কেনো কাতার বৈশ্বিক মধ্যস্থতায় অন্যদের তুলনায় বেশি যোগ্য ও সফল
কাতারের মধ্যস্থতায় গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের সরকার এবং বিদ্রোহী ‘মার্চ ২৩’ (এম২৩) আন্দোলন গত ১৫ নভেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় একটি শান্তি কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা পূর্ব কঙ্গোর কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটাতে এবং বিরোধী পক্ষগুলোকে একটি বিস্তৃত শান্তি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে কাতারের প্রচেষ্টার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত। এটিই কাতারের প্রথম মধ্যস্থতা নয়, বরং সফল মধ্যস্থতার পথ এবং আন্তর্জাতিক সুনামকে শিরোপা পরানো, যা ছোট্ট এই উপসাগরীয় রাষ্ট্রকে শীর্ষ মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গত দুই দশকে কাতার বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতে সবচেয়ে কার্যকর মধ্যস্থতাকারীদের একটিতে পরিণত হয়েছে, যা তার ভৌগোলিক আকারকে বহুগুণ ছাড়িয়ে একটি কূটনৈতিক পরিচয় গড়ে তুলেছে। বহু ছোট বড়ো রাষ্ট্র নিজেদের শান্তিরক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও, কাতার উল্লেখযোগ্য সাফল্যের কারণে তাদের চেয়ে আলাদা। কারণ দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন ও সমাধান-অযোগ্য সংঘাতগুলো সমাধানে বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে বহু সংঘাতে দোহা বারবার বৈরী পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে আনতে এবং সমঝোতার পথে পরিচালিত করতে অনন্য দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, যেখানে অন্যরা ব্যর্থ হয়েছে।
সফল কাতারি মধ্যস্থতার উদাহরণ:
এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র–তালেবান আলোচনায় কাতারের কেন্দ্রীয় ভূমিকা, যা ২০২০ সালের দোহা চুক্তিতে পরিণত হয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বহু আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পক্ষ ওয়াশিংটন ও তালেবানের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে। কেউই দীর্ঘস্থায়ী সংলাপ শুরু করতেও সফল হয়নি। কিন্তু কাতার ধারাবাহিক আলোচনার অধিবেশন আয়োজন ও উভয় পক্ষের আস্থা অর্জন এবং এমন এক নিরপেক্ষ কূটনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যা কোনো পক্ষই রাজনৈতিকভাবে হুমকিস্বরূপ মনে করেনি। ফলাফল ছিল ২০ বছরের আফগান যুদ্ধে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনাপ্রক্রিয়া।
ইরিত্রিয়া–জিবুতি সীমান্ত সংঘাত:
২০০৮ সালে ইরিত্রিয়া ও জীবুতির মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পক্ষ সংকট প্রশমনে ব্যর্থ হওয়ার পর, কাতার একমাত্র পক্ষ হিসেবে এগিয়ে আসে যাকে উভয় দেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিল। ২০১০ সালের জুনে কাতার ইরিত্রিয়া ও জিবুতির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে তাদের সীমান্ত বিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার কথা বলা হয়। কাতারি সৈন্যরা চূড়ান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বিতর্কিত এলাকায় মোতায়েন ছিল। এটি ছিল এমন এক বিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, যা পূর্ববর্তী সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। কারণ এর আগে আফ্রিকান ইউনিয়ন কিংবা বড় আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও পক্ষগুলোকে আলোচনায় আনতে সক্ষম হয়নি। ২০২৪ সালে ইরিত্রিয়া আবারও ঘোষণা করে যে, জিবুতির সঙ্গে তাদের সীমান্ত বিরোধে কাতারই একমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকবে।
একইভাবে, সুদানের দারফুর সংঘাতে কাতার এমন কিছু অর্জন করে যা বড় আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক শক্তি করতে পারেনি। কাতার সুদান সরকার এবং একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে ২০১১ সালের দোহা ‘ডকুমেন্ট ফর পিস ইন দারফুর’ স্বাক্ষর করাতে সক্ষম হয়। যদিও সংঘাত পুরোপুরি সমাধান হয়নি, তবুও বহু বছরের ব্যর্থ বা ভেঙে যাওয়া আলোচনার পর কাতারই একমাত্র মধ্যস্থতাকারী ছিল, যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পাদন করাতে পেরেছে যদিও অঞ্চলটি বর্তমানে ভিন্ন আকারে একটি রক্তাক্ত সংঘাতের মুখোমুখি। দোহা সুদানি সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সংঘাত শেষ করতে আন্তর্জাতিক ভূমিকার অপেক্ষায়।
কাতারের মধ্যস্থতার যোগ্যতার কারণসমূহ:
যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া-জিবুতি, এবং সুদানের দারফুর এই তিনটি উদাহরণ প্রমাণ করে যে কাতারের সাফল্য এর শক্তির কারণে নয়, বরং এর বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে। কাতারের মধ্যস্থতা কয়েকটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো হচ্ছে, নিরপেক্ষতা, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং সম্পদ। এগুলো তার পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গঠন করে। সত্যিকারের নিরপেক্ষভাবে কাতার কোনো মতাদর্শিক বা রাজনৈতিক এজেন্ডা চাপিয়ে না দিয়ে মধ্যস্থতা করে। বড় শক্তিগুলোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রায়ই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু দোহা সংকটগুলোকে খুব নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে মোকাবিলা করে। সে পক্ষগুলোকে এমন সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, যা উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য। এই নিরপেক্ষতার ধারণাই কাতারকে বিরোধী পক্ষগুলোর আস্থাভাজন করে তোলে, এমনকি যখন তারা পরস্পরকে গভীরভাবে অবিশ্বাস করে। একটি ছোট রাষ্ট্র হিসেবে কাতারের অবস্থান তার জন্য সুবিধা বয়ে আনে। তার সীমিত সামরিক উপস্থিতি এবং প্রভাব বিস্তারের উচ্চাভিলাষ না থাকা মধ্যস্থতাকে সন্দেহজনক করে তোলে না। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো কাতারকে হুমকি হিসেবে নয়, বরং স্থিতিশীলতার সহায়ক হিসেবে দেখে। এই “ছোট-রাষ্ট্র সুবিধা” দোহার কূটনৈতিক সাফল্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কাতারের বিশাল আর্থিক সম্পদও রয়েছে, যা তাকে পুনর্গঠন সহায়তা, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বা মানবিক সহায়তার মাধ্যমে শান্তি চুক্তিকে সমর্থন করার সুযোগ দেয়—যা উত্তেজনা কমাতে এবং আস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। শুধুমাত্র সম্পদ একটি দেশকে সফল মধ্যস্থতাকারী করে না, কিন্তু নিরপেক্ষতা ও কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে মিললে এটি এমন ভূমিকা পালনে সক্ষম করে, যা অনেক দেশ পারে না। চুক্তির পরবর্তী বাস্তবায়ন পর্যায়ে কাতার আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে, যা তার মধ্যস্থতাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
কাতারের ভবিষ্যৎ মধ্যস্থতা ভূমিকা:
আজ বৈশ্বিক মধ্যস্থতার ক্ষেত্র দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। স্নায়ূ যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে মধ্যস্থতা ছিল মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্র ও পশ্চিম পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। তাদের প্রভাব এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে সংঘাত সমাধান কার্যত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশ বা পশ্চিমসমর্থিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া ক্ষেত্র হিসেবে মনে হতো। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে এই ধারা বদলেছে। পক্ষপাতের ধারণা, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে অসঙ্গতি এবং সংঘাতকে ন্যায্যভাবে সমাধান করতে ব্যর্থতার কারণে পশ্চিমা মধ্যস্থতার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেছে। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কাতার, তুরস্ক ও সৌদি আরবসহ একাধিক দেশ নতুন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উঠে এসেছে, যাদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে তুরস্ক ও সৌদি আরব এখনো আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত এবং তাদের মধ্যস্থতা প্রায়ই বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে জড়িত থাকে, যা কাতারের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। আর এটিই কাতারকে এক অনন্য আন্তর্জাতিক সুনাম গড়তে সাহায্য করেছে।
যেহেতু বৈশ্বিক ব্যবস্থা আরও খণ্ডিত হচ্ছে এবং ঐতিহ্যগত মধ্যস্থতাকারীরা পিছু হটছে বা প্রভাব হারাচ্ছে, তাই কাতারের ভূমিকা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশটির অতীত সাফল্য প্রমাণ করে যে, ছোট রাষ্ট্রও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং সত্যিকারের নিরপেক্ষতা, আর্থিক সক্ষমতা ও দক্ষ কূটনীতি দীর্ঘস্থায়ী বা নতুন সংঘাতে বাস্তব অগ্রগতি এনে দিতে পারে। -আহমেদ আস্মার, একজন সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি গবেষক। তিনি তুরস্কের আঙ্কারা ইয়িলদিরিম বেয়াজিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



