স্টারমার কি ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’কে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছেন?

যদি লেবার দল নিষিদ্ধ করে, তাহলে আমাদের কেউই আর নিরাপদ থাকব না

এই সপ্তাহে স্যার কিয়ার স্টারমারের সরকার এমন এক ধরণের নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে, যা আধুনিক যুগের যুক্তরাজ্যে আগে দেখা যায়নি। তারা প্যালেস্টাইন অ্যাকশন কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নিচ্ছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে স্টারমারের সরকার সম্ভবত রাজনীতিসচেতন জনগণ এবং স্টারমারের দলের রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর নিয়মিত নজরদারির সুযোগ তৈরি করবে।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, এটি এমন এক প্রজন্মের যুদ্ধবিরোধী, গণহত্যাবিরোধী এবং মিতব্যয়বিরোধী রাজনৈতিক প্রার্থীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার হাতিয়ার হতে পারে, যারা স্টারমারের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে শীর্ষ নেতাদের – এবং স্টারমারকেও – রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করছে।
এটি ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া বা ভিক্টর অরবানের হাঙ্গেরির রাজনীতির মতো। এটি লেবার পার্টির প্রগতিশীল ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে।
আমি এই প্রগতিশীল ইতিহাস সম্পর্কে জানি, কারণ এটি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মৌলিক ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৮০ এর দশকে আমি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দিই, আর তাতেই দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের চোখে সন্ত্রাসবাদী সমর্থক হয়ে উঠি। আমি নির্বাসনে যাই, কারণ একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা আইনের অপব্যবহার করে বৈশ্বিক শান্তি ও ন্যায়বিচারের আন্দোলন ধ্বংস করতে চাইছিল।
যদি প্যালেস্টাইন অ্যাকশনকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করা হয়, তাহলে কি আমাকে এবং এই আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সমর্থকদের আবারও সন্ত্রাসবাদী সমর্থক বলা হবে?
তখন, যখন মার্গারেট থ্যাচার নেলসন ম্যান্ডেলাকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিচ্ছিলেন (দেখুন, যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানের ‘সন্ত্রাসবাদের’ সংজ্ঞা কতটা হাস্যকরভাবে বদলায়), তখন আমরা এএনসিতে জানতাম যে লেবার পার্টির সাধারণ সদস্যরা আমাদের পাশে আছে।
এই সংহতিই বর্ণবৈষম্যের জঘন্য শাসনব্যবস্থাকে শেষ করেছিল – ঘরের ভেতরে গণ-অবাধ্যতা আর বাইরে বয়কট ও নিষেধাজ্ঞার যুগল চাপে।
যদি প্যালেস্টাইন অ্যাকশনকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে কি আবারও আমাদের ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’ তকমা পরতে হবে?
প্যালেস্টাইন অ্যাকশনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে দেশের সব প্রধান মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সংগঠন – লিবার্টি থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পর্যন্ত – সরাসরি রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলে নিন্দা করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কর্মকর্তারাও (যারা মোটেও কোনো উগ্রপন্থী নন) এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক চরিত্রে বিস্মিত।
যার সামান্যও দূরদৃষ্টি আছে, সে জানে যে এটি একটি ভয়াবহ নজির স্থাপন করবে, যা ভবিষ্যতে এই দেশের উগ্র-ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো কর্তৃত্ববাদের, বর্ণবাদের এবং পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে দমন করতে ব্যবহার করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, একটি অভ্যন্তরীণ অহিংস সরাসরি কর্মসূচির (ডাইরেক্ট অ্যাকশন) দলকে এবং তাদের সমর্থকদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে লেবেল দেয়া হবে। কয়েকজন অঙ্গীকারবদ্ধ কর্মী, যাদের হাতে আছে কিছু লাল রঙের স্প্রে, বোল্ট কাটার আর ইলেকট্রিক স্কুটার, তাদেরকে আইএস বা বোকো হারামের মতো নৃশংস সংগঠনের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা হবে। এটা অশোভন।
প্যালেস্টাইন অ্যাকশন কীসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে? ইসরায়েলের গাজায় গণহত্যার।
একটি খাঁটি, চোখের সামনে সম্প্রচারিত গণহত্যা – যা প্রতিদিন আমাদের মোবাইলে উচ্চ রেজোলিউশনে দেখা যায়। যেখানে শিশুদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, পোড়া লাশ, ধ্বংসস্তুপে কেটে যাওয়া মানুষ – সব দৃশ্য চোখের সামনে।
