ব্রিটিশ আইন : বাঙ্গালী কমিউনিটির জিজ্ঞাসা ও আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য

Nazir Ahmedব্যারিস্টার নাজির আহমদ: বাংলাদেশ থেকে প্রায় আট হাজার মাইল দূরে আরেক গোলার্ধের কাছে বিলাত নামের এই ভূখন্ডে প্রায় অর্ধ মিলিয়নেরও বাংলাদেশীর বসবাস । বাংলাদেশের বাহিরে এই বিলেতকে বাংলাদেশীদের সর্ববৃহৎ মিলন মেলা বললে অত্যুক্তি হবে না । আটলান্টিকের পারে এই ভূখন্ডে এত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস ঐতিহাসিক কোন দূর্ঘনা নয়। বরং এটা আল্লাহ পাকেরই সিদ্ধান্ত।
মানুষ যেখানেই যাবে বা থাকবে, সমস্যা ও সম্ভাবনা তাদের সাথেই লেগে থাকবে। এটাই সহজাত। অতীতে আমাদের পূর্বসূরীরা বিলেতে এসেছিলেন এই নিয়তে যে কিছুদিন রুজি-রোজগার করে স্বদেশে ফিরে যাবেন। আর এ জন্য আইনগত সমস্যাগুলোর মধ্যে শুধু মাত্র ইমিগ্রেশন নিয়েই তাদেরকে ঘাঁটাঘাটি করতে হতো। অন্যান্য আইনগত সমস্যা নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু গত দুই দশক থেকে বা এর চেয়েও কিছু আগ থেকে এই ট্রেন্ডটির পরিবর্তন হয়েছে। এখন দেশ থেকে এসে অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বিলেতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। দিন দিন এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাছাড়া এ বিলেতে ইতিমধ্যে একটি জেনারেশন গড়ে উঠছে যারা এই দেশকে নিজের দেশ হিসেবে মনে করেন। তাদের জন্মভূমি ও মাতৃভূমি-উভয়ই হচ্ছে এই বিলেত। এ জেনারেশনের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলছে। এরা কোনদিন বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন বলে স্বপ্নেও কল্পনা করে না।
অতীত জেনারেশনের জন্য ইমিগ্রেশন সমস্যা মূখ্য বা কেবলমাত্র সমস্যা হলেও বর্তমান জেনারেশন সব ধরনের আইনগত সমস্যা নিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। তাদের জন্য ইমিগ্রেশন একটি অন্যতম আইনগত সমস্যা হলেও এটি প্রধান সমস্যা নয়। বর্তমান জেনারেশন, স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও দ্বৈতনাগরিকত্বের অধিকারী বাংলাদেশীরা ইমিগ্রেশনের পাশাপাশি আরও যেসব আইনগত ব্যাপার নিয়ে প্রতিনিয়ত চলতে হচ্ছে; সেগুলো হলো:- ফ্যামিলি ও ডিভোর্স মেটার, বাচ্চাদের সাথে যোগাযোগ (কন্টাক্ট) সংক্রান্ত বিষয়, হাউজিং সমস্যা, এমপ্লয়মেন্ট (কর্মসংস্থান) সমস্যা, ডেট (ঋণ) সংক্রান্ত সমস্যা, ক্রিমিনাল (ফৌজদারী) মেটার, সিভিল লিটিগেশন প্রভৃতি।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের আইনগত সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যার সঠিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন সঠিক ও নির্ভূল আইনগত পরামর্শ। আইনগত সমস্যা যদি কোন ব্যক্তির অধিকার আদায়, প্রয়োগ ও ভোগের জন্য হয়, তবে সেই অধিকারের ব্যাপারে সঠিক ধারণা পাবার জন্যও সঠিক আইনগত পরামর্শের দরকার। সঠিক পরামর্শের জন্য আবার যাওয়া উচিৎ দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর কাছে। কেননা অদক্ষ ও অনাভিজ্ঞ ব্যক্তি বা ফার্মের পরামর্শ নিলে আইনগত ব্যাপার যেমন জটিল থেকে জঠিলতর হতে পারে, তেমনি অযথা সময় ও অর্থের অপচয় হতে পারে। অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাজে ও পরামর্শে যে কি ক্ষতি হতে পারে তা নিচের দুটি বাস্তব ঘটনা থেকে পরিস্কার হবে। দুটি ঘটনাই বাস্তব ও কমুউনিটিতে ঘটে যাওয়া, কিন্তু প্রফেশনাল নীতিমালা রক্ষার্থে রূপক অর্থ/নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
