দারিদ্র বিমোচন : সত্যিই কী এগিয়েছে বাংলাদেশ?

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, দারিদ্র বিমোচনে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত এক দশকে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ। এ সময়কালে দারিদ্র্য কমেছে গড়ে ১.৭ শতাংশ। প্রতিবেদনটির তথ্যমতে, ২০০০ সালে যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ সেখানে ২০১০ সালে তা নেমে এসেছে ৩১.৫ শতাংশে। তবে বাস্তবতার নিরীখে সত্যিই বাংলাদেশ এগিয়েছে কী না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির সিনিয়র ফেলো এবং অর্থনীতিবিদ ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এ রিপোর্টে আয়বৈষম্য কমার কথা বলা হলেও জনগণের সঞ্চয়ের হার স্থবির হয়ে আছে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়ে গেছে। আঞ্চলিক বৈষম্য কমার কথা বলে দেখানো হয়েছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বাঞ্চল বেশি উন্নত হয়েছে। কিন্তু পূর্বে শিক্ষার হার কম এবং পশ্চিমে বিদ্যুতায়ন বেশি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতায়ন যেখানে বেশি সেখানে উন্নয়ন বেশি হওয়ার কথা, কারণ সেখানে শ্রমের বাজার বেড়েছে। তবে রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রথম চরম ও তুলনামূলক দরিদ্র লোক সংখ্যার হার কমেছে বলা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি এর প্রশংসা করে বলেন, এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে; জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে এ দারিদ্র্য কমার সুবিধা আমরা পেয়েছি। তিনি বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যে দরিদ্র্য কমেছে সেটা আমাদের জাতীয় অর্জন। এছাড়া এ সময়ে ৩টি সরকার দেশের ক্ষমতায় ছিল।
গত এক দশকে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ। এ সময়কালে দারিদ্র্য কমেছে গড়ে শতকরা ১.৭ ভাগ। ‘বাংলাদেশ প্রভার্টি এসেসমেন্ট : এসেসিং এ ডিকেট অব প্রগ্রেস ইন রিডিউসিং পোভার্টি ২০০০-১০’ প্রতিবেদনটির তথ্যমতে, ২০০০ সালে যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৪৯ ভাগ সেখানে ২০১০ সালে তা নেমে এসেছে ৩১.৫ ভাগে। এমনকি ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দাও বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসের গতিকে শ্লথ করতে পারেনি। এর ফলে দেশে জনসংখ্যা বাড়লেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে শতকরা ২৬ ভাগ বা ১ কোটি ৬০ লাখ। ২০০০ সালে যেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭০ লাখ। সেখানে ২০১০ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখে, যার মধ্যে ২ কোটি ৬০ লাখ চরম দরিদ্র্য। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ নিয়ে দারিদ্র্য মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই অর্জন করবে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি অর্জনের কথা থাকলেও, বাংলাদেশ সেই সাফল্য দেখাবে চলতি ২০১৩ সালের মধ্যেই। উল্লিখিত সময়সীমায় বাংলাদেশে জনসংখ্যা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ২৬ ভাগ দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমেছে। এটা বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য কম গৌরবের ও কৃতিত্বের নয়। এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ যে ওই সময়ে দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, তাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, তা বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যেও যথেষ্ট ইতিবাচক দিক। রাজনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা যদি বিদ্যমান থাকত, তাহলেও এ সংখ্যা যে আরও বৃদ্ধি পেত, তাতে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ওই সময়ে উন্নয়ন ও উৎপাদনশীল খাতে নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা ২৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়ন ও উৎপাদনশীল খাতের শ্রমবাজারে নারীর এ অংশগ্রহণের অভিযাত্রা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, যা দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
তবে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ কর্তৃক বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান ভোগ করার সংগতির মাপকাঠির মাধ্যমে দারিদ্র্যের পরিমাপ করা হয় । আয়-উপার্জন, প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণের সামর্থ্য, মৌলিক সেবার প্রাপ্তি, শিশু মৃত্যুর হার ইত্যাদি সূচক দিয়ে একজন মানুষ দরিদ্র না সচ্ছল; তার পরিমাপ করা হতে পারে। একেক সূচকের ভিত্তিতে পরিমাপ করলে দারিদ্র্যের হার ও তার হ্রাস-বৃদ্ধির হার একেক রকম হবে। এসব সূচকের মধ্যে দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য কোন্ সূচকটিকে অগ্রাধিকারমূলকভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত, তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্যের বোধ বা উপলব্ধি শুধুমাত্র বস্তুগত উপাদান প্রাপ্তির সংগতি দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না বলেই অনেক বিশেষজ্ঞ মত প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ, দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাস, বেকারত্ব দূরীকরণ, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বা ক্ষেত্র যতই বৃদ্ধি পাক, প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনও যে ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button