আমি ‘লাঙ্গল টু লন্ডন’ আমলের এক লন্ডনির ছেলে

Kutubকুতুব আফতাব:  ৯০ দশকে যখন ইংল্যান্ড আসি তখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে অনেক কথার কথা প্রচলন ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক, বিভিন্ন পেশা ও চরিত্রভিত্তিক, এমনকি কে কিভাবে বিলেত এসেছেন তারও কিছু নেতিবাচক ডাকনাম বা নিকনেইম ছিল।
আমার এইসব নিকনেইম খুব বাজে লাগত। এক ধরনের সংকীর্ণতা ও রেষারেষি মনে হত আমার কাছে। আমি সিরিয়াস হয়ে প্রতিবাদ করতাম। আমরা সবাই বাংলাদেশি বাঙালি। নিজের মধ্যে বিভেদ নয়, প্রবাসে এক হয়ে চলা্টাই আমাদের জন্য অতীব জরুরী। খেয়াল করতাম আমার মত নতুন বিলেতে আসা অনেকেই এই বিষয়টি অপছন্দ করেন। তখন মনে মনে আশান্বিত হতাম।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন পন্থায় অনেক নতুন বাংলাদেশি লোক বিলেতে আসলে অতীতের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসতে শুরু করল। দেশীয় রাজনীতির প্রভাব একটু বাড়তে শুরু করলেও জীবন বাস্তবতা মোকাবেলায় ছোট ছোট বিষয়গুলা ম্লান হয়ে উঠল এবং শিল্প সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে শুরু হল। বিরাট বিরাট হল ভাড়া করে জমকালো আয়োজনে নাটক, সংগীতানুষ্ঠান শুরু হল বিলেতের বিভিন্ন শহরে। এসব ইভেন্টের প্রমোটার এবং দর্শকের বড় অংশ সিলেটি হলেও শিল্পী কলাকুশলী হলেন বাংলাদেশের সকল এলাকার। এতে সিলেটি অধ্যুষিত বিলেতের বাঙালি কমিউনিটিতে সামগ্রীক বাঙালী চেতনার উন্মেষ ঘটে। পাশাপাশি দেশীয় ওয়াজীদের আনাগোনাও বাড়তে শুরু করে। মানুষ উভয় সংস্কৃতিকে গ্রহন করতে লাগল।
দেশজ চেতনা প্রসারিত হতে লাগল দ্রুত গতিতে। বাংলা পেপার পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশনের প্রতিষ্টায় আশার সঞ্চার হল মিডিয়ায় জড়িতদের। সিলেটের প্রতিষ্ঠিত প্রবাসীরা দেশীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি রক্ষায় ব্যাপক ভুমিকা রাখতে সচেষ্ট হলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে  নিশ্চিত লোকসান জেনেও তারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় টাকা খাটাতে লাগলেন। এতে প্রমিত বাংলায় কথা বলা লোকদের চাকুরির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হল। সিলেটি ননসিলেটি ভাবনার দুরত্ব কমে আসলো।
এর সাথে সাথে তৃতীয় প্রজন্ম বেড়ে উঠল, এদের বেশির ভাগের সিলেটি মা-বাবার সন্তান হলেও এরা সিলেটি চেতনা ধারন করে না,তারা জানে সিলেট শুধু বাপদাদার জন্মভুমি আর ইংল্যান্ড তার নিজ দেশ। কিন্তু মাবাবার সচেতনতার কারণে তাদের শিকড় যে বাংলাদেশে সেটা ভাবতে শিখে। তারা লেখাপড়ায় তুমুল অগ্রসর হতে শুরু করে। বিলেতে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রতিযোগীতায় তারা জয়ী হতে আরম্ভ করে। এতে পুরনো মানুষের দেশমুখীতার পরিবর্তন শুরু হয়।
সিলেটি লোক প্রজন্মকে চিন্তার স্পেস দিতে শুরু করল। প্রত্যেকটি পরিবারে শিক্ষার প্রতিযোগিতা লেগে গেল। চিন্তা চেতনার ব্যাপক পরিবর্তনে একটা সরল জীবনধারা চলে আসল বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। সিলেটি নন সিলেটি বিদ্বেষী ভাবনার অবসান হতে শুরু করল। কাজ-কর্ম, চলাফেরায় মধুর ভাব, সিলেটি ননসিলেটির মধ্যে আত্মীয়তা পর্যন্ত শুরু হল।