ঘটনা-১: তৎকালীন সেক্টর বেইসড স্কীমের আওতায় এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স আপিল এলাও করা হয়েছে। আপিল ওয়াইটিং ও প্রসেসিং-এ ছয় মাসের উপর চলে যাওয়ায় পূর্বের ইস্যুকৃত ওয়ার্ক পারমিটটি ইনভেলিড্ হয়ে গেছে। তাই রিপ্লেইসমেন্ট ওয়ার্ক পারমিট আনতে হবে তত্কালীন ওয়ার্ক পারমিটস (ইউকে) থেকে। এটার জন্য ওয়ার্ক পারমিটস (ইউকে) তে সাধারণ একটি চিটি লিখতে হয় ঢাকা থেকে ভিসা নিয়ার জন্য জানানোর পর। কিন্তু একটি ফার্ম ভুলে আপিল এলাও হবার পর নতুন করে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করে যা সরাসরি নাকচ করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৌটা তখন বন্ধ। এ ভুল এমনভাবে করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে কোনভাবেই ঠিক করা যাচ্ছিলনা। ’অ’ নামের ফার্মের ভুলের কারণে এম্পয়ার এবং আপিলকারী এম্পয়ী উভয়কেই খেসারত দিতে হয়েছিল অযথা।
ঘটনা-২: এক ব্যক্তি এদেশে আসার পর ব্রিটিশ নাগরিক এক পাত্রীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহ রেজিস্ট্রারি করার দু’বছর পার হয়েছে গেছে। তার উচিৎ ছিল বিবাহের ভিত্তিতে তৎকালীন ডিপি/৯৬-এর আওতায় হোম অফিসে এক্সটেনশন অব লীভের জন্য আবেদন করা। কিন্তু ঐ ব্যক্তি “গ” নামের একটি ফার্মে গেলে তাকে ভুল পরামর্শ দিয়ে এসাইলাম ক্লেইম করানো হয়। যার ফলশ্রুতিতে তাকে রিমোভাল ডাইরেকশন দেয়া হয়। সাধারণ একটি ব্যাপারকে ভুল পরামর্শ দিয়ে এমন জঠিল করা হয়েছে যা ঐ ব্যক্তির পরবর্তী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উপরে দুটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে সঠিক পরামর্শের অভাবে অথবা ভুল পরামর্শের কারণে সাধারণ কোন ব্যাপার কত জঠিল আকার ধারণ করতে পারে। এভাবে আরো শত শত ঘটনা আমাদের কমিউনিটিতে ঘটছে । সুতরাং আমাদের কমিউনিটির জনসাধারণের উচিৎ সঠিক পরামর্শের জন্য সঠিক জায়গায় যাওয়া। নতুবা পরবর্তীতে চরম খেসারত দিতে হতে পারে বা দারুনভাবে পস্তাতে হতে পারে।
ইমিগ্রেশন সমস্যা দীর্ঘদিন থেকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হলেও ইদানিংকালে ফ্যামেলি, ডিভোর্স এবং বাচ্চাদের সাথে কন্টাক্ট প্রভৃতি সমস্যা আস্তে আস্তে অন্যতম আইনগত সমস্যা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অতীতে এই সমস্যা আমাদের কমিউনিটিতে ছিল না বললেই চলে। সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে উঠার কারণে স্বামী-স্ত্রী ও বাচ্চাদের প্রতি পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ ছিল প্রকট। আর এটিই পারিবারিক বন্ধনকে ঠিকিয়ে রাখতে এবং এটা আস্তে আস্তে আইনগত সমস্যায় পরিনত না হতে বিরাট ভুমিকা রেখেছে। নিকট অতীতেই আমাদের কমিউনিটিতে ডিভোর্সের হার খুবই কম ছিল। আস্তে আস্তে এটা আশংখাজনকভাবে বেড়ে চলছে। পাশ্চাত্যের বস্তবাদী পরিবেশের সাথে গা বাসিয়ে দেয়া, ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিকতার প্রতি অনিহা এবং সাময়িক দুনিয়াবী স্বার্থে ইমিগ্রেশন স্টেটাসকে ধারালো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা প্রভৃতি কারণে আমাদের কমিউনিটিতে বিবাহভঙ্গ আশংখ্যাজনকহারে দিনদিন বেড়ে