গাজা গণহত্যা: আরব শাসকদের অভ্যন্তরীণ বৈরী আচরণ

গাজা আরব রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার ভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে, এবং এর গভীর কাঠামোগত ও নৈতিক দেউলিয়াত্ব উন্মোচন করেছে।
গত মাসে একটি টেলিভিশন ভাষণে, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাসকে উদ্দেশ্য করে অশালীনভাবে আক্রমণ করেন, তাদের “কুকুরের বাচ্চা” বলে অভিহিত করেন এবং অস্ত্র পরিত্যাগ করে বাকি ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।
তার ওই ভাষণে, তিনি যেন ভুলে গিয়েছিলেন ২০২৩ সালের মে মাসে জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের” কাছে দখলদারদের আগ্রাসন থেকে সুরক্ষা চেয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন।
“বিশ্ববাসী, আমাদের রক্ষা করুন,” আব্বাস বলেছিলেন। “আমরা কি মানুষ নই? পশুদেরও তো সুরক্ষা দেওয়া উচিত। আপনার যদি কোনো পশু থাকে, আপনি কি সেটিকে রক্ষা করবেন না?”
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ইসরায়েলি মিডিয়া জানায় যে সৌদি আরব গাজার জন্য একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে, যার কেন্দ্রে ছিল হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং ক্ষমতা থেকে সরানো।
আরব ও আমেরিকান সূত্র ইসরায়েল হায়োম পত্রিকাকে জানায়, হামাস যদি অস্ত্র জমা না দেয় এবং যুদ্ধোত্তর শাসনে কোনো ভূমিকা না রাখে—এই নিশ্চয়তা না থাকলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গাজা পুনর্গঠনে আর্থিক বা বাস্তব কোনো সাহায্য করবে না।
মার্চ মাসে, মিডল ইস্ট আই জানায় যে, জর্ডান একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে যাতে গাজার ফিলিস্তিনি দলগুলোকে নিরস্ত্র করা এবং হামাসের ৩,০০০ সদস্যকে—সামরিক ও বেসামরিক উভয় নেতৃবৃন্দসহ—গাজা থেকে নির্বাসিত করার কথা বলা হয়েছে।
এরপর এপ্রিলের মাঝামাঝি, আব্বাস হামাসকে হুমকি দেওয়ার কয়েকদিন আগে, মিশর কায়রোতে হামাস প্রতিনিধিদলের কাছে একটি “যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব” তুলে ধরে, যার মধ্যে ছিল হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি।
আব্বাস এবং প্রধান আরব শাসকদের পক্ষ থেকে হামাসকে অস্ত্র পরিত্যাগের আহ্বান গাজার প্রতিরোধের প্রতি আরব রাজনৈতিক ব্যবস্থার শত্রুতার একটি বিস্তৃত ধারা প্রকাশ করে।
এটি মুক্তির সংগ্রামের মৌলিক ও ন্যায়সঙ্গত প্রশ্নগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে: দখলদারদের বিরুদ্ধে কি দখলকৃতদের প্রতিরোধের অধিকার নেই? একটি নিরস্ত্র প্রতিরোধ কীভাবে একটি নির্মম সামরিক দখলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে যারা নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালায়?
জায়নবাদী আগ্রাসন যদি অনির্বাচিতভাবে চলতেই থাকে, আর আরব শাসকগণ ও বিশ্ব যদি চোখ বন্ধ করে রাখে, তাহলে দখলদারিত্বের অবসান ও অবরোধ তুলে নেওয়ার কী গ্যারান্টি রয়েছে?
