নজরুলের কাব্যে কোরবানী

Nazrul Islamমুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল জিলহজ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হলো এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’ (বোখারি : ৯৬৯)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’ [মুসনাদ আমহদ : ১৩২] এ হাদিসগুলোর মর্ম হলো, বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিনই সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দিনগুলোতে নেক আমল করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এ উৎসাহ প্রদান এ সময়টার ফজিলত প্রমাণ করে। তাছাড়া এ দিনগুলোর মধ্যে রয়েছে মহামর্যাদাবান আরাফার দিনের রোজা, কোরবানি ও ঈদের মতো বহু মর্যাদার কারণ।
ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, নেক আমলের মৌসুম হিসেবে জিলহজ মাসের প্রথম দশক হলো সর্বোত্তম, এ দিবসগুলোয় সম্পাদিত নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। হাদিসের কোনো কোনো বর্ণনায় (‘আহাব্বু’ তথা সর্বাধিক প্রিয়) শব্দ এসেছে, আবার কোনো কোনো বর্ণনায় (‘আফজালু’ তথা সর্বোত্তম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোনো সময়ে নেক আমল করার থেকে বেশি মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। এ জন্য উম্মতের অগ্রবর্তী পুণ্যবান মুসলিমগণ এ সময়গুলোতে অধিকহারে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। যেমন আবু ছিমান নাহদী বলেন, ‘তাঁরা অর্থাৎ সালাফ তথা পূর্বসূরিগণ দিনটি দশককে অনেক বেশি মর্যাদাবান জ্ঞান করতেন : রমজানের শেষ দশক, জিলহজের প্রথম দশক এবং মহররমের প্রথম দশক।’
একনিষ্ঠ মনে তওবা : জিলহজের শুভাগমনের আগে সবচে’ বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার এ তওবা তথা সব গুনাহ থেকে ফিরে আসার প্রতি। সার্থক তওবা সেটি যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যথা প্রথম গুনাহটি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা। দ্বিতীয় গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। এবং তৃতীয়  এই গুনাহটি ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা। বাস্তবেই এটি তওবার সুবর্ণ সময়। দয়াময় মাবুদ এ সময় বেশি বেশি তওবার তৌফিক দেন এবং অধিক পরিমাণে বান্দার তওবা কবুল করেন।
এ সুযোগ কাজে লাগাতে সংকল্প গ্রহণ করা : সবার উচিত এই দিনগুলোকে পুণ্যময় কাজ ও কথায় সুশোভিত করার দৃঢ়প্রত্যয় গ্রহণ করা। যে ব্যক্তি কোনো কাজের সংকল্প করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তার জন্য সাহায্যকারী উপায় ও উপকরণ প্রস্তুত করে দেন। যে আল্লাহর সঙ্গে সত্যবাদিতা দেখায় আল্লাহ তাকে সততা ও সফলতায় ভূষিত করেন। আল্লাহ  বলেন, ‘আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদের আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গেই আছেন।’ (সূরা আল আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)।
গুনাহ থেকে দূরত্ব অবলম্বন করা : সৎ কর্মের মাধ্যমে যেমন আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়, গুনাহের কাজের মাধ্যমে তেমন আল্লাহ থেকে আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মানুষ তার নিজের করা অপরাধের কারণে কখনও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আমরা যদি অপরাধ মার্জনা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রত্যাশী হই, তাহলে এ দিনগুলোতে এবং এর শিক্ষা কাজে লাগিয়ে বছরের অন্য দিনগুলোতে গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে। কেউ যখন জানতে পারেন কী বড় অর্জনই না তার জন্য অপেক্ষা করছে, তার জন্য কিন্তু যে কোনো কষ্ট সহ্য করা সহজ হয়ে যায়।
