ইসরায়েল কি পশ্চিমাদের ছাড়া টিকে থাকতে পারবে?

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং এর কারণে পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধ আমাদের সামনে দুটি ভয়ঙ্কর সত্য স্পষ্ট করেছে: প্রথমত, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃত ও আক্রমণাত্মকভাবে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করছে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল নিজের শক্তিতে টিকে থাকার কোনো সামর্থ্যই রাখে না।
এই দুটি বিষয় আলাদা মনে হলেও অটুটভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। কারণ, যারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলকে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তারা যদি এই সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতো, তবে মধ্যপ্রাচ্য আর দশকের পর দশক ধরে যে বারুদভর্তি কৌটোতে পরিণত হয়েছে, সেই পরিস্থিতি আর থাকতো না। ৭ অক্টোবর ২০২৩–এর পর পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হয়েছে, তাও হতো না।
বিষয়টি সরলীকরণ নয়, বরং কঠোর বাস্তবতা হলো: যদি ইসরায়েল গাজা থেকে সরে যেতো, এই ধ্বংসপ্রাপ্ত, গণহত্যার কবলে পড়া ভূখণ্ড অন্তত কিছুটা সুস্থ হওয়ার সুযোগ পেতো। এ পর্যন্ত ৫৬,০০০–এরও বেশি ফিলিস্তিনি – যাদের মধ্যে ১৭,০০০ শিশু ও ২৮,০০০ নারী – নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। নিখোঁজদের ওপর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
শুধু তখনই কিছুটা স্বাভাবিকতার দিকে ফেরা সম্ভব হতো, যেখানে ফিলিস্তিনিদের অখণ্ড অধিকার আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে সমুন্নত করা যেতো।
“জোর যার মুল্লুক তার”— এই ঘৃণ্য নীতিকে চিরতরে রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে বাদ দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম দেশগুলোকেও অবশেষে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলের বিভাজনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে পারে।
কিন্তু ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দাবি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। কেন?
বিখ্যাত গবেষক প্যাট্রিক উলফ বলেছেন, “উপনিবেশ স্থাপন একটি ঘটনা নয়, বরং একটি কাঠামো।” এর মানে হলো, ১৯৪৮–এর নাকবা থেকে শুরু করে প্রতিটি যুদ্ধ ও দখল – সবই এই কাঠামোর অংশ। এটি ফিলিস্তিনি জনগণকে মুছে ফেলার জন্যই পরিচালিত।
তাই মনে করা ভুল যে ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের আচরণ কেবল প্রতিশোধপ্রবণ ছিল, কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া। যদিও ইসরায়েলের অপরিসীম নিষ্ঠুরতা দেখে আমরা অনেকেই শুরুতে এই পার্থক্য বুঝতে পারিনি।
কিন্তু নেতানিয়াহুর বক্তব্য ছিল পুরোপুরি স্পষ্ট: “আমরা গাজাকে জনশূন্য দ্বীপে পরিণত করব।” এই মনোভাব ইসরায়েলের উপনিবেশবাদী প্রকৃতিরই অংশ এবং এটিকে থামানোর ক্ষমতা কার আছে?
ইসরায়েল বহুদিন ধরে পশ্চিমাদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টিকে আছে, যারা এটিকে উপনিবেশবাদী স্বার্থরক্ষার দূর্গ হিসেবে দেখে।
২০২২ সালের জুলাইতে জো বাইডেন বলেছিলেন, “আমেরিকান জনগণ ও ইসরায়েলি জনগণের সম্পর্ক রক্তমাংসে গাঁথা। আমরা অভিন্ন মূল্যবোধে এক।”
এই “অভিন্ন মূল্যবোধে” যে গণহত্যা বৈধ হয়, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেননি। পশ্চিমা নেতাদের বড় অংশও অন্ধভাবে এই কথাই পুনরাবৃত্তি করে।
কিন্তু এই গণহত্যার মধ্যেই কিছু পশ্চিমা ও অনেক অপশ্চিমা দেশ সাহসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ, নেতানিয়াহু ও চরমপন্থার নিন্দা করছে, যা ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকে এমনভাবে আর কখনো হয়নি। স্পেন, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া প্রভৃতি দেশ প্রমাণ করেছে যে সেই “অটুট বন্ধন” আসলে ভাঙা যায়।
কেন কিছু দেশ এই অবস্থান নিয়েছে আর কিছু দেশ নেয়নি—সেটি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ আছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট:
ইসরায়েল–পশ্চিমের বন্ধন ছিন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। এর ওপর ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে। প্রায় ২১ মাসের এই বীভৎস গণহত্যা আমাদের দেখিয়েছে, ইসরায়েল আসলে একটি নির্ভরশীল ভাসমান রাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সরাসরি বিপুল সহায়তা ছাড়া তারা নিজেদের যুদ্ধ চালাতে, আত্মরক্ষা করতে, এমনকি অর্থনীতি সচল রাখতেও অপারগ।
যুদ্ধের আগে কখনো কখনো ইসরায়েলি নেতারা বলতো, “আমরা আরেকটি যুক্তরাষ্ট্রের তারা (স্টার) নই।” কিন্তু এখন তাদের কণ্ঠে কেবল আর্তি, যেন যুক্তরাষ্ট্র এসে তাদের বাঁচায়।
যখন ফিলিস্তিনিরা অতুলনীয় সাহসে দখলদারি ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন যারা আন্তর্জাতিক আইন, ন্যায়বিচার ও শান্তিতে বিশ্বাসী, তাদের অবশ্যই তাদের সরকারগুলোর মুখোমুখি হতে হবে—যারা ইসরায়েলকে গণহত্যা ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
স্পেনের মতো দেশ অবিশ্বাস্যভাবে সাহসী অবস্থান নিয়েছে: স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ “গণহত্যার ভয়াবহ পরিস্থিতির” কারণে ইইউ–ইসরায়েল বাণিজ্য চুক্তি স্থগিতের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন।
আরও দেশ যদি এমন অটল অবস্থান নিতো, ইসরায়েল অন্তত সেই হত্যাযন্ত্র পেতে পারতো না, যা দিয়ে তারা এই নৃশংস গণহত্যা চালায়।
এখন আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো এই সাহসী কণ্ঠগুলোর পাশে দাঁড়ানো এবং ইসরায়েল ও তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে অনড়ভাবে জবাবদিহিতা দাবি করা। -ড. রামজি বারউদ

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button