দুই হাজার সালের পরে স্টুডেন্টদের ব্যাপক আগমনে কমিউনিটিতে নন সিলেটিদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। বিলেতের মিডিয়াতে তাদের বলিষ্ঠ অবস্থান, শিল্প সাহিত্য চর্চায়, ব্যাপক ভুমিকায় সিলেটি ননসিলেটি বাদ দিয়ে একটি শৈল্পিক বাংলাদেশি মানসিকতার ঐক্য গড়ে উঠে। যা ব্যাপক আশার আলো দেখায়। এখন এই সরল ধারায় চলছে বিলেতে বাংলাদেশি কমিউনিটি।
এবার আসি মুলকথায়। বিলেতের একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে  আড়াই ঘন্টার লাইভ অনুষ্ঠানে বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনায় পালন করা হল অমর একুশের গানের রচয়িতা গাফফার চৌধুরীর ৮২তম জন্মদিন । আর এই অনুষ্ঠানের লাইভ বক্তৃতায় গাফফার চৌধুরী সেই প্রথম বিলেতে এসে শুনা অনেক স্থুল কথার একটি “লাঙ্গল টু লন্ডন” এর হাস্যকর অপ্রচলিত কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করে পুরনো বিদ্বেষ স্মরণ করিয়ে দিলেন আর আমাকে দারুন আশাহত করলেন। আমি কোন জীবন্ত কিংবদন্তির কাছে প্রত্যাশা করি না যে তিনি কোন বিদ্বেষযুক্ত শব্দে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।কারণ এমন মানুষের কথা হবে প্রজন্মের জন্য রেফারেন্স কিংবা কোটেশন।
গাফফার চৌধুরী কেন এমন অপ্রয়ীজনীয় কথাগুলো বলতে গেলেন? ভুলে যাওয়া ইস্যু মনে করিয়ে দিয়ে কি মহান হলেন তিনি?
আমার মতে তিনি শুধু রেখে গেলেন তিন দশক আগের নিজেদের মাঝে হাসি ঠাট্টার স্থুল প্রবাদের লাইভ রেকর্ডেড রেফারেন্স।
বক্তব্যে তিনি অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সিলেটি আর নিজেকে শিক্ষিত বলে বিভাজনের চরম চর্চা করেছেন। কিছু মানুষের নাম উল্লেখ করে সমালোচনা করেছেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
আমি জানাতে চাই, আমি গাফফার চৌধুরীর ততাকথিত লাঙ্গল টু লন্ডন আমলের এক লন্ডনীর ছেলে। আমার কাছে লুৎফুর রহমান কিছু নয়, বেলাল পাশা কিছু নয়, আবু তাহের সিংকাপনি কিছু নয়। কিন্তু আমার বাবা আমার কাছে একশজন গাফফার চৌধুরী থেকে শ্রেষ্ট।
আমার অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বাবা চাচারা শত শত শিক্ষিত অসহায় বাংলাদেশিদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন, বরফঢাকা ইংল্যান্ডে গায়ে তুলে দিয়েছেন গরম কাপড় আর নিজের বিচানা ছেড়ে অসহায় শিক্ষিতদের দিয়েছেন মাথা গুজার ঠাই। আমার বাবা চাচারা পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিক্ষিত কারণ তাঁরা জানতেন কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় দেশ স্বজন আর মানবতার জন্য।
যে আলতাব আলীর রক্তস্নাত মাটিতে গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার, যেখানে দাঁড়িয়ে গাওয়া হয়, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি সেই আলতাব আলীকে কোথায় নিলেন এক রচনায় অমর হওয়া গাফফার চৌধুরী?
যারা গাফফার চৌধুরী নামে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ায় তাদের পুর্বপুরুষদের তোতা পাখির মত বারবার অশিক্ষিত বলে কি রুচিটা তিনি দেখালেন?
বাংলা ভাষার এত বড় রক্ষক হলেন তিনি!
