৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার ভোটের বাজেট পাস

Abul Malযে ভ্যাটের ওপর ভর করে চার লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের হিসাব অর্থমন্ত্রী সাজিয়েছিলেন, ব্যবসায়ীদের বোঝানোর ব্যর্থতায় তা বড় ধাক্কা খাওয়ায় ঘাটতি সামলে বাজেট বাস্তবায়ন তার জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। খবর বিডি নিউজ
তারা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে রাজস্ব ঘাটতি পূরণে সরকারের সামনে করজাল সম্প্রসারণের বিকল্প থাকবে না। আর সেই চাপ সামাল দিতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে।
এ বিষয়ে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পরামর্শ, কর আদায় আরও সহজ করে এর আওতা বাড়াতে হবে। যারা বিদ্যমান কাঠামোতে করযোগ্য হয়েও তা দিচ্ছেন না, তাদের করজালে আনতে হবে। তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
বাজেট আলোচনায় সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা পাওয়া যায়নি। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ফোন না ধরায় তার ভাবনাও জানা যায়নি।
চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব অপরিবর্তিত রেখেই বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। সেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ অংকের হিসাবে বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসবে বলে ধরা হয়েছে।
গত বছরের ভ্যাট আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে নতুন বাজেটের ওই লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার পরিকল্পনা ছিল, ২০১২ সালের ভ্যাট আইন ১ জুলাই থেকেই কার্যকর হবে এবং তার ফলে পণ্য বিক্রি ও সেবায় অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে।
এই ভ্যাট আইন ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের প্রবল বিরোধিতায় তা এক বছর পেছানো হয়। এবার মুহিত অটল থাকার কথা বললেও বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা এবং নির্বাচনের দেড় বছর আগে ভোটের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে শেষমেশ সরকার পিছু হটে।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে মুহিত তার অর্থবিলে সংশোধনী আনেন; ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন ঝুলে যায় অন্তত দুই বছরের জন্য।
কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, বড় অংকের ভ্যাট আদায়ের পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে কীভাবে। আর মুহিতের ভাষায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেটইবা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে।
বিদায়ী অর্থবছরে ভ্যাট থেকে ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেও তা আদায় করতে না পেরে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সংশোধিত লক্ষ্য ঠিক করা হয়। আর আগামী অর্থবছরে তার চেয়েও ৩৩ শতাংশ বেশি, অর্থাৎ ৯১ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট বাবদে আদায় করতে চাইছে সরকার।
সবক্ষেত্রে অভিন্ন ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করতে না পারলে বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাটের মাধ্যমে ওই লক্ষ্য কতটুকু পূরণ করা সম্ভব?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, ওই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব না।
তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই হয়তো গত বছরের চেয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় হবে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই, এ রকম আরও প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা গেলে সেখান থেকে হয়তো আরও ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে।
কিন্তু তারপরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির হিসাব মেলে না। সে কারণে এবারও বাজেট সংশোধনের সময় আকার ছোট করতে হবে বলে মনে করছেন মির্জ্জা আজিজ।
সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন বলছেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীরা যেভাবে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিল- তা কাক্সিক্ষত নয়। তার বদলে বুধবার যেভাবে ভ্যাট বিতর্কের সমাপ্তি টানা হয়েছে, তা তিনি সন্তোষজনক বলেই মনে করছেন।
তবে তিনি এও বলেছেন, মূসক আইনটি মানুষকে আমরা বোঝাতে পারলাম না, এটা ব্যর্থতা।
বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে এক লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে এনবিআর আদায় করতে পেরেছে এক লাখ ৪২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কম হলেও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
গত দু-তিন মাসে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন ফরাসউদ্দিন।
সেক্ষেত্রে ভ্যাট আইন কার্যকর না করে পুরনো ভ্যাট কাঠামোতে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে?
এ প্রশ্নে ফরাসউদ্দিনের উত্তর- আগের ভ্যাট আইন আছে, সেটা দিয়ে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। নতুন আইনে অনেক ছাড় দেয়ার বিষয় ছিল। সেটা থাকবে না। সরকারকে নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করে আদায় বাড়াতে হবে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দেশে কর শনাক্তকরণ নাম্বারধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ২৮ লাখের বেশি। বাস্তবে করযোগ্য মানুষের সংখ্যা কোটির বেশি। কিন্তু কর দেন ১২ থেকে ১৪ লাখ মানুষ। অর্থাৎ, এখানে কর আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করছেন, ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ২০ শতাংশ থেকে এক বছরে ৩৩ শতাংশে নিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যেতে বাধ্য।
এবার বাজেটে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছে, যা মেটানোর জন্য বৈদেশিক ঋণ, অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র থেকে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা (সাত বিলিয়ন ডলার) সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছেন মুহিত।
কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই তিন, সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে টাকা পেলেও এক বছরের মধ্যে সাত বিলিয়ন ডলার ব্যবহার করে ফেলবে, এটা আশা করা দুরূহ, বলেন মোয়াজ্জেম।
এজন্য ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়ে সরকারকে ব্যাংক ঋণের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সংসদে বাজেট পাস
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জাতীয় সংসদে ৫৫ ঘণ্টা আলোচনার পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট সংসদে পাস করা হয়েছে।
বুধবার জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে নির্দিষ্টকরণ বিল পাসের মাধ্যমে এ বাজেট পাস করা হয়।
গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বাজেট পেশ করেন। নির্দিষ্টকরণ বিল-২০১৭ সংসদে গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই বাজেট পাস করা হয়।
বাজেট পাসের প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নির্বাহের যৌক্তিকতা তুলে ধরে মোট ৫৯টি মঞ্জুরি দাবি সংসদে উত্থাপন করেন। এই মঞ্জুরি দাবিগুলো সংসদে কণ্ঠভোটে অনুমোদিত হয়।
প্রধান বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা মঞ্জুরি দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে মোট ৩৫২টি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর মধ্যে ৫টি দাবিতে আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সদস্যরা আলোচনা করেন। পরে কণ্ঠভোটে ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়ে যায়।
এরপর সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়িয়ে নির্দিষ্টকরণ বিল-২০১৭ পাসের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করেন।
গত ৫ জুন থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও অন্য মন্ত্রীসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা মূল বাজেট ও সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা যা জিডিপির ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা যা জিডিপির ১১ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা যা জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা যা জিডিপির ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিবি) ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ১০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। এর ফলে এডিপির মোট আকার হলো ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা যা জিডিপির ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাজেটে সার্বিক বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা যা জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা যা জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা যা জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকার সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেটে মোট বরাদ্দের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ, জনপ্রশাসন খাতে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, সুদ প্রদান খাতে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, প্রতিরক্ষা খাতে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, কৃষি খাতে ৬ দশমিক ১ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৬ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস খাতে ১ শতাংশ, বিবিধ ব্যয় খাতে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বাজেটে পদ্মা সেতু, একটি বাড়ি একটি খামারসহ দশটি মেগা প্রকল্প তথা যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button