করোনাকবলিত বিশ্বে মুসলমানদের ঈদোৎসব

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঈদের সওগাত নিয়ে যে আনন্দ ব্যক্ত করে গিয়েছেন, তা চিরকাল মুসলিম হৃদয়কে আন্দোলিত করতে থাকবে। মাহে রমজানের শেষে খুশির ঈদ পূর্বেও এসেছে, ভবিষ্যতেও আসতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবারের ঈদুল ফিতর ও রমজানের সিয়াম সাধনা এবং জুম্মাবারগুলো বৈশ্বিক করোনা মহামারীর আগ্রাসী থাবার শিকার হয়েছে। হয়তো আসন্ন ঈদুল আযহা (কোরবানী ঈদ) ও হজ্জ্বের ক্ষেত্রেও একই দশা হবে।

দুনিয়ার প্রত্যেক জাতির মধ্যে আনন্দ মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন উৎসব প্রাচীন যুগ থেকেই বিদ্যমান। তাদের ন্যায় মুসলমানদের জন্যও দু’টি উৎসব দিবস ধার্য করা হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করলে সেখানে দেখতে পান যে, মদীনাবাসীরা দু’দিন আনন্দ উৎসব পালন করছে। তখন রসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জন্য দু’টি ঈদের দিন ধার্য করেছেন, একটি ঈদ-উল ফিতর এবং অপরটি ঈদ-উল আজহা। অন্যান্য জাতির উৎসব অপেক্ষা ইসলামের এই দুইটি দিন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অতি উত্তম। হিজরী দ্বিতীয় সালে রসূলুল্লাহ (সা.) এ মহান ঈদের কথা ঘোষণা করেন।
ঈদের বৈশিষ্ট্য শাশ্বত, এর আদর্শ শিক্ষা চিরন্তন এবং এর আবেদনও অনাবিল। অন্য কোনো ধর্মে ঈদের এই তাৎপর্য, বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য পরিলক্ষিত হবে না। ঈদের এই গৌরব কেবল মাত্র মুসলিম জাতির জন্য নির্ধারিত, মুসলমানগণই ঈদের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে এবং তারাই এর মৌলিক আদর্শ মূল্যায়ন করতে সক্ষম। এর শিক্ষা অনুসরণ করে তারা নিজেদের জীবনকেও সার্থক এবং সাফল্যমন্ডিত করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান বিশ্বে ঈদের যথার্থ আদর্শ কতটুকু গ্রহণ করা হচ্ছে? কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও লৌকিকতা ব্যতীত মুসলিম উম্মাহ ঈদের আদর্শ হতে বহুদূরে সরে গিয়েছে। আমাদের দেশেও দেখা যায়, আনুষ্ঠানিকতা প্রদর্শন ও অর্থব্যয়ের তীব্র প্রতিযোগিতার সাথে ঈদের আদর্শের কোনো মিল নেই। বরং ঈদের সাথে যোগ হয় ইসলামে নিষিদ্ধ অপচয় ও অন্যান্য শয়তানী কার্যকলাপের প্রতিযোগিতা। তাই সকলের উচিত, সত্যিকারের ঈদ আদর্শের অনুসরণ করা এবং অপচয় পরিহার করা।
ঈদের খুশি কজনই বা উপভোগ করছে! প্রতি বছর ঈদের আগমন মুসলিম মিল্লাতের পরম আনন্দের বিষয় একে স্বাগত জানাবার স্বাভাবিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় সর্বত্র। এই চিরাচরিত প্রথার অনুসরণ করতে আমরাও বাধ্য। রমজানের শেষে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় খুশির ঈদ ‘খোশ আমদেদ’।
আমাদের মধ্যে ক’জনই বা আছেন যারা অনুসরণ করেন ইসলামের সেই মহান শিক্ষা। ঈদের খুশি দুঃখী, দরিদ্র, বঞ্চিত, অসহায় মানুষ কখনো কি অনুভব করতে পারে? ভিক্ষা বিমুখ, দ্বীন সেবক অসংখ্য দরিদ্র অসহায় মুসলমান আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কারো কাছে হাত প্রসারিত করতে পারে না, তাদের সম্পর্কেই বা আমরা ক’জন অবগত? বস্তুত: বিত্তবান-ধনীদের প্রতি ধর্মীয় নির্দেশ ফিতরা-যাকাত ও অন্যান্য দান-খয়রাতের। পূর্ণ রমজান মাসের সিয়াম পালনে রোজাদারের কোনো ত্রু টি-বিচ্যুতি ঘটে থাকলে তা সংশোধন করে নেওয়ার জন্যই ফিতরা প্রথার প্রবর্তন হয়েছে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ যাকাত দানের বিধানটিও দেয়া হয়েছে প্রায় একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুসলিম জাতি আজ যাকাত দান করলেও প্রকৃত পক্ষে ঈদ আদর্শের মধ্যে যাকাত প্রথা কেবল আত্মিক ও নৈতিক উন্নতিই সাধন করে না, গরীব-দুঃখীদের আর্থিক অভাব-অনটনও দূর করার জন্য এই প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