ইসলামী আদর্শের যতগুলো অনুষ্ঠান ও ইবাদত রয়েছে তার প্রত্যেকটিতে মানবজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। কোরবানির সঙ্গে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈলের (আ) যে ঘটনাটি জড়িত, তা মানব ইতিহাসে অনন্য।
যাদের মধ্যে কোরবানির মাধ্যমে সে আত্মত্যাগের মানসিকতা সৃষ্টি হয় না, যাদের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার প্রত্যয়, প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার সৃষ্টি হয় না, তাদের কোরবানিতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না। তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। তাকওয়া হলো এমন একটা মানসিক অবস্থা, যা মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে সবকিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত করে। যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, তাকওয়া সেখান থেকে মানুষকে বিরত রাখে, অন্যদিকে মানুষকে আল্লাহর আদেশ পালনে বাধ্য করে। এক কথায়, মানুষের দৈহিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সব ধরনের ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে এই তাকওয়া। এই তাকওয়ার কারণেই ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ.) চরম আত্মত্যাগের উদাহরণ রাখতে পেরেছেন। আর এ কোরবানির উদ্দেশ্য হলো সেরকম মন ও মনন নিয়ে তাকওয়া সৃষ্টি করা। তা যদি না হয় তাহলে কোরবানির কোনো অর্থ থাকে না। সেই কোরবানির কোনো আনন্দ থাকে না। ঈদুল আজহা হয়ে যায় নিরানন্দ, নিষ্প্রাণ।
সত্যিকার কোরবানির প্রতিফলন আমাদের আচরণে ফুটে ওঠা উচিত। আমাদের পাশে যে প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত আছে, তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য যদি আমরা সামান্য অর্থ ত্যাগ করতে না পারি, যাদের গায়ে কাপড় নেই তাদের সে প্রয়োজন মেটানোর জন্য সামান্য অর্থ ত্যাগ করায় আমাদের মন না কাঁদে এমন মানুষের কোরবানির কী অর্থ থাকতে পারে? যারা গরিব ও দরিদ্র জনসাধারণের ভোগান্তির দিকে খেয়াল না করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় আর অতিরঞ্জিত মুনাফার লোভ ত্যাগ করতে না পারে, তাদের কোরবানির কোনো অর্থ থাকে না। যারা অশ্লীল ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের আকর্ষণ ও মোহকে ত্যাগ করতে না পারে, তাদের জন্য কোরবানি অর্থহীন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম হলো কোরবানি। কোরবানি একটি উত্তম ইবাদত। কোরবানি করা আল্লাহর নির্দেশ। তাইতো এই পৃথিবীতে প্রেরিত অসংখ্য-অগণিত নবী-রাসূল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করেছেন। আমাদের নবী, আখেরি নবী, হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে এবং মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিমের (আ.)  সুন্নতকে চির জাগ্রত রাখার জন্যই প্রিয় নবী (সা.) কোরবানি  করেছেন। বিভিন্ন হাদিস ও সিরাত গ্রন্থসমূহে প্রিয় নবীর (সা.)  কোরবানির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) তাঁর ৬৩ বছরের পবিত্র হায়াতের মধ্যে তিনটি পর্যায়ে বহুবার কোরবানি করেছেন।
