গাজার গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে হবে আজ হোক কিংবা কাল হোক
গত ২০ মাসে আমি বারবার নিজেকে এক প্রশ্ন করেছি: মানবতাবিরোধী অপরাধ স্বীকার করতে কতটা সময় লাগে? গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের গণহত্যামূলক উদ্দেশ্য এবং বিপর্যয়ের পরিমাণ নিজেই যেন স্পষ্ট। তবুও, এই গণহত্যা চলছে। কেন?
আসলে ইতিহাস বলে— মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সময় বিশ্ব তা স্বীকৃতি দেওয়া বা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে ব্যর্থ।
একবার উপনিবেশিক যুগের গণহত্যার দিকে তাকানো যাক।
১৯০৪ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে, জার্মান উপনিবেশবাদীরা নামিবিয়ায় ৬৫,০০০ হেরেরো এবং ১০,০০০ নামা জনগণকে হত্যা করে। এটিকেই অনেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা হিসেবে মনে করেন। এই গণহত্যা ছিল জার্মানদের প্রতিক্রিয়া—যখন আদিবাসীরা তাদের ভূমি দখলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। এই সময়ের নৃশংসতাকে বলা হয়েছে “ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন: রক্তপাত, অপমান আর মৃত্যুতে ভরা।”
বেঁচে যাওয়া অনেকের মৌখিক সাক্ষ্য ১৯১৮ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের ব্লু বুক-এ সংরক্ষিত হয়। এটি ছিল আফ্রিকান কণ্ঠস্বরের একটি বিরল দলিল। কিন্তু ১৯২৬ সালে সব কপি ধ্বংস করা হয়, যাতে আফ্রিকান দৃষ্টিভঙ্গি লিপিবদ্ধ অবস্থায় আর না থাকে।
জার্মানি এই গণহত্যাকে ২০২১ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং দুঃখপ্রকাশ করে।
১৯০৫ সালে জার্মানদের দ্বারা আদিবাসীদের জোর করে তুলা চাষে বাধ্য করার প্রতিবাদে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। জার্মানদের “পোড়া মাটি নীতি”তে প্রায় ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়।
বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়, এবং কিছু মৃতদেহ জার্মানিতে পাঠানো হয় তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক গবেষণার” জন্য—যা ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছিল।
এই ভয়াবহ ঘটনার জন্য ২০২৩ সালে, জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টেইনমায়ার তানজানিয়ার সোনজিয়াতে একটি স্মৃতিস্তম্ভে দুঃখপ্রকাশ করেন।
১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর, জার্মান ইহুদিদের অধিকারের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসে। বহু ইহুদি দেশত্যাগের চেষ্টা করে। তবুও, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ কঠোর অভিবাসন নীতি বজায় রাখে।
যুক্তরাজ্যে তখন বাড়তে থাকা ইহুদি-বিদ্বেষ সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে কঠোর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্রেও একই রকম বাধা ছিল—“বিদেশিদের প্রতি বিরূপ মনোভাব” এবং “ইহুদি অভিবাসনবিরোধী জনমত”-এর অজুহাতে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দেরিতে আসা ঘৃণা আজ “এপারথেইড” বা বর্ণবাদ ঘৃণার প্রতীক হলেও, তখন বিষয়টি এমন ছিল না।
যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি অবস্থান তা পরিষ্কার করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত লেবার এবং কনজারভেটিভ সরকারগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে, বারবার বর্ণবাদবিরোধী নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এবং হেনরি কিসিঞ্জারও ইতিহাসে কলঙ্কিত।
রিগানের “গঠনমূলক সম্পৃক্ততা” এবং নিষেধাজ্ঞাবিরোধী অবস্থান আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)-কে দমন করতে চেয়েছিল, কারণ তিনি একে “কমিউনিস্ট ঘনিষ্ঠ” মনে করতেন। ১৯৮৪ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটু রিগানের নীতিকে বলেছিলেন: “অনৈতিক, শয়তানসুলভ, এবং খ্রিস্টীয়তাবিরোধী।”
কিসিঞ্জার, ১৯৭৬ সালে সোয়েটো গণহত্যার তিন মাস পর দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন। নিরাপত্তা বাহিনী তখন নিরস্ত্র ছাত্রদের গুলি করেছিল। তবুও, তাঁর সফরে না বর্ণবাদ, না গণহত্যা—কোনোটাই আলোচনা হয়নি।
১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ৮০০,০০০-র বেশি তুতসি এবং মধ্যপন্থী হুতু গণহত্যার শিকার হন মাত্র ১০০ দিনে। যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ ব্যবহৃত হয়—প্রায় ২,৫০,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হন।
হুতু মিলিশিয়ারা এইচআইভি রোগীদের হাসপাতালে থেকে ছেড়ে এনে ধর্ষণ দলে অন্তর্ভুক্ত করে। মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ কর্মী ও কূটনীতিকরা গণহত্যার আগাম সতর্কতা দিয়েছিলেন। তবুও, বিশ্ব নিশ্চুপ ছিল।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা প্রত্যাহার করে। ফ্রান্স ও বেলজিয়াম শুধু নিজেদের নাগরিকদের উদ্ধার করে। যুক্তরাষ্ট্র তো “গণহত্যা” শব্দটাই ব্যবহার করতে চায়নি।
১৯৯৮ সালে, বিল ক্লিনটন কিগালিতে এসে বলেন: “হত্যা শুরু হওয়ার পর আমরা যথাসময়ে ব্যবস্থা নিইনি। আমরা এই অপরাধকে তৎক্ষণাৎ সঠিক নামে ডাকিওনি : বলিনি গণহত্যা।”
তাহলে গাজার ক্ষেত্রে কী ভিন্ন?
এই ইতিহাস মাথায় রেখে, গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। তবুও, অন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো, গাজার ক্ষেত্রেও একটি বিচার দিবস আসতে পারে। ইসরায়েল গাজায় বাস্তব সময়ে গণহত্যা চালাচ্ছে—যা লাইভস্ট্রিম, দলিলভিত্তিক এবং নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত। শিশুদের স্নাইপার দিয়ে হত্যা। কবিদের টার্গেট করে হত্যা। হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়া। সাংবাদিকদের নিধন। সবকিছু ক্যামেরায় ধরা পড়েছে—সংরক্ষিত হয়েছে। ইসরায়েলি রাজনীতিকেরা প্রকাশ্যে বলেছেন, তাদের লক্ষ্য জাতিগত নির্মূল।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলি সৈন্যদের ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে লুটপাট করতে, ধ্বংস নিয়ে আনন্দ করতে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিটি অপরাধ লিপিবদ্ধ করেছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশ কূটনৈতিক প্রতিবাদ, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির মাধ্যমে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
হিন্দি ও উর্দুতে একটি প্রবাদ আছে: “দের আয়ি, দুরুস্ত আয়ি।”
অনুবাদে অনেক সময় বলা হয়:
“দেরিতে হলেও ভালোভাবে আসা।” কিন্তু একজন সহকর্মী বলেন, এর পার্সিয়ান উৎস থেকে সঠিক অর্থ: “যেটি দেরিতে আসে, সেটিই ন্যায় ও সত্য।” ফিলিস্তিনের জন্য বিচার হয়তো দেরিতে আসবে।কিন্তু তা যেন সঠিক হয়। আর যেন তা ন্যায়নিষ্ঠ হয়। -সোমদীপ সেন
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]