনি সর্বপ্রথম আলাদা সর্বাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রিন্সেস নাওরা ইউনিভার্সিটি নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি রিয়াদে অবস্থিত। তার শাসনামলে প্রায় তিন হাজার নতুন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি দুই লাখ সৌদি নাগরিককে আগের চেয়ে ডাবল স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পড়াশুনা ও গবেষণার জন্য প্রেরণ করেছেন। ৬টি মেগা মেডিকেল সিটি করেছেন। ১১টি স্পেশালাইজড মেডিকেল ও ৩২টি জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। সারা সৌদিতে রেল লাইন স্থাপনের মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। হাজীদের জন্য মিনা আরাফাতে রেল যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। মক্কা-মদীনার মাঝে ইয়ানবু নগরীতে হাজী সিটি নামক মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে। এখান থেকে হাজীরা সর্বাধুনিক ট্রেনের মাধ্যমে মক্কা ও মদীনায় নামাজ ও জিয়ারতের জন্য যাওয়া আসা করতে পারবেন। জামারাতে পাথর মারার স্থান সর্বাধুনিক করা হয়েছে। মিনায় হাজীদের থাকার সুন্দর আয়োজন করা হয়েছে। বাদশা আব্দুল্লাহ পবিত্র মক্কার পবিত্র মসজিদুল হেরেমের সংস্কার কাজে ৮০ বিলিয়ন রিয়াল বরাদ্দ দিয়েছেন।
বর্তমানে হেরেম শরীফের যে উন্নয়ন কাজ চলছে তা সম্পন্ন হলে আগামী শত শত বছর মিলিয়ন মিলিয়ন হাজী স্বাচ্ছন্দ্যে হজ্জ ও ওমরা করতে পারবেন। বর্তমানে যেখানে ঘণ্টায় ৫০ হাজার হাজী বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে পারেন সেখানে অচিরেই ঘণ্টায় এক লাখ তিরিশ হাজার হাজী বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে পারবেন। মসজিদে নববীর চারপাশে ছায়া দানের জন্য বিশালাকার ছাতা বাদশাহ আব্দুল্লাহর অবদান। বর্তমানে আরও প্রায় আড়াই লাখ মুসল্লির ইবাদত বন্দেগীর জন্য মসজিদে নববীর বর্ধিত সংস্কার কাজ চলছে। তিনি বাড়িবিহীন সৌদি নাগরিকদের জন্য ২৫০ বিলিয়ন রিয়াল দিয়ে ৫ লাখ ইউনিট ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। তিনি সৌদি নাগরিকদের সহজ চলাচলের জন্য শত শত ফ্লাইওভার ও সুপ্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেছেন। সৌদিতে তেলের দাম আগের চেয়ে অর্ধেকেরও কম করে দেওয়া হয়েছে। সৌদি নাগরিকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীদের মজলিশে শূরায় স্থান দেওয়া হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থানের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ শুধুমাত্র সৌদিদের জন্য অবদান রাখেননি বরং তিনি গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য তার উদার হস্ত প্রসারিত করেছেন। যেখানে ২০০৫ সালে সৌদি আরব বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ৪.১ বিলিয়ন দান-খয়রাত করেছে সেখানে ২০১২ সালের হিসাবে তা দাঁড়িয়েছে ৯৮ বিলিয়ন রিয়াল। বাদশাহ আব্দুল্লাহ ফিলিস্তিনে বিবাদমান দুটি গ্রুপকে একত্রিত করার জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য অকাতরে সৌদি রিয়াল ব্যয় করেছেন। সিরিয়ার জনগণের জন্য তিনি তার উদার হস্ত প্রসারিত করেছেন। আফ্রিকান অনুন্নত মুসলিম দেশগুলো পুনর্গঠনে তিনি ডানে বামে না তাকিয়ে অকাতরে দান করেছেন। বাংলাদেশের জনগণের জন্য সৌদি বাদশাহ ও জনগণ ছিলেন নিবেদিত। সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। বিভিন্ন দুর্যোগে সৌদি সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। ২০০৭ সালের সিডরের আঘাতের পর বাংলাদেশ সৌদি থেকে যে সাহায্য পেয়েছে সারা বিশ্ব থেকে তার সিকি ভাগও পায়নি বাংলাদেশ। আরব বসন্ত যেখানে গোটা আরব জাহানকে তছনছ করে ফেলেছে সেখানে তিনি সৌদি আরবকে দক্ষভাবে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্য থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
বাদশাহ আব্দুল্লাহকে সৌদির জনগণ মনে করেন মানবতার বাদশাহ হিসেবে। তার নেতৃত্বে জাতিসংঘে তৃতীয় পর্বের আন্তধর্মীয় সংলাপের সূচনা ঘটেছিল। তিনি সৌদি আরবের প্রথম বাদশাহ যিনি ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ বেনেডিক্ট-১৬-এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। গোটা আরব জাহান তো বটেই পুরো মুসলিম জাহান তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বে উপকৃত হয়েছে।
বাদশাহ আব্দুল্লাহর একটি কথা সৌদি জনগণ কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। “আল্লাহ জানেন, আমি তোমাদেরকে আমার অন্তরে ধারণ করে আছি। আল্লাহর পরই আমার শক্তির উৎস তোমরা। অতএব আমাকে তোমরা তোমাদের দুয়া থেকে ভুলে যেও না”। বাদশাহ আব্দুল্লাহর এই বক্তব্য এখন গোটা সৌদি আরবের আকাশে-বাতাসে দোল খাচ্ছে। সৌদি নাগরিকরা কখনো তাদের প্রিয় বাদশা আব্দুল্লাহকে ভুলতে পারবে না।
সৌদি জনগণ বাদশাহ আব্দুল্লাহকে হৃদয় দিয়ে ভালো বাসেন। এর প্রমাণ বহন করে, তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি টুইট বার্তা টুইটারে ছেড়েছে সৌদি জনগণ। যেখানে সবাই সৌদি বাদশাহর মৃত্যুতে শোক ও তার মাগফিরাত ও ভালো কাজের প্রশংসা করেছেন। আরব দেশগুলোর প্রায় সব বাদশাহই উপস্থিত হয়েছেন তার জানাযায়। তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও বিভিন্ন দেশের প্রসিডেন্ট ও তাদের প্রতিনিধিরা এসেছেন জানাজা নামাজে। মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ গোটা বিশ্বের প্রায় সবদেশ থেকে শোক বার্তা এসেছে সৌদিতে। সৌদি আরবের মসজিদে মসজিদে মরহুম বাদশাহ আব্দুল্লাহর জন্য সবাই দুয়া করছেন। আলেমগণ নামাজান্তে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বাদশাহ মারা গেলে উম্মতের কী করণীয় তা বাতলিয়ে দিচ্ছেন। নতুন বাদশাহর আনুগত্যের জন্য নসিহত করছেন। শত্রুদের কথায় কান না দিয়ে সকল উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানাচ্ছেন। দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা যেভাবে নিশ্চিত হয়েছে তা বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ তার কর্মের মাধ্যমে স্মরণীয় থাকবেন যুগ যুগ ধরে। আল্লাহ তাকে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটি জেদ্দা, সৌদি আরব
aminulhoque.iiuc@gmail.com