মাহে রমজানের শেষে ঈদের প্রস্তুতি পর্বগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য পরিস্ফুট হয়ে উঠে। শাওয়াল মাসের ১ তারিখের ফজরের সময় হতে ‘সদকালতুল ফিতর’ বা ফিতরা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি প্রত্যেক মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশু, ছোট-বড়, আজাদ গোলাম, মুসাফির, রোজাদার, রোজা ভঙ্গকারী সকলের পক্ষেই আদায় করতে হয়। এমনকি কোন শিশু এই সময় জন্মগ্রহণ করলে তার ফিতরাও আদায় করতে হয়। তবে ঐ দিন ফজরের পূর্বে কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করে মারা গেলে তার ফিতরা আদায় করা লাগে না। এই ফিতরা আদায় করার নিয়ম হচ্ছে, ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করা সুন্নত। দুই-একদিন আগেও আদায় করা যেতে পারে। কেউ যদি ঈদের নামাজের পর ফিতরা আদায় করে তা সাধারণ সদকা রূপে পরিগণিত হবে। তবে ওয়াজেব সদকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদায় করা না হলে, পরে হলেও তা আদায় করতে হবে। এসব বিষয়ের বিশদ বিবরণ ফেকা গ্রন্থগুলোতে রয়েছে।
সদকাতুল ফিতর গরীব-আত্মীয় স্বজন, এতীম-মিসকীন, ভিক্ষুক, বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি স্তরের লোককে দান করতে হয়। যেসব লোক যাকাত পাওয়ার উপযোগী ফিতরাও তাদেরই প্রাপ্য। পবিত্র কোরআনে এরূপ আট শ্রেণীর লোকের উল্লেখ আছে। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজেব, অথচ সে তা আদায় করে না, তার রোজাগুলো আসমান ও জমিনের মধ্যখানে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে যায়।’ অর্থাৎ- আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয় না। সদকাতুল ফিতর প্রবর্তনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হচ্ছে, মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর সকল মুসলমানের ঈদের আনন্দে সমভাবে শরীক হওয়া। ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য দূর করে সকলের একই কাতারে শামিল হওয়া। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকলকেই ঈদের আনন্দ উপভোগ করার সমান অধিকার দেয়া। আর্থিক সঙ্গতির ব্যাপারেও যাকাতের ন্যায় কোনো শর্ত আরোপ করা হয়নি, কেবল যাকাত প্রাপকরাই ফিতরা পাওয়ার উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঈদের খুশি হতে যেন কেউ বঞ্চিত হতে না পারে সেজন্য ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রকে অত্যন্ত প্রশস্ত ও ব্যাপকতর করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সদকা গ্রহীতাদের সংখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত সংকুচিত। সদকার তাৎপর্য এখানেই পরিলক্ষিত হয় অধিক। সমাজের কিছু সংখ্যক লোক যারা সদকা প্রদান করতে সক্ষম নয়, তাদের সংখ্যা নিত্যন্তই কম। পক্ষান্তরে সদকা প্রদানকারীদেরকে বহু স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে এবং তাদের সংখ্যাই বিপুল। অবশ্য এটা ভিন্ন কথা যে, বর্তমানে আমাদের সমাজে অক্ষম গরীব নামধারী এক শ্রেণির সক্ষম বিত্তবান ব্যক্তি ও গরীব মিসকীনের বেশে, ভিক্ষুক সেজে প্রকৃত দুঃখী-গরীবদের ন্যায্য অধিকারে ভাগ বসাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিনা পরিশ্রমের এই পেশা ভালই চলছে। অবশ্য কে প্রকৃত দরিদ্র আর কে প্রকৃত দরিদ্র নয়, তা নির্ণয় করা কঠিন হলেও ছদ্মবেশী, কৃত্রিম লোকদেরকে চিহ্নিত করে প্রকৃত লোকদের মধ্যে তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব না হলে, নকল ফকিরদের উৎপাত বন্ধ হবে না। পরিণামে যারা সদকা, যাকাত আদায় করে থাকেন, তাদের সেই সদকা-যাকাতও উপযুক্ত পাত্রে না পৌঁছার আশংকা থেকে যায়। সম্ভবত আমাদের জাতীয় কবি এজন্যই বলেছেন:
