গোয়েন্দা প্রতিবেদন

করোনা শনাক্তের সক্ষমতা নেই ওসমানী বিমানবন্দরের

সরকার স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। সরকারের দাবি, রোগ শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়িয়েছে তারা। কিন্তু খোদ তাদেরই একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, করোনা শনাক্তে সক্ষমতা নেই সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। গত সপ্তাহে করা সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে সিলেট ওসমানী বিমান বন্দরের করোনাভাইরাসের এ ঝুঁকির কথা ওঠে এসেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চট্টগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে শুধু থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিকে শরীরে তাপমাত্রা পরিমাপের মাধ্যমে রোগ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার সচল নেই। যার কারণে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কারণে যেকোনো মুহূর্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ‘কোভিড-১৯’ রোগী বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে ওই বিমানবন্দর দিয়ে।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বিষয়ে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্টেশন ম্যানেজার হাফিজ আহমেদ বলেন, বিমানবন্দরের স্ক্যানার মেশিনটি গত দেড় বছর ধরে নষ্ট। সেটা সচল করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তা এখনো ঠিক করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাস নির্ণয় করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে, করোনাভাইরাস চিহিুতকরণে এই মুহূর্তে থার্মাল স্ক্যানার না বসিয়ে নিরাপত্তার জন্য সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্প্রতি বসানো হয়েছে শরীর তলস্নাশি মেশিন বা বডি স্ক্যানার। জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) দেওয়া বডি স্ক্যানার ইতোমধ্যে বিমানবন্দরে বসানো হয়েছে। যদিও মেশিনটির কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ও দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি। এটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক জেনারেল ওসমানীর নামানুসারে নামকরণ করা হয়। তার আগে এর নাম ছিল সিলেট বিমানবন্দর।

উইকিপিডিয়ার তথ্যনুসারে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আবুধাবি, দোহা, দুবাই, লন্ডনের হিথ্রো ও জেদ্দা থেকে সিলেটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে। এছাড়া অন্যান্য বেসরকারি বিমান সংস্থা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে। বিমানবন্দরটি বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত ও বাংলাদেশের জাতীয় এয়ারলাইন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্যও ব্যবহৃত হয়। বেসরকারি বিমান সংস্থা নভোএয়ার, ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সিলেট থেকে ঢাকায় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে। বিমানবন্দর ব্যবহার করা যাত্রীদের অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি এবং যুক্তরাজ্যে বসবাস করা সিলেট বিভাগের লোকজনের বংশধর।

এদিকে সরকার স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। রোগ শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়িয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সুনির্দিষ্ট দুটি হাসপাতাল ছাড়াও সব সরকারি হাসপাতাল আলাদা ইউনিট খুলেছে। কিন্তু কৌশল হিসেবে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে রোগীকে শনাক্তকরণ ও তাদের আলাদা করার ওপর।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে মঙ্গলবার চীনকে হাত মোজা, মাস্কসহ বাংলাদেশে উৎপাদিত ছয় ধরনের উপকরণ দিয়েছে বাংলাদেশ। চীনও বাংলাদেশকে কোভিড শনাক্ত করার কিটস বা উপকরণ দিচ্ছে। এগুলো দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। অন্যদিকে, সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির মধ্যে একজনের অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশন বলেছে, ওই ব্যক্তির ফুসফুসে গুরুতর সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।

চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার ১ ফেব্রম্নয়ারি ৩১২ জন বাংলাদেশিকে চীনের উহান থেকে ফেরত আনলেও বাকি ১৭১ জনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত এদের ফেরত না আনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগের ৩১২ জনকে ফেরত আনা উড়োজাহাজের পাইলট ও ক্রুদের কিছু দেশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক আছেন। অন্যদিকে ২৩-২৭ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি ওয়ার্ল্ড র?্যাংকিং আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২০’ স্থগিত হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় চীনের ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের কী প্রস্তুতি, তা জনগণকে অবহিত করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক। মঙ্গবার তিনি পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে এখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়ে সারা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। কোনো কারণে দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কী উপায়ে মোকাবিলা করা হবে, সরকারের কী প্রস্তুতি, মানুষ জানে না। মানুষ বিভ্রান্তিতে আছে। তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়গুলো অবহিত করে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়ার দাবি জানান।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন ‘বন্দরে স্ক্যানার আছে ঠিকই। কিন্তু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রোগের লক্ষণ প্রকাশ না পেলে স্ক্যানারে কিছু ধরা পড়বে না। আক্রান্ত ব্যক্তির দেশে ঢুকে পড়াও তাই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।

মীরজাদী সেব্রিনা আরও বলেন, জোর দিচ্ছি দ্রম্নত রোগী শনাক্তকরণের ওপর। স্বাস্থ্য কার্ড ও স্ক্যানারের মাধ্যমে শনাক্তকরণের চেষ্টা চলছে। সেখান থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনের রক্ত বা লালার নমুনাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এখনো কেউ শনাক্ত হয়নি। শনাক্ত হলেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে বা বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

আইইডিসিআর সূত্র জানিয়েছে, আইইডিসিআরের ল্যাবরেটরিতে দুই-তিন ঘণ্টায় করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার ফল পাওয়া যাচ্ছে। আরও কম সময়ে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ মিনিটে শনাক্ত করার প্রযুক্তিও শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটির কাছে আসবে। এ ব্যাপারে মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই, এমন কিট বা প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করব না।

আইইডিসিআর জানিয়েছে, তারা এ পর্যন্ত ৭৪ জনের (তিনজন চীনা নাগরিকসহ) রক্ত বা লালার নমুনা পরীক্ষা করেছে। কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। আশকোনার কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়া পাওয়া ৩১২ জনও সুস্থ আছে।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক জরুরিভিত্তিতে করোনা ভাইরাস দেশে প্রবেশ ও আক্রান্ত প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বিমানবন্দরসমূহে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ডেস্কে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রযোজনীয় স্বাস্থ্যকর্র্মী সার্বক্ষণিক উপস্থিত থেকে চীন থেকে আসা সরাসরি ৩টি ফ্লাইটসহ সন্দেহভাজন অন্যান্য ফ্লাইটের সব যাত্রীর নিবিড়ভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। এবং প্রত্যেকেই আশকোনা হজ ক্যাম্পের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে কমপক্ষে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। করোনাভাইরাসের লক্ষণ এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ এবং গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সব স্থল ও নৌ ইমিগ্রেশন চেকপোস্টগুলোতে আগত যাত্রীদের যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এমন গুজব বা বিভ্রান্তে কান না দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণসহ পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়. স্বাস্থ অধিদপ্তর ও সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থকেন্দ্রগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারের উদ্যেগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরসমূহে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে অজ্ঞাত জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে। ৩১ ডিসেম্বর বিজ্ঞানীরা জানান, একেবারে নতুন একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে এই জ্বর হচ্ছে। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে চীনে মৃত্যুর সংখ্যা এখন ২ হাজার ৪ শ’ ৪৫ জন। আর সংক্রমিত হয়েছেন ৭৬ হাজারের বেশি মানুষ। চীনের বাইরে ৩২টি দেশে আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button