আমরা সিলেটিদের সন্তান বিলেতে যখন স্বপ্ল বিদ্যা অল্প জ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের জন্য কাজ করে যাই তখন কোথায় গাফফার চৌধুরীর সন্তানরা? আমি পুর্বলন্ডনের শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আপনার সন্তানদের সাথে নিয়ে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গানটি গাওয়ার দুই সেকেন্ডের  একটি ভিডিও ক্লিপ দেখতে চাই। দেখতে চাই বাংলা ভাষার কেমন পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছেন তাদেরকে।
জনাব চৌধুরী আমরা অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সিলেটিদের সন্তানরা আপনাকে বাহবা দেই, হাততালি দেই, সমবেত সুরে গাই আপনার লেখা গান। গান গেয়ে গেয়ে নিজেদের  মাঝে হাতাহাতি লাঠালাঠি করি। অপবাদ নেই, লজ্জা নেই। আমরা প্রমাণিত ভক্ত আপনার।
জনাব গফফার চৌধুরী লুৎফুর রহমানের পতনে আপনার ভুমিকাটা কি? লুৎফুর রহমানকে মেয়র বানিয়েছিল মেইনষ্ট্রিম ইংরেজ সমাজ সাথে ছিল বাংলাদেশী কমিউনিটি। তাঁরাই পতন ঘটিয়েছে আর সাহস করে প্রতিবাদী হয়েছিল সিলেটী অশিক্ষিতের বীর সন্তানরা। আপনি নন। এতে লুৎফুর রহমান তাঁর ভুলের মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু পিছিয়েছে বাংলাদেশী কমিউনিটি। আপনি তাতে খুশি হলেও আমরা নিরাশ।
আপনার কি? আপনি তো রেডিমেইড কমিউনিটির আজীবন সুবিধাভোগী। যা আপনার বক্তব্যে লুকাতে পারেননি। আমাদের খুব লাগে। কারণ  আমরা নিজের চিন্তা করি, করি প্রজন্মের চিন্তা।
পুর্ব লন্ডন যদি জামাতীদের আখড়া হয় তাহলে এত সব মুক্তমনা আর প্রগতিবাদীরা কি এতদিন ঘোড়ার ঘাস কাটছিলেন? ধর্ম ব্যবসায়ীরা যখন ঐক্যের মধুর রাগিণী বাজিয়েছে, প্রগতিবাদীরা তখন ক্রমাগত বাজিয়ে গেছেন ভাঙ্গনের বীণ। তারা যখন লক্ষ পাউন্ড লাগিয়ে দিয়েছে দল পাকানোতে, অন্যরা তখন সভা সমাবেশে যাওয়ার তেলখরচের হিসেবে ব্যস্ত। নিজের ব্যার্থতা অপারগতা স্বীকার করতেই হবে।
সরল কমিউনিটির উপর শুধু ডিভাইড এন্ড রুলের সর্বনেশে মন্ত্র ফুঁকেছে স্বার্থান্বেষী চক্র। কারণ কমিউনিটি যত বেশী বিভক্ত হবে তাদের তত লাভ।
লুৎফুর রহমানের পতনে আপনি এত উল্লসিত! আমি বলি শুনুন, চৌধুরী মইনুদ্দিনকে পারলে কিছু করেন তো। কি করলেন আপনি এতটা বছর? আপনি কলম ধরেন, পিক এন্ড  চোজ করে। কেন? আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা বৃহৎ ছিল। কিন্তু হতাশ করেছেন আপনি।
আমি পরিস্কার বলি পুর্বলন্ডন আজীবন শিল্প সংস্কৃতিপ্রেমীদের নিয়ন্ত্রনে ছিল আছে থাকবে। প্রতিবছর বাংলাদেশের বাহিরে সবচেয়ে বড় বাঙালীদের মিলন মেলা এই পুর্বলন্ডনেই বসে। দলাদলীর শক্তিতে কে শক্তিশালী আমি তা জানিনা কিন্তু শাশ্বত বাঙালী সত্তার শক্তিতে পুর্বলন্ডন তথা এই বিলেতে আমরা শক্তিশালী। পুর্বপুরুষের রক্তঘামে প্রতিষ্ঠিতা বাংলা টাউনকে খারাপ ইমেজ দিবেন না। এটা আমাদের অহংকার। এর পরতে পরতে সেঁটে আছে আমাদের প্রাণের বর্ণমালা।
জনাব গাফফার চৌধুরী আপনাকে হয়ত জন্মদিনের আনন্দঘন মুহুর্তে বিলেতের অভিজ্ঞতার ইতিহাস বলতে বলা হয়েছিল। আপনি কি ইতিহাস বলেছেন?
