যেসব কারণে হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

১৯১৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে বলকান অঞ্চলে এই যুদ্ধের সূচনা হয়, শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ কী ছিল তা এখনো একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে রয়েছে। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে বলকান অঞ্চলে এই যুদ্ধের সূচনা হয়। আর শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর বেলা ১১টায়। এ যুদ্ধে নিহত হয় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ এবং আহত হয় দুই কোটি। পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশ থেকে ১৩ লাখ সৈন্য ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। তার মধ্যে নিহত হয় ৭৪ হাজার।

১৯১৪ সালে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদের কারণ নিয়ে বিশ্লেষকরা গবেষণা চালিয়েছেন। এই যুদ্ধে একপক্ষে ছিল জার্মানি ও আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য এবং অন্যপক্ষে ছিল রাশিয়া, ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন। গবেষকরা এই যুদ্ধের পেছনের রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক-সামরিক দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো, জোট ও মিত্রতার জটিল যোগসূত্র, সম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং উসমানি সম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার কারণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেসব বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।

এ ক্ষেত্রে আর যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খতিয়ে দেখা হয় তা হলো- অমীমাংসিত ভূখণ্ডগত বিরোধ, ইউরোপে ভারসাম্য বিধানকারী শক্তির পতন ঘটতে যাচ্ছে এমন ধারণা, শাসনব্যবস্থার জটিলতা ও ভঙ্গুরতা, কয়েক দশক ধরে চলা অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং সামরিক পরিকল্পনা। বিশ্লেষক ও গবেষকরা এই যুদ্ধে স্বল্পমেয়াদি কারণও বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলেছেন, ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মের ঘটনাটির ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হলে এ যুদ্ধ এড়ানো হয়তো সম্ভব হতো, অন্যথায় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসের সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রনায়ক ও জেনারেলরা তাৎক্ষণিক যে সিদ্ধান্ত নেন, তার মধ্যেও যুদ্ধের কারণ নিহিত রয়েছে। একজন বসনীয় সার্ব জাতীয়তাবাদী অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফারনান্দকে হত্যা করে। সার্বিয়ার একটি সার্ব জাতীয়তাবাদী সংগঠন তাকে সমর্থন করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মধ্যে এ যুদ্ধে ক্রমে রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স এবং অবশেষে বেলজিয়াম ও গ্রেট ব্রিটেনও জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর জার্মানি ও উসমানি সাম্রাজ্য একটি জোট গঠন করে। যেসব কারণে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়-

কূটনৈতিক ব্যর্থতা: এ যুদ্ধের জন্য দায়ী অন্য কারণগুলো হলো- কূটনৈতিক সঙ্কটের সময়ের ঘটনাবলী। এর মধ্যে ছিল, উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তি (যেমন জার্মানি মনে করেছিল ব্রিটেন এ যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকবে), যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি যা অবশ্যম্ভাবী ঘটে থাকে এবং কূটনৈতিক বিভ্রান্তি ও যোগাযোগের অভাবে সঙ্কট দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

ইউরোপীয় ও উপনিবেশ নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর (ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া) মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ১৯১৪ সালে এসে তাদের মধ্যকার উত্তেজনাকে ব্যাপক বাড়িয়ে তুলেছিল। ১৮৬৭ সাল থেকে ইউরোপে শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন সরকারগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে কোনো মতৈক্যে পৌঁছা আজো সম্ভব হয়নি। কারণ প্রধান প্রধান বিষয়ে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করছেন। গোপন ঐতিহাসিক তথ্যপ্রাপ্তিতে বিলম্বের কারণে সময়ের ব্যবধানে যুক্তির পরিবর্তন ঘটেছে। কেউ কেউ জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পদক্ষেপকে প্রধান কারন বলছেন। তারা বলছেন, জার্মানি পরিকল্পিতভাবে ইউরোপীয় যুদ্ধে ছক তৈরি করেছিল। অন্যরা বলছেন, এ য্দ্ধু কোনো পরিকল্পিত লড়াই ছিল না। তারা আরো বলেছেন, জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এ যুদ্ধের ঝুঁকির কারণ ছিল। তবে রাশিয়া, ফ্রান্স, সার্বিয়া ও গ্রেট ব্রিটেনের ভূমিকাকেও এ যুদ্ধের কারণ বলে মনে করছেন তারা।

পারস্পারিক সন্দেহ ও জোট গঠন: ১৯১৪ সালের ২৮ জুন গ্যাবরিলো প্রিন্সিপ ফ্রাঞ্জ ফারনান্দকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়। এরপর কয়েকটি দেশ পরস্পরকে সহায়তা করার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরা মিত্র দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যুদ্ধের চার বছরে অনেকগুলো দেশ কয়েকটি জোট গঠনের চুক্তি করে। এতে কোন কোন দেশের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষনা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

রাশিয়ার হাত থেকে বাঁচতে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ১৮৭৯ সালে জোট গঠন করে। সার্বিয়ার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে ১৮৮১ সালে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়া একটি জোট গঠন করে। ইতালি যাতে রাশিয়ার পক্ষ না নেয় সেজন্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি দেশটির সাথে জোট গঠন করে ১৮৮২ সালে।

১৯১৪ সালে রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স পৃথকভাবে শান্তিচুক্তি না করার একটি চুক্তি করে। রাশিয়া নিজেকে জার্মান-অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির হামলা থেকে রক্ষা পেতে ফ্রান্সের সাথে একটি চুক্তি করে ১৮৯৪ সালে।

জার্মানি ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া ১৯০৭ সালে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে।
একই বছর ব্রিটেন ও রাশিয়া একটি মিত্রতার চুক্তি করে। এরআগে ১৯০৪ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স একটি চুক্তি করে তবে তা কোন গঠনের চুক্তি ছিল না।

সাম্রাজ্যবাদ: কোন দেশ যখন অন্যদের ভুখন্ড দখল করে সেখানে তাদের নিজস্ব শাসন চালু করে তখন দেশটি সম্রাজবাদে পরিণত হয়। ১৯০০ সালে ব্রিটেনের সম্রাজ্য পাঁচটি মহাদেশ পর্যন্ত সমপ্রসারিত হয। ফ্রান্স আফ্রিকার বিশাল এলাকা শাসন করে। শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশগুলোর বাজার সম্প্রসারন জরুরী হয়ে পড়ে। এনিয়ে জার্মানির সাথে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয। জার্মানি সম্রাজ্য বিস্তারে আফ্রিকায় প্রবেশ করে কিন্তু তারা ছোট কিছু এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়।

সমরবাদ: এ যুদ্ধের আরেকটি কারণ ছিল সমরবাদ। ইউরোপের শক্তিগুলোর বিভক্তি সেখানে ব্যাপক অস্ত্রপ্রতিযোগিতার সুত্রপাত ঘটে। ফ্রান্স ও জার্মানি উভয়েই ১৯৭০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তাদের সেনা সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে। সাগরে নিয়ন্ত্রণ দখলে ব্রিটেন ও জার্মানি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে। উভয়ে যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে।

জাতীয়তাবাদ: আরেকটি কারণ ছিল জাতীয়তাবাদ। নিজ দেশের অধিকার ও স্বার্থকে সর্বোচ্চ অধিকার দেয়া হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। ইউরোপের দেশগুলো নিজেদেরকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ট বলে দাবি করতে থাকে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button