ইসরাইলের মিত্ররা কি ডুবে যাওয়া জাহাজ ইসরায়েলকে ত্যাগ করছে?

হঠাৎ আতঙ্ক গ্রাস করেছে ইসরাইলের সমর্থকদের। পশ্চিমা নব-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের সাদা বসতি-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো এশিয়ার শেষ ইউরোপীয় বসতি-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। এমনকি প্রো-ইসরাইল ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইহুদি সংগঠনগুলোও উদ্বিগ্নদের এই নতুন কণ্ঠে যুক্ত হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে ও পরে ইসরাইলের চলমান অপরাধগুলোকে সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষা-সমর্থন দিলেও, এর পশ্চিমা সমর্থকরা এখন নৈতিক সংকোচে পড়েছে গাজায় সাম্প্রতিক গণহত্যার ধাপে—যেখানে গণবোমাবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ইচ্ছাকৃতভাবে জীবিত ফিলিস্তিনিদের না খাইয়ে হত্যার চেষ্টা চলছে।
ইসরাইলবিরোধী ও বামপন্থী ইহুদি গোষ্ঠীগুলো শুরু থেকেই এই গণহত্যার নিন্দা করেছে, কিন্তু প্রধান ব্রিটিশ ও আমেরিকান প্রো-ইসরাইল ইহুদি সংগঠনগুলো ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসেছে।
কিন্তু গত দুই সপ্তাহে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। একযোগে ও সমন্বিতভাবে গাজার দুর্ভিক্ষ নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ শুরু হয়েছে। হাড়সর্বস্ব শিশুদের ভয়ঙ্কর ছবি, সামরিকীকৃত সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রে হতাশ মানুষের ভিড়, এবং খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যার দৃশ্যগুলো পশ্চিমা সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে আর নীরব থাকা সম্ভব করছে না।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোথাও ইসরাইলের মিত্ররা তার গণহত্যা ও গাজা পুনর্দখলের পরিকল্পনাকে আর সমর্থন দিতে চাইছে না—বরং অনেকে হয়তো ইতোমধ্যে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিলম্বিত উদ্বেগ:
ইসরাইলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে, এর প্রবক্তারা সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধ-উল্লাস কিছুটা স্তিমিত করে ‘মানবতাবাদী’ ভান করছে, যাতে তাদের গণহত্যা অব্যাহত থাকে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের মাঝেও।
২৭ জুলাই, আমেরিকান জিউইশ কমিটি (এজেসি) এক বিবৃতিতে বলেছে ইসরাইলের যুদ্ধ ‘ন্যায্য’, কিন্তু একই সঙ্গে তারা গাজার খাদ্য সংকট নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে।
একই সপ্তাহে, নিউ ইয়র্কভিত্তিক ‘রাব্বিনিক্যাল অ্যাসেমব্লি’ বলেছে, গাজার মানবিক বিপর্যয় লাঘবে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় ইহুদি সংগঠন ‘ইউনিয়ন ফর রিফর্ম জুডাইজম্’ ২৭ জুলাই বলেছে:
“গাজাবাসীদের না খাইয়ে মারা ইসরাইলকে কোনো বিজয়ের কাছাকাছি নেবে না, বরং ইহুদি মূল্যবোধ ও মানবিক আইনের বিরোধী।”
এরপরই এক হাজার রাব্বি সই করা এক চিঠিতে বলা হয়, “আমরা নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের গণহত্যা, কিংবা অনাহারকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার—কোনোটাই মেনে নিতে পারি না।”
ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ:
এই উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ২৯ জুলাই, যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ইহুদি সংগঠন ‘বোর্ড অব ডেপুটিজ’ গাজায় দ্রুত ও বাধাহীন সাহায্য প্রবাহের আহ্বান জানিয়েছে। একই দিনে, ৩১ জন বিশিষ্ট ইসরাইলি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানায়।
এমনকি ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা ‘বি’সেলেম’এবং ‘ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস্’ ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে প্রকাশ্যে “গণহত্যা” বলে ঘোষণা করেছে।
এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সম্প্রতি ফোনে নেতানিয়াহুকে গালিগালাজ করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে, দুর্ভিক্ষ অস্বীকার বন্ধ করার জন্য।
ডুবন্ত জাহাজ:
জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো—এমনকি কিছু ইসরাইলি সংগঠনও—গাজায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে পশ্চিমা সরকার ও মূলধারার গণমাধ্যমের পক্ষে তা অস্বীকার করা বা আড়াল করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিততে ব্যর্থতা, ইরানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অক্ষমতা, আর কেবলমাত্র সাধারণ মানুষ হত্যায় সীমাবদ্ধ সামরিক ক্ষমতা—এসব পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর দৈনিক সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সহায়তা ছাড়া ইসরাইল কোনোদিনই এই গণহত্যা চালাতে বা আত্মরক্ষা করতে পারত না।
কিন্তু এখন পশ্চিমা জনমত প্রবলভাবে ইসরাইলবিরোধী। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও কেবল বাম নয়, প্রো-ট্রাম্প ডানপন্থীরাও ইসরাইলের পক্ষে আমেরিকান সমর্থনের বিরোধিতা করছে।
ফরাসি আলজেরিয়ার মতো, যেখানে জনমতের চাপ শেষে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ভেঙে পড়েছিল, ইসরাইলের ক্ষেত্রেও সেই পরিণতি সামনে আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নেতানিয়াহু নিজেই এক দশক আগে বলেছিলেন, ইসরাইল হয়তো ১০০তম জন্মদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে না। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইসরাইল সত্যিই তার নিজের পতনকে ত্বরান্বিত করছে। -জোসেফ মাসাদ, নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক আরব রাজনীতি ও বৌদ্ধিক ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি অসংখ্য বই এবং একাডেমিক ও সাংবাদিকতামূলক নিবন্ধের লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে রয়েছে Colonial Effects: The Making of National Identity in Jordan; Desiring Arabs; The Persistence of the Palestinian Question: Essays on Zionism and the Palestinians এবং সাম্প্রতিকতম Islam in Liberalism। তাঁর বই ও নিবন্ধগুলি ডজন ডজন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button