গাজা নিয়ে ব্রিটিশ জনগণ সোচ্চার: নেতারা কী করবেন?

গত ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে আমরা গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য দেখে চলেছি। গোটা এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, পরিবারগুলো ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে।
সুরক্ষার অধিকার, পরিষ্কার পানি ও খাদ্যের মতো মৌলিক মানবাধিকারের সুযোগও সেখানে ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড যে গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে—এই বিষয়ে যথেষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বহু পশ্চিমা নেতা দ্বিধান্বিত, বিলম্বিত কিংবা একেবারে অস্বীকারমূলক অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশ জনগণকে এত সহজে বিভ্রান্ত করা যায় না।
‘অ্যাকশন ফর হিউম্যানিটি’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব জাস্টিস ফর প্যালেস্টাইন’-এর উদ্যোগে ইউগভ পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটিশ জনগণ তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ও অগ্রসর।
৫৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এখন ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের মধ্যে ৮২ শতাংশ বিশ্বাস করেন—ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গণহত্যার শামিল। অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেক ব্রিটিশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক—৪৫ শতাংশ—ইসরায়েলের গাজা অভিযানে “গণহত্যা” শব্দটি ব্যবহার করছেন।
এটি কোনো প্রান্তিক বা উগ্র ধারণা নয়। এটি একটি বাস্তব প্রতিফলন—একটি বাস্তবতা যা দিনের পর দিন অস্বীকার করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নাগরিক, সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীদের লক্ষ্য করে হামলা, জীবনের জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো ধ্বংস—এইসব প্রমাণ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এর পাশাপাশি জনসচেতনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এমনকি ইউগভ-এর মতো একটি স্বনামধন্য সংস্থার জরিপ ফলাফলগুলো মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট: ব্রিটিশ জনগণ আন্তর্জাতিক আইনকে গুরুত্ব দেয়, তারা জবাবদিহিতা চায়, এবং তারা পদক্ষেপ দেখতে চায়।
তথ্য বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। ৬৫ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক মনে করেন—যদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাজ্যে আসেন, তাহলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা উচিত। লেবার পার্টির ভোটারদের মধ্যে এই সংখ্যা ৭৮ শতাংশ।
আইসিসি যখন ন্যায়বিচারের পথে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে—যা অনেক পশ্চিমা সরকার এখনো করতে পারেনি—তখন ব্রিটিশ সরকার এখনো সেই আইনি অগ্রগতির সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছা মেলাতে ব্যর্থ।
জরিপে উঠে আসা তথ্য বলছে—বিগত নির্বাচনে লেবার পার্টিকে জয় এনে দেওয়া ভোটাররা এখন গাজা ইস্যুতে একটি নতুন ও বাস্তবমুখী অবস্থান দেখতে চায়।
এটি শুধু গাজার ন্যায়ের প্রশ্ন নয়—এটি একটি মূল্যবোধের প্রশ্ন: ব্রিটেন কী ধরনের দেশ হতে চায়? আমরা কি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রক্ষা করব, নাকি কূটনৈতিক সুবিধার আড়ালে নিজেদের লুকাবো?
জরিপে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে জোরালো জনসমর্থনের কথাও উঠে এসেছে। লেবার ভোটারদের ৪৩ শতাংশ অবিলম্বে ফিলিস্তিনকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান, যেখানে মাত্র ২ শতাংশ এর বিরোধিতা করেছেন।
৫৬ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক গাজার মানুষের জন্য একটি মানবিক ভিসা কর্মসূচি (হোমস্ ফর গাজা) চালু করার পক্ষে, যা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য বিদ্যমান কর্মসূচির আদলে হবে। সাধারণ কথাবার্তা ও কূটনৈতিক দ্ব্যর্থতার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে।
যখন কোনো অপরাধ গণহত্যার মাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন নীরবতা হয়ে ওঠে সহাবস্থান। এবং জনগণ এটিই বুঝে ফেলেছে।
জরিপ বলছে, গাজা বিষয়ে লেবার পার্টির বর্তমান অবস্থান তাদের নিজস্ব সমর্থকদের ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ক্রিয়াহীনতার খরচ শুধু নৈতিক নয়—রাজনৈতিকও। নেতারা যদি জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে গাজা নিয়ে চুপ থাকেন, তবে তারা কেবল নৈতিক দায়িত্বই এড়িয়ে যান না, বরং তাদের ভোটারদেরও হারান।
এই দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো কিছুটা নির্লজ্জ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে চলমান নিষ্ক্রিয়তা, সংগঠিত সহিংসতার বিপরীতে কার্যকর অবস্থান না নেওয়া—এই পরিস্থিতিতেই এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে।
এটি কেবল ব্রিটিশ প্রেক্ষাপট নয়—কানাডার সাম্প্রতিক জরিপেও দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক জনগণ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা মনে করেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে এবং বিশ্বব্যাপী একটি মোড় ঘুরছে।
আমরা যারা গাজা ও অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সামনে থেকে কাজ করছি, তারা দেখেছি বিশ্বব্যবস্থার দায়মুক্তির মানবিক মূল্য কতটা ভয়াবহ। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি—জনমতের শক্তি কীভাবে ন্যায়ের পথে নীতিতে রূপ নিতে পারে।
গাজায় চলমান অপরাধের ব্যাপকতা স্বীকার করতে পশ্চিমা সরকারগুলোর ব্যর্থতা কেবল তাদের ইতিহাসের ভুল দিকে রাখে না, বরং বর্তমানেও ন্যায়ের বিপরীত পাশে বসায়। -ওসমান মকবেল, ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি অলাভজনক সংস্থার নির্বাহী। বর্তমানে তিনি “অ্যাকশন ফর হিউম্যানিটি”-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, যা সিরিয়া রিলিফ-এর মূল দাতব্য সংস্থা — যুক্তরাজ্যে সিরিয়া-কেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় এনজিও। তিনি পূর্বে ACEVO, চ্যারিটি ফিউচার্স-এর ট্রাস্টি ছিলেন এবং ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হিউম্যান অ্যাপিল-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি ACEVO ফেলোশিপ পুরস্কার পান, যা তাকে শ্রেষ্ঠ প্রধান নির্বাহীদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালে ওসমান মকবেল BOND হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড-এর জন্য মনোনীত হন।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button