‘যারা জীবন ভরে রেখেছে রোজা নিত্য উপবাসী
সেই গরীব এতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।’
ঈদের একটি বিরাট ও সুদূরপ্রসারী আবেদন হচ্ছে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ব্যাপক ঐক্য স্থাপন। সদকার মাধ্যমেও এই আবেদন অনেকটা পূরণ করা সম্ভব। তথাপি, আল্লাহর প্রতি সদকার মাধ্যমে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে জামাত সহকারে ঈদের নামাজ আদায় করার মধ্যেও একই উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। জামাত সহকারে নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদের পরিবর্তে ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়া মহানবী (সা.)-এর সুন্নত, তিনি সর্বদা ঈদগাহে নামাজ আদায় করতেন। একবার ভীষণ বৃষ্টির সময় ময়দানে গমন করা সম্ভব ছিল না বলে রসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদেই নামাজ আদায় করেছিলেন। এই একবার ব্যতীত তিনি আর কখনও মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি উভয় ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়তেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিপুল সংখ্যায় মুসলমানগণ যেন ঈদের নামাজের জন্য উপস্থিত হতে পারে। কেননা, মুসলিম ঐক্য ও সংহতি প্রকাশের জন্য এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু এবার সারা দুনিয়ার চিত্রটাই ভিন্ন, মহাতঙ্ক করোনাভাইরাস মহামারীর আকারে ভীষণভাবে গোটা বিশ্বকে অব্যাহতভাবে গ্রাস করে চলেছে। কবে এর কবল থেকে বিশ্বাবাসী মুক্তি লাভ করবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। সুতরাং এবারের ঈদ উৎসব মুসলমানদের জীবনে আনন্দ নয়, বিষণে্ণর ছাপ নিয়েই আসছে।
কিছুটা পুনরাবৃত্তি করে বলতে হয় ঈদের গোটা উৎসবটাই হচ্ছে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আনন্দের সাথে ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ-সাম্য, মুসলিম ঐক্য-সংহতি এবং মানবতাবাদ তথা মানব কল্যাণের এক অপূর্ব নিদর্শন। সদকা, যাকাত, দান-খয়রাত, ঈদের খোতবা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ করলে মুসলমানের ঈদোৎসবের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। ঈদের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে অন্যান্য জাতির আনন্দ-উৎসবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলামের পূর্বে আরবে প্রচলিত আনন্দ-উৎসবের পরিবর্তে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ঈদ নির্ধারণের ঘটনাই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বিশ্ববাসী করোনা মহামারীর শিকার। এ মহা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহান আল্লাহর শরানাপন্ন হওয়া ব্যতীত গত্যন্তরনেই। বিশেষভাবে দুনিয়ার সকল মুসলিম সমাজকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে না পারায় মাতম না করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে এ বিপদ মুক্তির জন্য দোয়া-মোনাজাত করতে হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button