একটি গণহত্যা, যা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিশুএমপুটি প্রজন্ম তৈরি করেছে। একটি গণহত্যা, যা শরণার্থী শিবিরে বোমা ফেলে আহতদের পুড়িয়ে মারে। একটি গণহত্যা, যা হাজার হাজার শিশুর জীবন কেড়ে নিয়েছে। এক বছরে গাজার মানুষের গড় আয়ু ৭৫ থেকে ৪০-এ নামিয়ে এনেছে – যা এখন বিশ্বের সবচেয়ে কম। আর এই গণহত্যা চালানোর জন্য আমাদের সরকারই অস্ত্র বিক্রি করে, নজরদারি বিমান পাঠায়।
স্টারমারের সরকার বলছে, এই নিষিদ্ধকরণ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। বাস্তবে এটি সত্যের বিপরীত। কারোরই নিরাপত্তা – ইউক্রেনেরও নয় – ইসরায়েলের এই গণহত্যায় বাড়ছে না। বরং আন্তর্জাতিক আইনকেই ধ্বংস করছে। প্যালেস্টাইন অ্যাকশন আইনের অবমাননা করে না – বরং আইন প্রয়োগের দাবিতে সরব।
তারা গ্রেপ্তার থেকে পালায় না। বিচারে ফাঁকি দেয় না। তারা জানে, আদালতের সামনে দাঁড়াতে হবে। সেই ঝুঁকি নিয়েই তারা গাজার মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
আবারও, বারবার, ব্রিটিশ জুরি তাদের নির্দোষ ঘোষণা করেছে – কারণ ন্যায়বোধকে অসম্মান করে এমন অহিংস প্রতিবাদকে জেলে পোরা মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ওপর হুমকি প্যালেস্টাইন অ্যাকশনকে বহু মানুষ সমর্থন করে। তরুণ প্রজন্ম, গ্রিন পার্টির নেতা, সাংবাদিকেরা তাদের সম্মান করে। যদি এই অন্যায্য নিষিদ্ধকরণ হয়, তাহলে সবাই ক্ষুব্ধ হবে। এবং তখন তাদেরও সন্ত্রাসবাদ দমন পুলিশের নজরদারির মুখে পড়তে হবে।
জর্জ মনবিয়ো কোনো সাহিত্য উৎসবে বক্তৃতা করলে পুলিশ কি তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করবে? ওয়েন জোন্স ইউটিউবে লাইভ করলে কি পুলিশ কমেন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করবে? সালি রুনি যুক্তরাজ্যে এলে কি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকে রাখা হবে? জারা সুলতানা নিজের ভোটারের সঙ্গে কথা বললে কি ভাবতে হবে, সামনে বসা মানুষটি প্রকৃত নাগরিক না কি পুলিশের উসকানিদাতা? সবাইকে কি শঙ্কায় থাকতে হবে— এই গণহত্যার বিরোধিতা করলে মধ্যরাতে দরজায় ধাক্কা পড়বে?
এরপর কার পালা? এই নিষিদ্ধকরণ সেই সব প্রার্থীদের ওপর নজরদারি আনবে, যারা যুদ্ধবিরোধী, মিতব্যয়বিরোধী, এবং গাজার পক্ষে সোচ্চার।
যেমন ওয়েস স্ট্রিটিং— স্টারমারের উত্তরসূরি হিসেবে ভাবা হয়— যিনি মাত্র ৫০০ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন, আর যাকে এখন লিয়ান মোহাম্মদ চ্যালেঞ্জ করছেন।
শাবানা মাহমুদও নিজেদের সুরক্ষিত আসন প্রায় হারিয়েছিলেন। বার্মিংহামে ভোটারদের মাত্র ৫ শতাংশ আগামী নির্বাচনে লেবারকে ভোট দিতে চায়।
কিয়ার স্টারমারের আসনেও বিশাল ক্ষোভ। সাধারণ মানুষ বলছেন, তাদের এমপি গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন না। আগামী নির্বাচনে, লেবারের ডজনখানেক এমপি যখন চাপে পড়বেন, তখন তারা কি সৎভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? নাকি আবারও ‘সামাজিক মাধ্যমে কোনো তুচ্ছ পোস্ট’ খুঁজে শাস্তি দেবেন?
হয়তো আমি অতি-আতঙ্কবাদী হচ্ছি। হয়তো এই সরকার এমন করবে না। কিন্তু এক সুস্থ গণতন্ত্রে এ ধরনের কিছু করার কথাই ওঠা উচিত নয়।
লেবার এমপিদের কাছে আবেদন ১৯৯৬ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা আমাকে তার দফতরে ডেকে বলেছিলেন, আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক সংসদে পাঠানো হবে। একজন গর্বিত ইহুদি হিসেবে, হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের সন্তান হিসেবে, সংসদে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো হলোকাস্ট স্বীকৃতির প্রস্তাব পেশ করা ছিল আমার জীবনের সেরা সম্মান।
তাই একজন প্রাক্তন আইনপ্রণেতা হিসেবে, লেবার পার্টির ৪১১ এমপির প্রতি আমার আবেদনঃ খুব শিগগিরই এই গণহত্যার জাদুঘর হবে। সবাই স্বীকার করবে এই ভয়ঙ্কর সত্য। তখন আপনার সন্তান-নাতিরা আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, যখন ইসরায়েল শিশুদের ওপর বোমা ফেলছিল, আপনি কী করেছিলেন? তাদের কি বলবেন— আপনি সেই গণহত্যার বিরোধিতাকারীদের সন্ত্রাসী ঘোষণা করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন?
রাতের অন্ধকারে যখন ঘুম আসবে না, নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো মনে পড়বে, তখন আপনার উত্তর কী হবে? এই সংকটকালে— আপনি কি গণহত্যার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন? নাকি সাহস করে বলেছিলেন— আর নয়, আর কখনো নয়, আমার নামে নয়। -অ্যান্ড্রু ফেইনস্টেইন

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button