চলছে । মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়ের জামাইকে এদেশে এনে অনেক পরিবারে রীতিমত জুলম করা হচ্ছে। তার রুজির প্রতি শকুন চক্ষু ফেলা হচ্ছে। ঠিক বিপরীতভাবে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ছেলের বৌকে এদেশে এনে অনেক পরিবারে দাসীর মত ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ছেলে মেয়ে এই জুলুমগুলো কয়দিন সহ্য করবে? সহ্য করতে করতে একপর্যায়ে না পেরে পরিবারটি ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর যারা এদেশের বড় হচ্ছে এবং যাদের মধ্যে দ্বীনি শিক্ষা নেই তাদের কাছে তো বিয়ে একটি ফ্যাশন মাত্র। আর সাদাদের মত ডিভোর্স তাদের কাছে সাধারণ মামূলী ব্যাপার। প্রফেশনের সুবাদে অনেক পরিবার ও বিয়ে ভাঙ্গার ইতিবৃত্ত শুনে রীতিমত আতকে উঠতে হয়েছে।
বিবাহভাঙ্গা ও বাচ্চাদের সাথে কন্টাক্টের ব্যাপারে কমিউনিটির প্রতি আমার সদা পরামর্শ হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে ব্রিটিশ কোর্ট এ ক্ষেত্রে খুব কমই উপকারে আসে। অযথা সময় ও অর্থ ব্যয় করা উচিৎ নয় মামুলী ব্যাপার নিয়ে কোর্টে গিয়ে। বরং আমরা যদি ধৈয্য ধরি, দ্বীনের আলোকে যার যার দায়-দায়িত্ব পালন করি, তাহলে অনেক বড় সমস্যা এমনিতেই আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাবে। তারপরও যদি পারিবারিক সমস্যার উদ্ভব হয়, তাহলে বৃহত্তর পরিবারকে জড়িত করে অথবা কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় জ্ঞানী ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়ে বা মধ্যস্থতায় সমাধান করার চেষ্টা করা উচিৎ। মনে রাখবেন ব্রিটিশ কোর্ট আধা-ভাঙ্গা বিয়েকে পূরো ভেঙ্গে দেয়া বই সমঝোতা বা জোড়া লাগাবার চেষ্টা করবে না। কোর্টের মাধ্যমে সমাধান পাওয়া আসল সমাধান নয়। বরং এটা তিক্ততাকে আরো বাড়িয়ে দেয় যা দীর্ঘদিন সইতে হয়। এমনকি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত সেটার বিষ চলে যায়। তার পাশাপাশি অর্থ ও সময় ব্যায় তো আছেই।
পরিশেষে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই আজকের লেখার যবনিকাপাত করছি। গত ২০০০ সালের ২রা অক্টোবর থেকে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যন রাইটস ব্রিটেনের আইনের অন্তর্ভুক্ত। এটি ১৯৯৮ সালের হিউম্যান রাইটস এ্যাক্ট দ্বারা ইনকরপোরেট করা হয়েছে। অতীতে এটা শুধু একটি কনভেনশন ছিল। দস্তখতি হিসেবে ব্রিটেন শুধু শ্রদ্ধা করত। ২০০০ সাল থেকে হিউম্যান রাইটস ডমেস্টিক আইনের অন্তর্ভ্ক্তু হবার কারণে ব্রিটিশ সরকারসহ সব পাবলিক অথরিটি হিউম্যান রাইটস এবং এর সব ধারাগুলো তাদের কার্যাবলি ও সিদ্ধান্তে মানতে ও প্রয়োগ করতে বাধ্য। ইমিগ্রেশন ও পারিবারিক আইনে হিউম্যান রাইটস এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে এবং করবে। হিউম্যান রাইটস এর উপর ভিত্তি করে বিলেতের উচ্চ আদালত ইতিমধ্যে অনেক যুগান্তকারি রায় প্রদান করছে। কমিউনিটির জনসাধারণ বিভিন্ন সময় তাদের বিভিন্ন আইনগত সমস্যার ব্যাপারে যখন পরামর্শ নিবেন, তখন তাদের মনোনীত সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে হিউম্যান রাইটস তাদের সমস্যার আইনগত সমাধানে কোন ভূমিকা পালন করতে পারে কিনা।
ব্যারিস্টার নাজির আহমদঃ ব্রিটেন প্রবাসী বিশিষ্ট আইনজীবি, লেখক ও বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button