বৈরুতের রূপকথার ভবনে প্রাণস্পন্দন

Boiruthঅনুবাদ:মীম ওয়ালীউল্লাহ: লেবাননের রাজধানী বৈরুতের প্রাণকেন্দ্রে সাগর তীরে অবস্থিত সুরম্য ভবনটি এ শহরের রোমান্টিক অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার একমাত্র সাক্ষী হয়ে আজো দীপ্যমান রয়েছে। রোজ হাউজ নামে বাড়িটি উসমানিয়া খিলাফত আমলের একটি মূল্যবান স্থাপত্য নিদর্শন। ভূমধ্য সাগরের পাড়ে একই ধরনের একটি সুরম্য লাইট হাউজের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রোজ হাউজ। নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের কারণে তালগাছের সারি আর ফিকিয়ে যাওয়া লাল রঙের বাঁকা খিলানগুলোর কাছে লোকজন যেতে পারে না। বৈরুতের হারিয়ে যাওয়া রূপ-লাবণ্যের মধ্যে এ ভবনটি এখন নগরীর সৌন্দর্য ও উজ্জ্বলতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
পনেরো বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এ অনন্য ভবনটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়েছে।
এ বাড়িতে ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল এবং আমেরিকার বিমূর্ত চিত্রশিল্পী ও পিকাসোর বন্ধু জন ফেরেন অতিথি হয়ে এসেছিলেন। এ বাড়িকে কেন্দ্র করেও একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যার নাম এরাউন্ড দ্য পিঙ্ক হাউজ। সময়ের আবর্তে বাড়িটির সেই জৌলুস হয়তো এখন আর অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু ব্রিটিশ চিত্রকর টম ইয়ং এবং তার স্ত্রীর সফরের পর একটি সুযোগ দেখা দিয়েছে। তাদের এ সফরের সময় লেবাননের একটি ডেভেলপার কোম্পানি ভবনটির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। ফলে আশা করা হচ্ছে যে, বাড়িটি আবারো তার হারানো জৌলুস ফিরে পাবে।
ওই বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ইয়ং দম্পতির দেখা হয় লেবাননের চিত্রকর ফরিদের বোন ফাইজা আল খাজেনের সাথে। ফাইজা তাদের জানান যে, তার ভাই অন্যান্য শিল্পীর সাথে বাড়িটি আলাপচারিতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। সে সময়টি ছিল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশক। এটি ছিল লেবাননের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। একাত্তর বছর বয়সী ফায়াজ ইয়ংকে বাড়িটিতে চিত্রাঙ্কনের প্রস্তাব দেন। এ সুযোগটি ইয়ং হাতছাড়া করতে চাইলেন না। কিন্তু ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাড়িটি ছেড়ে দেয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল ফাইজার। তিনি বাড়িটি ভাড়া নিয়ে চিত্র কর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। ইয়ং বলেন, এখানে কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারে একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে বাড়িটির মালিক হিশাম জারুদি জানতে পারলেন যে, ইয়ং সেখানে চিত্র প্রদর্শনী করতে চান। এটা জেনে তিনি খুব খুশি হন। জারুদি এএফপিকে বলেন, বাড়িটি টিকে থাকবে। সংস্কার করে ভবনটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে যাতে বৈরুতের ইতিহাস এখানে সংরক্ষণ করা যায়।
তিনি বলেন, জায়গাটি একটি রূপকথার মতো। টাইলস ও জানালার রঙিন কাচগুলো বাড়ির ভেতরে আলো ছড়াচ্ছে। দেয়ালে টানানো রয়েছে আরদাতি পরিবারের সাদা-কালো ছবি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তারা এখানে বাস করতেন। শিল্পী ফরিদ খাজেনের মৃত্যুর পরও তার চিত্রকর্মগুলো বছরের পর বছর তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
একচল্লিশ বছর বয়সী ইয়ং বলেন, এই জায়গাগুলো সংস্কৃতি এবং পরিচয়কে একত্র করেছে। এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। ইয়ং ইস্তাম্বুলে ইসলামি স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বলেন, লেবাননে এ ধরনের ভবন খুবই অনন্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বৈরুতের ঐতিহ্যবাহী মনোরম ভবনগুলো হারিয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মীরা খুবই দুঃখ প্রকাশ করেন। বৈরুতের বাইরে ১৯৯৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ভবনের সংখ্যা এক হাজার ২০০ থেকে কমে এখন ৪০০ তে নেমে এসেছে।
২০০৬ সাল থেকে লেবাননের সাথে ইয়ংয়ের সম্পর্ক। এক লেবাননি কার মেকানিকের কাছে তিনি এ ভবনের কথা শোনেন। তখন থেকেই লেবাননের প্রতি ইয়ংয়ের আগ্রহ ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। দেশটির করুণ ইতিহাস এবং গৃহযুদ্ধ তার জীবনের শোকাবহ অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে সময় তার বয়স ছিল ১০ বছর।
ইয়ং বলেন, আমার মা আত্মহত্যা করেন। তখন থেকেই আমার প্রত্যেক কাজে এর প্রভাব পড়ে। লেবাননের বৈচিত্র্য আমাকে মুগ্ধ করে। একটি জায়গা কিভাবে স্বর্গ এবং নরক হতে পারে? এখন বৈরুতের ঐতিহ্যবাহী বাকি ভবনগুলোকে শিল্প কেন্দ্রে পরিণত করতে চান তিনি। ইয়ং বলেন, এই জায়গাগুলো সংরক্ষণের উপায় হিসেবে শিল্পকে ব্যবহার করতে চাই। তার চিত্রকর্মগুলোর অন্যতম হচ্ছে ‘ইয়ার্স’। একটি সাগর পাড়ে আবর্জনার গাদা দেখা যায় এতে। ইয়ংয়ের কাছে এটি একটি রাষ্ট্রের অকার্যকারিতার প্রতীক। আরেকটি ক্যানভাসে তিনি দেখিয়েছেন, দানবীয় সুউচ্চ টাওয়ারগুলো রোজ হাউজকে চেপে ধরে ভেঙে ফেলছে।
তিনি বলেন, আমি চাই, সব ধর্ম, বর্ণ ও বয়সের মানুষ এই চমৎকার জায়গাটি তাদের জন্য বিনোদনের স্থান হিসেবে উপভোগ করুক। তিনি আরো বলেন, শিশুরা রোজ হাউজ দেখতে আসে। তাদের অনেকে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ পটভূমি থেকে এখানে আসে। শিশুরা আসে জানতে ও স্বপ্ন দেখতে। তরুণদের এক অনুষ্ঠানে ফায়াজ আল কাজেন দর্শকদের আশা শীর্ষক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, এই বাড়িটি সংস্কার করা অর্থ লেবাননকে নতুন করে গড়ে তোলা। সূত্র : ডন

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button