গাজাকে নিরস্ত্র করার আহ্বান পশ্চিমা কথোপকথনে “আত্মসমর্পণ” এবং আগ্রাসনের পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হতো। এ ধরনের দাবি আরব শাসকদের দীর্ঘদিনের ফিলিস্তিন বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়।
বছরের পর বছর ধরে, এই বিশ্বাসঘাতকতা রূপ নিয়েছে এই শাসকদের সক্রিয় সহোযোগিতায়—যা অক্ষমতা থেকে নয়, বরং পরিকল্পনারই অংশ। তাদের দৃষ্টিতে প্রতিরোধ অর্থহীন, দখলদারদের পরাজয় কল্পনাতীত, এবং একটি স্বাধীন ও বিদ্রোহী ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব তাদের কাঙ্ক্ষিত আঞ্চলিক শৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
জায়নিস্ট ঔপনিবেশিকতাবিরোধী সংগ্রামের পুরো সময় জুড়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এসেছে, যখন আরব সরকারগুলো প্রকৃত অর্থে হস্তক্ষেপ করতে পারত—চাইলে জায়নিস্ট প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত, কিংবা অন্তত তার অগ্রগতি থামাতে পারত। কিন্তু তারা বারবার ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনটি বড় ঘটনা এই বিশ্বাসঘাতকতাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। প্রথমটি ১৯৪৮ সালে, নাকবার সময় ঘটে, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপের ওপর।
নাকবার আগমুহূর্তে, একজন খ্যাতিমান ফিলিস্তিনি যোদ্ধা আবদুল কাদির আল-হুসেইনি, জেরুজালেমের পশ্চিমে অবস্থিত কৌশলগত কাসতাল গ্রাম পুনর্দখলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নিহত হন।
১৯৩৬ সালের ফিলিস্তিনি বিদ্রোহে যিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই হুসেইনি ১৯৪৮ সালের মার্চে দামেস্কে গিয়ে আরব লীগের কাছে অস্ত্র সহায়তার জন্য আবেদন করেন, কারণ জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা অগ্রসর হচ্ছিল।
এরপর আসে খবর, কাসতাল পতন হয়েছে। হুসেইনি আরব লীগের কাছে কাঁদতে কাঁদতে অস্ত্র চান, কিন্তু কোনো সাড়া পান না।
জেরুজালেমে ফেরার আগে তিনি আরব লীগকে বলেন: “আমি কাসতালে যাচ্ছি, আমি সেটি ঝড় তুলে দখল করব, এমনকি যদি তাতে আমার মৃত্যু হয়। আমি এখন মৃত্যু চাই, কারণ আমি দেখতে চাই না ইহুদিরা ফিলিস্তিন দখল করছে। লীগ ও নেতৃত্ব ফিলিস্তিনকে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।” পরবর্তীতে তিনি লীগকে একটি চিঠিতে লেখেন: “আপনারা আমার সৈনিকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সাহায্যহীন রেখে গেছেন, আমি আপনাদের দায়ী করছি।”
দামেস্ক থেকে ফেরার পর, হুসেইনি দ্রুত কাসতাল পুনর্দখলের জন্য একটি সামরিক অভিযান সংগঠিত করেন, কিন্তু ৮ এপ্রিল ১৯৪৮-এ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। পরে অনেক যোদ্ধা ওই গ্রাম ত্যাগ করে, যা এরপর জায়নিস্ট বাহিনী ধ্বংস করে দেয়। পরদিনই, জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা পাশের গ্রাম দেইর ইয়াসিনে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়, বহু বেসামরিক মানুষকে হত্যা ও বিকৃত করে, এবং গ্রামটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
অনেক আরব ইতিহাসবিদ মনে করেন, কাসতালের যুদ্ধ—১৯৪৮ সালে প্রথম দখল হওয়া ফিলিস্তিনি গ্রাম—ছিল যুদ্ধের অন্যতম নির্ধারণকারী পর্ব। এর কৌশলগত অবস্থান, জেরুজালেমের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উপরে অবস্থিত হওয়ায়, এর পতন জায়নিস্ট দখলদারিত্বের পথ খুলে দেয়।
এই কারণেই আরব শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা এতটা তাৎপর্যপূর্ণ ও লজ্জাজনক। ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এই যুদ্ধকে “মরণপণ লড়াই” ও “আরব বিশ্বের বিশ্বাসঘাতকতা” হিসেবে বর্ণনা করে, যা “ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসে সবচেয়ে বিপর্যয়কর ২৪ ঘণ্টা” হিসেবে পরিগণিত হয়।
দ্বিতীয় বড় বিশ্বাসঘাতকতা ঘটে, যখন সবচেয়ে প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্র মিশর, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করে জায়নিস্ট ঔপনিবেশিকতাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button