প্রথমত, বদরের যুদ্ধের পর ‘গাজওয়ায়ে সাবিক’ (ছাতুর যুদ্ধ) নামে রক্তপাতহীন একটি যুদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয় হিজরির জিলহজ মাসের ৯ তারিখে প্রিয় নবী (সা.) ‘গাজওয়ায়ে সাবিক’ থেকে ফিরে আসেন এবং পরের দিন ১০ জিলহজ দু’রাকাত কোরবানির নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে মহানবী (সা.) নিজে দুটি ভেড়া কোরবানি করেন এবং মুসলমানদের কোরবানি করার জন্য নির্দেশ দেন। এটাই ছিল প্রথম কোরবানি (জারকানি, ১ম খ-, ৪৬০ পৃ.)।
দ্বিতীয়ত, প্রিয় নবীর (সা.) জীবনে দ্বিতীয়বার কোরবানি সম্পাদন হয়েছিল হোদাইবিয়ার সন্ধির সময়। মক্কা শরিফ থেকে ৯ মাইল দূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম হোদাইবিয়া। হিজরি ৬ষ্ঠ সালে এখানেই কোরাইশদের সঙ্গে প্রিয় নবীর (সা.) একটি চুক্তি হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে এটি হোদাইবিয়ার সন্ধি নামে সমধিক পরিচিত। এর বহু আগে রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি এবং তাঁর কতিপয় সাহাবি মক্কা শরিফে নিরাপদে প্রবেশ করে সেখানে ওমরা আদায় করছেন। অতঃপর কতিপয় সাহাবিকে দেখলেন, তারা মাথা মু-ন করছেন। আর কতিপয়কে দেখলেন, তারা মাথার চুল কেটে ছোট করছেন (বায়হাকি শরিফ)। প্রিয় নবীর (সা.) এ স্বপ্ন শোনামাত্রই যাদের অন্তরে বায়তুল্লাহ শরিফের মহব্বত বিদ্যমান ছিল, যারা আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার জন্য ব্যাকুল ছিল, এ স্বপ্ন তাদের ভালোবাসা আর ব্যাকুলতা আরও বাড়িয়ে দিল। তারা বায়তুল্লাহ জিয়ারতের জন্য আরও উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ৬ষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসের প্রথম দিকে সোমবার প্রিয় নবী (সা.) পবিত্র ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্রায় চৌদ্দশ মোহাজির ও আনসার সাহাবি তাঁর সঙ্গী ছিলেন। কোরবানির জন্য তারা ৭০টি উট সঙ্গে নিয়েছিলেন। যখন তারা ‘জুলহুলাইফা’ পৌঁছে কোরবানির পশুর গলায় পট্টি বাঁধলেন এবং ওমরার জন্য ইহরামের পোশাক পরিধান করলেন। উল্লেখ্য, বদরের যুদ্ধে আবু জাহেলের যে উটটি প্রিয় নবী (স.) গনিমত হিসেবে তাঁর অধীনে এসেছিল কোরবানির জন্য সেই উটটিও সঙ্গে নিলেন। এদিকে কোরবানির উটগুলো আগে আগে চলতে শুরু করল এবং কাফেলা মক্কার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। যে কেউ দূর থেকে দেখলেই অনায়াসে বুঝতে পারবে যে, এই উটগুলো কোরবানির জন্য এবং তারা কাবা শরিফ তওয়াফের জন্য যাচ্ছে।
যাই হোক, এদিকে কাফেররা প্রিয় নবীসহ (সা.) মুসলমানদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। অবশেষে উভয়ের মধ্যে একটি চুক্তিনামা সম্পাদিত হয়। চুক্তিপত্র সম্পন্ন হওয়ার পর এবার প্রিয় নবী (সা.) সাহাবিগণকে কোরবানি এবং মাথা মু-ন করতে নির্দেশ দিলেন। তিনবার নির্দেশ দেয়ার পরও তারা কেউ এ আদেশের প্রতি খেয়াল করল না। এমতাবস্থায় প্রিয় নবী (সা.) উম্মুল মোমেনিন হজরত উম্মে সালমার (রা.) কাছে গেলেন এবং একথা ব্যক্ত করলেন। নবীর (সা.) সহধর্মিণী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নিজে কোরবানি করুন। মাথা মু-ন করুন। সাহাবিগণ এমনি এমনিতেই আপনার অনুসরণ করবেন। ঘটনা তাই হলো, প্রিয় নবী (সা.) যখন কোরবানি করা শুরু করলেন, সাহাবিগণ বসে না থেকে সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি করা শুরু করে দিলেন। হজরত শোয়াইবের (আ.) কন্যার পরামর্শ হজরত মূসার (আ.) ব্যাপারে যেরূপ সঠিক ছিল, অনুরূপ উম্মুল মোমেনিন হজরত উম্মে সালমারও (রা.) পরামর্শ সঠিক ও যথার্থ ছিল। আর এই পরামর্শ বয়ে এনেছিল মুসলমানদের জন্য প্রভূত কল্যাণ ও বরকত। (বোখারি শরিফ ও ফাতহুল বারি)। প্রায় দু’সপ্তাহ হোদাইবিয়ায় অবস্থান করার পর, প্রিয় নবী (সা.) সেখান থেকে রওনা হয়ে যখন মক্কা ও মদিনা শরিফের মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছলেন, তখন ওহি নাজিল হয়, আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি। (আহমদ আবু দাউদ শরিফ)।
তৃতীয় কোরবানি : প্রিয় নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন এবং পবিত্র জীবনের ১০টি বছর সেখানে অতিবাহিত করেন। মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করেন। হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী (সা.) ১০ বছর মদিনায় অবস্থান করেন এবং প্রতি বছরে তিনি কোরবানি করতেন। (তিরমিজি, মেশকাত, পৃ. ১২৯)।
প্রিয় নবী (সা.) যখন কোরবানি দেয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন দুটি বড় সাইজের, দেখতে সুন্দর, আকর্ষণীয়, মোটাতাজা মেষ বা ভেড়া ক্রয় করতেন। তাঁর উম্মতের মধ্যে যারা তাওহিদের ও তাঁর রেসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে একটি কোরবানি করতেন এবং অন্যটি নিজ ও নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করতেন। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা)। এছাড়া তিনি গরু ও উট কোরবানিও দিয়েছেন। গরু ও উটের ক্ষেত্রে সাতজন শরিক হওয়ার জন্য তিনি অনুমতি দিয়েছেন। প্রিয় নবী (সা.) স্বাস্থ্যবান, ভালো পশু দিয়ে কোরবানি করতে উৎসাহিত করেছেন। পক্ষান্তরে রোগা, অসুস্থ, খোঁড়া, কানা ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি দিতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র ঈদুল আজহার অন্যতম ইবাদত হলো, ‘আজহা বা কোরবানি আদায় করা, প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, যার সাধ্য ছিল কোরবানি দেয়ার কিন্তু কোরবানি দিল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয়। (হাকিম, আল মুসতাদরাক খ–৪, পৃ. ২৫৮)। ইসলামের অনন্য উৎসব ঈদুল আজহা। বিশ্বের মুসলমানরা যে মুসলিম পরিচয় বহন করে। সেই পরিচয়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। তাই এ জাতিকে বলা হয় মিল্লাতে ইবরাহিম বা ইবরাহিমের জাতি। ত্যাগের পরীক্ষায় বহুবার তিনি হয়েছিলেন পরীক্ষিত।
প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর নামে কোরবানি করতে এতটুকুও ছিল না দ্বিধা-সঙ্কোচ। মানুষকে বধ করা ছিল না গ্রষ্টার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য ছিল ইবরাহিমের হৃদয় পরখ করা। উত্তীর্ণ হলেন ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহ পাঠিয়ে ছিলেন দুম্বা। ইসমাইলের (আ.)  পরিবর্তে সেই দুম্বা জবাই হয়ে গেল। সেই থেকে অদ্যাবধি চলছে ঈদুল আজহার পশু কোরবানি। কিন্তু এ ঘটনার অন্তর্নিহিত শিক্ষা যে ত্যাগ তা ভুলে গিয়ে আমরাও কি আচারসর্বস্ব হয়ে যাইনি। আমাদের আচরণের ভেতর যে দর্শন বিচরণের কথা ছিল তা কোথায়? নজরুল তো সেই কথাই বলেছেন তার ‘কোরবানি’ কবিতায়। “ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য গ্রহ’/ শক্তির উদ্বোধন”
পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য জীবন দানের প্রয়োজন। সেজন্য ইবরাহিমের মতো পুত্র কোরবানি প্রয়োজন। জাতির জন্য হাজেরা মায়েদের এগিয়ে দিতে হবে তাদের প্রিয় পুত্রকে। তবেই স্বাধীনতা আসতে পারে।
নজরুল তার চেতনার ভেতরেই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তার ‘বকরিদ’ কবিতায় বলতে চেয়েছেনÑ ‘শহীদানদের ঈদ হলো বকরিদ/ অন্তরে চির নওজোয়ান যে তারি তরে এই ঈদ।’
এভাবে নজরুল কোরবানি বা ত্যাগের মর্মকে উপলব্ধি করেছেন এবং মুসলিম বীরদের জাতীয় জাগরণের প্রতীক ও প্রেরণা হিসেবে তুলে ধরছেন। মহান বীরদের ও তাদের কোরবানি প্রচেষ্টাগুলো কবি স্মরণ করেছেন এজন্যই যে, সে প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই জুলুম-জালিম উৎখাত হবে। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, জালিম-মজলুমের সংঘাত, শোষক-শোষিতের লড়াই, নিপীড়ক-নিপীড়িতের যুদ্ধ ধর্ম-অধর্মের জিহাদ হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাস। সত্যের সুরে অসুরকে বিদূরিত করতে, আলোর গানে অন্ধকার বিদূরিত করতে জমায়েত হতে হবে শহীদের ঈদগাহে। উৎসর্গ করতে হবে আল্লাহর রাহে অর্থাৎ ন্যায়ের পথে, সংগ্রামে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে।
‘চাহিনা ক’গাভী দুম্বা উট/ কতটুকু দান? ও দান ঝুট/ চাই কোরবানি, চাই না দান/ রাখিতে ইজ্জত ইসলামের/ শির চাই তোর, তোর ছেলের/ দেবে কি? কে আছ মুসলমান?’
(শহীদি ঈদ)
বাঁচার জন্য মরা প্রয়োজন। যারা বাঁচার জন্য ছোটে তারা বাঁচতে পারে না। যারা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে মরার জন্য ছোটে তারাই বেঁচে থাকে, তারাই হয় মৃত্যুঞ্জয়। নজরুলও তা-ই বলেনÑ ‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে, মুসলিম নহে ভ- সে! ইসলাম বলে বাঁচ সবাই! দাও কোরবানি জান ও মাল/ বেহেশত তোমার কর হালাল/ স্বার্থপরের বেহেশত নাই।’
(শহীদি ঈদ)
নজরুল বলেছেন, যখন পূর্ণ আজাদ হবে স্বদেশভূমি তখন পশু কোরবানি কর। আর পশু যদি জবাই করতেই হয় তবে মনের পশুকে আগে কর জবাই। তারপর প্রতীকী পশু জবাই করে গোশত খাও, তাতে আপত্তি নেই। ‘মনের পশুরে কর জবাই/ পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’
নজরুল বলেছেন, পশু কোরবানি দাও। ভালো কথা। কিন্তু পশু কোরবানি সার্থক হবে তখন, যখন দেশ মুক্ত হবে। দেশকে শত্রুর শৃঙ্খলাবদ্ধ রেখে আজাদির পায়ে ডা-াবেড়ি রেখে পশু কোরবানির আনুষ্ঠাকিতার দরকার কী?
পশু কোরবানি তখন দিও যখন দেশ ও সমাজ মুক্ত হবে সাম্রাজ্যবাদ-জুলুম থেকেÑ ‘পশু কোরবানি দিস, তখন/ আজাদ-মুক্ত হবি যখন/ জুলুম-মুক্ত হবে রে দ্বীন’
যে পৃথিবীতে আজ আমাদের বসবাস, সে পৃথিবীতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ, জাতি, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, গোত্র, দল, মত, মাজহাব, তরিকা, অঞ্চলভেদে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানুষ। কিন্তু জালিমের কোনো বর্ণ, মত, দল ও রাজনৈতিক পরিচয় নেই। নিপীড়িতের কোনো দেশ, ভাষা, বর্ণ নেই। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিন্তু জালিম-মজলুমের লড়াই আজও অব্যাহত রয়েছে। সামগ্রিক মানবতাকে রক্ষা করতে হলে দরকার যে কোরবানির সে কোরবানির নাম স্বার্থত্যাগ, সে কোরবানির নাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সে কোরবানির নাম ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button