গীবত আর বিদ্বেষ বিভাজন  রপ্ত করেছেন। আমরাই যেখানে কনফিউজড সেখানে আগামী প্রজন্ম কি উদ্ধার করবে  আপনার এই বর্ণনা থেকে?
আমি জানিনা আপনি প্রভাবিত ছিলেন, না উদ্দেশ্যমূলক শুধু বলে গেছেন সিলেটীদের দুর্বল দিকগুলো। আপনি একদিকে করে গেছেন চপেটাঘাত আবার অন্যদিকে বুলিয়ে গেছেন শান্তনার হাত। কি প্রয়োজন ছিল এটার?
আপনি চাইলে মধুরক্ষণে মধুর করে তুলতে পারতেন স্মৃতিচারণা।
পরিশেষে আপনার মত করে বলি, আপনি যেমন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীরলীগকে ভালবাসেন কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সমালোচক মনে করেন নিজেকে, আমিও হয়ত আপনাকে ভালবাসি কিন্তু আপনার অনেক বড় সমালোচক। তাই প্রতিপক্ষ বা বিদ্বেষী ভাববেন না।
প্রসঙ্গত একট ঘটনা স্মরণ করতে চাই, সিলেটিদের হেয় করে বিলেতে সর্বপ্রথম আলোড়ন তুলেছিলেন, মাওলানা সাঈদী। ওল্ডহামে কুইন এলিযাবেথ হলে তিনি বলেছিলেন, সিলেটীরা লন্ডন না আসলে রিক্সা চালাত না হয় বড়জোর বাস ড্রাইভার হত।
আমার বাল্যবন্ধু সাংবাদিক শাহজাহান ফেটে পরেছিল প্রতিবাদে। সাপ্তাহিক নতুন দিনে হেডলাইন রিপোর্ট করেছিল। তার খেসারত দিয়েছিল সে। লাঠি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়েছিল সাঈদী ভক্তরা।
শেখ হাসিনা বিলেত আসলে তার সাহসীকতার জন্য লন্ডনে ডেকে নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন পরবর্তীতে।
তারপর সাঈদীর লন্ডন আসা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কাউকে কঠাক্ষ করে বক্তব্যে সচেতন হয়েছিলেন অনেক বক্তা। এই সচেতনতা ছিল জাতীগত সম্প্রীতির চরম সহায়ক। আজ প্রশ্ন কি আসে না, বিশ বছর আগে সাঈদীর জন্য যে বক্তব্য হারাম ছিল, সে বক্তব্য বিশ বছর পর গাফফার চৌধুরীর জন্য হালাল হয় কি করে?
৮২ তম জন্মদিনের ভাষণ হতে পারে আপনার জীবনের শেষ ভাষণ। শেষ ভাষণ হলে রেখে গেলেন এক তাচ্ছিলের শব্দমালা। জানিয়ে গেলেন যে, হে অনাগত প্রজন্ম তোমরা শুনো, সিলেট থেকে এক জনগোষ্ঠি লন্ডন এসেছিল তারা ছিল “লাঙ্গল টু লন্ডন”। হ্যাঁ যারা আপনার জন্মদিন পালন করতে সেদিন চ্যানেল আইয়ের ষ্টুডিওতে এসেছিল তাদের পূর্বপুরুষ অশিক্ষিত লাঙ্গল টু লন্ডন ছিল, আপনি শেষ জীবনে তার সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন জনাব গাফফার চৌধুরী। আপনার কাছে আর ভাল বক্তব্য আশা করেছিলাম।
সেন্ট আর্লবার্ণস, যুক্তরাজ্য
লেখক: বিলেতপ্রবাসী কবি,গীতিকার, কথা সাহিত্যিক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button